• ২৬শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ২৮শে শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

জানা গেল ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি না দেওয়ার কারণ

usbnews
প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৫
জানা গেল ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি না দেওয়ার কারণ
নিউজটি শেয়ার করুনঃ

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস সম্পর্কে বছরের পর বছর নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে এসেছে ইসরায়েল। তারা দাবি করে আসছে, হামাস জিম্মিদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে, তাদের নির্যাতন চালায় এবং অমানবিক পরিবেশে আটকে রাখে। তবে সর্বশেষ জিম্মি মুক্তির সময় দেখা গেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র, যা ইসরায়েলের প্রচারণাকে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে।

শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) গাজা থেকে ছয় ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দেয় হামাস। তবে সেই বন্দিরা যখন মুক্তি পেয়ে হামাস যোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এ সময় এক ইসরায়েলি জিম্মি হামাস যোদ্ধার কপালে চুমু খেলেন, সম্প্রচারে সে চিত্রটি ইসরায়েলের শাসকগোষ্ঠীর জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করে। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে হামাস সম্পর্কে যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করা হয়েছিল ইসরায়েলের পক্ষ হতে, তা এ ঘটনায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। খবর স্কাই নিউজ।

হামাসের প্রতি বন্দিদের ইতিবাচক মনোভাব

স্কাই নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি শর্ত অনুসারে নুসেইরাত অঞ্চলে জিম্মি মুক্তির সময় হামাসের হাতে থাকা ইসরায়েলি জিম্মিরা উৎফুল্ল ছিলেন। এলিয়া কোহেন নামে এক বন্দি মুক্তির পর হামাস যোদ্ধাদের কপালে চুমু খেয়েছেন। এ ধরনের দৃশ্য হামাস নিয়ে প্রচলিত নেতিবাচক ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে।

এর আগে ইসরায়েল প্রতিনিয়ত দাবি করে আসছিল যে, হামাস একটি সন্ত্রাসী সংগঠন যারা জিম্মিদের অমানবিক পরিস্থিতিতে রাখে, তাদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায়। কিন্তু সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত জিম্মিদের উচ্ছ্বসিত মুখ, হামাস যোদ্ধাদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দৃশ্য সেই দাবির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

ইসরায়েলের প্রচারণায় ধাক্কা

বিশ্লেষকরা বলছেন, হামাসের বন্দিদের প্রতি আচরণ সম্পর্কে ইসরায়েল যে বিবরণ দিয়েছে, সর্বশেষ মুক্তি পাওয়া বন্দিদের প্রতিক্রিয়া তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এই ঘটনাটি ইসরায়েলের জন্য এতটাই অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েছে যে, তারা পরবর্তী ফিলিস্তিনি বন্দি মুক্তির প্রক্রিয়া স্থগিত করে দিয়েছে।

ইসরায়েলি গণমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েল জানায়, হামাস যখন ছয়জন ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দেয় তখন তার যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুসারে ৬০০ ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার জন্য ওফার কারাগার থেকে বাসে তোলা হয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ সে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলে এবং মুক্তির কার্যক্রম স্থগিত করে।

নেতানিয়াহুর প্রতিক্রিয়া

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু এ ঘটনার পরপরই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, এ ধরনের অপমানজনক আয়োজন আর বরদাশত করা হবে না। যতক্ষণ না হামাস তাদের বন্দি মুক্তির কার্যক্রম নিরপেক্ষ রাখবে, ততক্ষণ ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে না।

তেল আবিবের সরকারি সূত্র বলছে, হামাসের বন্দিদের প্রতি ইতিবাচক আচরণ প্রকাশিত হওয়ায় ইসরায়েলের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এর অংশ হিসেবে ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়েছে।

যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েলের এই আচরণ গাজার যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে। হামাস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইসরায়েল প্রতারণার মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করেছে।

এদিকে, বন্দি বিনিময় চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নের দাবিতে ইসরায়েলে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। তেল আবিবের রাজপথে হাজারো মানুষ ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তির আহ্বান জানাচ্ছে।

এ ঘটনা প্রমাণ করেছে, হামাস সম্পর্কে ইসরায়েলের প্রচারণা যতটা সত্য বলে প্রচার করা হয়েছে, বাস্তবে তার চিত্র ভিন্ন হতে পারে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, পশ্চিমা বিশ্ব ও ইসরায়েলি জনগণ আদৌ হামাস সম্পর্কে নতুন করে ভাববে কিনা।

জিম্মি মুক্তির অনুষ্ঠান বন্ধ না করলে ফিলিস্তিনিদের মুক্তি দেব না : নেতানিয়াহু

গাজা যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্যায়ের চুক্তি অনুযায়ী, শনিবার ছয় ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে হামাস। তবে, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, হামাস পরিচালিত জিম্মিদের মুক্তি অনুষ্ঠান ‘অপমানজনক’ হওয়ায় তারা ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি দিতে অস্বীকার করেছেন। এর ফলে, ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে চুক্তি সম্পর্কিত মতবিরোধ আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। খবর এএফপি।

