হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নরওয়ের চারজন এবং বাংলাদেশের এক নাগরিককে হেনস্তা করা হয়েছে। এর মধ্যে নরওয়ের একজনকে মারধর করে রক্তাক্ত করা হয়েছে। বিমানবাহিনীর কুইক রেসপন্স ফোর্স (কিউআরএফ) এবং আনসার বাহিনীর সদস্যরা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বুধবার রাত আটটার দিকে বিমানবন্দরের আগমনী ক্যানপি-২ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
এদিকে আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) নিয়ম অনুযায়ী কোনো যাত্রীর গায়ে হাত দেওয়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ
বিমানবন্দরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর একটি সূত্র জানায়, মারধরের শিকার যাত্রীর নাম মোহাম্মদ সাইদ উদ্দিন। বাকি চারজন হলেন সাইদের বাবা গিয়াস উদ্দিন, মা বেগম মনোয়ারা, ভাই মোহাম্মদ মহি উদ্দিন এবং গিয়াস উদ্দিনের পুত্রবধূ ইপসা জান্নাতুল নাঈম। এই পাঁচজনকেই হেনস্তা করা হয়েছে।
বিমানবন্দর সূত্র জানিয়েছে, এই পাঁচ যাত্রী নরওয়ে থেকে কাতারের দোহা হয়ে কাতার এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে (কিউআর-৬৩৮) ঢাকায় এসেছেন। তাঁদের গ্রামের বাড়ি ফেনীর সোনাগাজী।
ঘটনার সূত্রপাত সম্পর্কে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা–সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, যাত্রীরা বের হওয়ার সময় কিউআরএফ সদস্যরা তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। পরে এ নিয়ে বাগ্বিতণ্ডার একপর্যায়ে দলগতভাবে আক্রমণ করে সাইদ উদ্দিনকে রক্তাক্ত করা হয়।
রাত সাড়ে ১১টার দিকে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক সিহাব কায়সার খান সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন , ‘দুই ছেলে, বাবা, মা ও এক ভাইয়ের স্ত্রীসহ পরিবারের পাঁচ সদস্য নরওয়ে থেকে ঢাকায় আসেন। কোনো একটি স্থান থেকে তাঁদের সরে যেতে বলা নিয়ে বাগ্বিতণ্ডা থেকে এ ঘটনার সূত্রপাত বলে প্রাথমিকভাবে আমরা জানতে পেরেছি। পরে এক ছেলে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘ভুক্তভোগীদের অভিযোগ পেলে আমরা আইন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেব।’
মেরে রক্তাক্ত করার পর উল্টো তাকেই দোষী সাব্যস্ত করে জরিমানা আদায় করা হয় দাবি করেন আহত প্রবাসীর আত্মীয়
আহত প্রবাসীর আত্মীয় রায়হান দাবি করেন, তার মামাকে মেরে রক্তাক্ত করার পর উল্টো তাকেই দোষী সাব্যস্ত করে জরিমানা আদায় করা হয়। ওই ঘটনার পর তাকে বিমানবন্দরে কর্তব্যরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফারুক সুফিয়ানের আদালতে হাজির করা হয়। সেখানে তাকে সরকারি কর্মচারীকে মারধর করার অপরাধ স্বীকার করে নিতে বলা হয়।
তবে সাঈদ বলেন, আমি তো কোনো অপরাধ করিনি। আমাকেই বিনাকারণে মারধর করা হয়েছে। এরপরও তাকে দোষ স্বীকার করতে চাপ দেওয়া হয়। তাকে বলা হয়, এক মাসের জন্য দেশে এসেছেন, দোষ স্বীকার না করলে তিন বছরেও ফিরতে পারবেন না। তখন বড়ভাই মহিউদ্দিন তাকে অনুরোধ করেন দোষ স্বীকার করতে। তিনি ভাইকে বলেন, এটা নরওয়ে না, এখানে এমনই হয়। সবাই কষ্ট পাচ্ছে, তাড়াতাড়ি এই ঝামেলা মিটিয়ে ফেল। পরে পরিবারের সবার অনুরোধে সাঈদ দোষ স্বীকার করলে তাকে দণ্ডবিধির ১৮৯ ধারায় পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। শেষে তিনি গ্রামের বাড়ি ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার সোনাখালীতে চলে যান।
রায়হান বলেন, ওই ঘটনার পর মামা (সাঈদ) যতটা না শারীরিক, তার চেয়ে বেশি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তিনি এ নিয়ে কারও সঙ্গে আর কথা বলতে চাইছেন না। স্বজনদের শুধু বলেছেন, তিনি সুবিচার পাননি। সুস্থ হয়ে দুই–একদিনের মধ্যে তিনি সংবাদ সম্মেলন করে এ বিষয়ে প্রতিবাদ জানাবেন।
এ ঘটনার একটি ভিডিওতে দেখা যায়, কিউআরএফ ও আনসারের ১০ জনের মতো সদস্য চারদিক থেকে ঘিরে ধরে সাইদ উদ্দিনকে মারধর করছেন। এ সময় একজন নারী চিৎকার করে তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। অপর একটি ভিডিওতে দেখা যায়, মারধরে সাইদের মুখমণ্ডল রক্তাক্ত হয়েছে। মুখের নিচে ও বাঁ চোখের পাশে রক্ত লেগে আছে।
যাত্রীর দোষ দেখছে কর্তৃপক্ষ
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম একটি লিখিত বক্তব্য পাঠান। তাতে বলা হয়েছে, বুধবার আনুমানিক রাত সোয়া ৯টার দিকে বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক আগমনী ক্যানোপি–২ এর সামনে দু’জন যাত্রী একজন নিরাপত্তাকর্মীকে শারীরিকভাবে আঘাত করেছেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা ও প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, পাঁচজন যাত্রীর একটি দল বিমানবন্দরের কার্যক্রম শেষ করে বের হওয়ার সময় তাদের একজন ট্রলিসহ ক্যানোপি–২ এর ফটকের সামনে অবস্থান করলে অন্য যাত্রীদের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। কর্তব্যরত নিরাপত্তাকর্মী তাকে কিছুটা সরে দাঁড়ানোর অনুরোধ করলে তিনি তাতে কর্ণপাত না করে দাঁড়িয়ে থাকেন। কিছুক্ষণ পর নিরাপত্তাকর্মী আবারও তাকে সরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলে তিনি প্রচন্ড রেগে অকথ্য ও অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করেন। তখন সেখানে নিয়োজিত আরেক নিরাপত্তাকর্মী যাত্রীকে শান্ত করার চেষ্টা চালান। একপর্যায়ে ওই যাত্রীর ছেলে (একই ফ্লাইটের যাত্রী, তিনি পেছনে ছিলেন) ঘটনাস্থলে এসে বিমান বাহিনীর নিরাপত্তাকর্মীকে শারীরিকভাবে আঘাত ও লাঞ্ছিত করেন। যাত্রীরা নিরাপত্তাকর্মীকে কিলঘুষি মারা শুরু করলে তাদের মধ্যে ধ্বস্তাধস্তি হয় এবং ওই নিরাপত্তাকর্মী মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। একপর্যায়ে পরিস্থিতি মোকাবেলায় আনসার ও এভসেক সদস্যরা এগিয়ে গিয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের যাত্রীর হাত থেকে মুক্ত করেন।