হামাসের ‘অপমানজনক’ অনুষ্ঠান

ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেছে, হামাস যখন ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি দেয়, তখন মঞ্চে তাদের নিয়ে আসা হয় এবং হাত নেড়ে গাজাবাসীদের উদ্দেশে অভিবাদন জানাতে বাধ্য করা হয়।

নেতানিয়াহু এ বিষয়টি ‘অপমানজনক’ এবং প্রোপাগান্ডার অংশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যা তিনি বলেন, এটি আমাদের জিম্মিদের অসম্মান করে। তার মতে, এ ধরনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জিম্মিদের ব্যবহার করা হচ্ছে, যা ইসরায়েলের পক্ষ থেকে একেবারেই নিন্দনীয়।

যুদ্ধবিরতির চুক্তি লঙ্ঘন

ইসরায়েল দাবি করেছে, হামাস বারবার চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করেছে। নেতানিয়াহু কার্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, এই অপমানজনক অনুষ্ঠানগুলো বন্ধ না হলে পরবর্তী পর্যায়ে ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তির বিষয়টি স্থগিত রাখা হবে।

তিনি উল্লেখ করেন, যতদিন না হামাস এমন অনুষ্ঠান ছাড়া জিম্মিদের মুক্তি দেবে, ততদিন যুদ্ধবিরতি চুক্তির পরবর্তী ধাপের বিষয়ে কোনো আলোচনা হবে না।

হামাসের প্রতিক্রিয়া

হামাসের মুখপাত্র আবদেল লতিফ আল-কানৌউ ইসরায়েলের এই সিদ্ধান্তকে চুক্তির বড় লঙ্ঘন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, ইসরায়েল পূর্বনির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে বন্দিদের মুক্তি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কানৌ আরও বলেন, চুক্তির শর্ত পূরণে ইসরায়েলকে বাধ্য করতে মধ্যস্থতাকারীদের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন।

চুক্তির পরবর্তী পর্যায় নিয়ে আলোচনা

যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্যায় মার্চের শুরুতে শেষ হবে, তবে দ্বিতীয় পর্যায়ের চুক্তি বা স্থায়ী যুদ্ধবিরতি নিয়ে এখনো কোনো আলোচনা শুরু হয়নি। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি, যা থেকে ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে।

হামাসের রাজনৈতিক শাখার সদস্য বাসেম নাঈম অভিযোগ করেন, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নোংরা খেলা খেলছেন যাতে যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেঙে দিয়ে গাজায় নতুন করে যুদ্ধ শুরু হয়।

ইসরায়েলি হামলায় ফিলিস্তিনিরা আক্রান্ত

চুক্তির প্রথম পর্যায়ে যেসব ইসরায়েলি জিম্মি মুক্তি পেয়েছেন, তাদের সবাই মুক্তি পেয়েছেন, কিন্তু ফিলিস্তিনিরা এখনো মুক্তি পায়নি। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে ২৫১ ব্যক্তিকে জিম্মি করে হামাস, যাদের মধ্যে এখনো ৬২ জন গাজায় আছেন। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর দাবি, তাদের মধ্যে ৩৫ জন ইতোমধ্যে নিহত হয়েছেন।

মানবিক সহায়তার অবরোধ

চুক্তির প্রথম পর্যায়ের সময়, গাজার বাসিন্দাদের জন্য মানবিক সহায়তা যথাযথভাবে পৌঁছাতে দেওয়া হয়নি এবং ইসরায়েল করিডর থেকে সেনা প্রত্যাহার স্থগিত রেখেছে, যার কারণে গাজার মানুষ আরও কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন।

এছাড়া, গাজার হাজার হাজার বেসামরিক নারী ও শিশুর নিহত হওয়ার ঘটনাসহ অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে ইসরায়েলকে দায়ী করা হচ্ছে।

এবার কী হবে?

বর্তমানে গাজার পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে এবং যুদ্ধবিরতি চুক্তির পরবর্তী ধাপ নিয়ে এখনো আলোচনা শুরু হয়নি। এই অবস্থা ক্রমেই বিশ্ববাসীর কাছে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধবিরতি চুক্তির দ্বিতীয় পর্যায়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা আশা করা হলেও, এখন পর্যন্ত ইসরায়েল এ বিষয়ে কোনো সাড়া দেয়নি।

বিশ্বের অনেকেই মনে করছেন যে, হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্কের এই ক্রান্তিকাল এবং বিরোধপূর্ণ অবস্থান ভবিষ্যতে আরও বড় আকারে সংঘাত তৈরি করতে পারে। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, যা গাজার শান্তি এবং স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।