গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় প্রতি ৪৫ মিনিটে একটি শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েল কমপক্ষে ১৭ হাজার ৪০০ শিশুকে হত্যা করেছে। এর মধ্যে ১৫ হাজার ৬০০ শিশুকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে আরও অনেকে চাপা পড়ে আছে, যাদের বেশিরভাগকেই মৃত বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গাজার মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৩ লাখই শিশু। গত ১৭ মাস ধরে ইসরায়েলি হামলার কারণে তাদের ঘর-বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে, তাদের স্কুল ধ্বংস করা হয়েছে এবং স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোও ধ্বংস হয়ে গেছে।এদিকে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গাজা থেকে তাদের এক-তৃতীয়াংশ কর্মীকে সরিয়ে আনা হবে। কোনোভাবেই তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ফলে কর্মীদের তারা গাজায় রাখতে চাইছেন না।
গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর বিমান হামলা চলছেই। এদিকে বৃহস্পতিবার (২৭ মার্চ) ভোরের হামলায় হামাস মুখপাত্র আবদেল-লতিফ আল-কানৌয়া এবং আরও আট ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।জাতিসংঘ জানিয়েছে, গাজায় ইসরায়েলের নতুন আক্রমণের ফলে গত সপ্তাহেই ১ লাখ ৪২ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
গাজা উপত্যকাজুড়ে ইসরায়েলি বিমান হামলার খবর পাওয়া গেছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষ দূত বলেছেন, হামাস যদি নিরস্ত্র হয়, তবে তারা সাময়িকভাবে গাজায় থাকতে পারে।
সবশেষ ইসরায়েলি বাহিনী জানিয়েছে, গাজায় তাদের চলমান হামলায় হামাসের শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়েছে। তবে হামাস এখনো এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়নি।
অন্যদিকে, ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা বলেছে, তারা ইসরায়েলের দিকে আরও কয়েকটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, তারা এসব ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে।
ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় গাজার একমাত্র ক্যান্সার চিকিৎসাকেন্দ্র ‘তুর্কি-ফিলিস্তিনি ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল’ এবং এর পাশে থাকা একটি মেডিকেল স্কুল ধ্বংস হয়েছে। ইসরায়েল দাবি করেছে, ওই এলাকায় হামাসের উপস্থিতি ছিল।
ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ইসরায়েলি বাহিনীর বিস্ফোরণের ফলে হাসপাতাল ও মেডিকেল স্কুল সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে এই হামলায় হতাহতের সঠিক সংখ্যা এখনো জানা যায়নি।
এদিকে হামাসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের একটি নতুন ‘সমঝোতার প্রস্তাব’ পর্যালোচনা করছে। তবে এ প্রস্তাবে কী কী শর্ত অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, তা এখনো প্রকাশ করা হয়নি।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই হামলাকে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ বলে নিন্দা জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলে এই হামলার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর জানিয়েছে, ইসরায়েলের সর্বশেষ হামলায় অন্তত ২০০ শিশু ও ১১০ নারী নিহত হয়েছেন। মঙ্গলবার ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ভেঙে হামলা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ৪৯ হাজার ৬১৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত ও ১ লাখ ১২ হাজার ৯৫০ জন আহত হয়েছেন। তবে গাজার সরকারি গণমাধ্যম বলছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া হাজারো মানুষসহ মোট নিহতের সংখ্যা ৬১ হাজার ৭০০ ছাড়িয়ে গেছে।
অন্যদিকে ইসরায়েলের দাবি, গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণে ১ হাজার ১৩৯ জন নিহত ও ২০০ জনের বেশি মানুষ অপহৃত হন।
প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং তিন মধ্যস্থতাকারী দেশ—যুক্তরাষ্ট্র, কাতার ও মিসরের ব্যাপক প্রচেষ্টায় গত জানুয়ারিতে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন সরকার ও গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাস। চুক্তির শর্ত অনুসারে, ১৯ জানুয়ারি থেকে যুদ্ধবিরতি শুরু হয় গাজায়।
প্রসঙ্গত, এই যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে গাজায় ১৫ মাস ধরে চলা সামরিক অভিযানের ইতি টেনেছিল ইসরায়েল। ভয়াবহ সেই অভিযানে গাজায় নিহত হয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার ফিলিস্তিনি। ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলে যে অতর্কিত হামলা চালিয়েছিল হামাসের যোদ্ধারা, সেই হামলার জবাব দিতে এবং হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের উদ্ধারে এ অভিযান শুরু করেছিল ইসরায়েল।
চুক্তির কাঠামো ও বাস্তবায়ন
যে চুক্তির ভিত্তিতে ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি শুরু হয়েছিল, সেটি তিনটি পর্বে বিভক্ত ছিল:
প্রথম স্তর : হামাসের কব্জায় থাকা জিম্মি ও ইসরায়েলের কারাগারে থাকা বন্দিদের বিনিময়ের পাশাপাশি গাজায় খাদ্য ও ত্রাণ সরবরাহ স্বাভাবিক করার শর্ত ছিল।
দ্বিতীয় স্তর : অবশিষ্ট সব জিম্মিকে মুক্তি দেবে হামাস এবং গাজা থেকে ইসরায়েল সম্পূর্ণভাবে সেনা প্রত্যাহার করবে।
তৃতীয় স্তর : দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সমাধান নিয়ে আলোচনা হবে।
প্রথম ধাপের মেয়াদ ছিল ছয় সপ্তাহ, যা সম্প্রতি শেষ হয়েছে। তবে দ্বিতীয় পর্বের বাস্তবায়ন নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। হামাস গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলি সেনাদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার চাইছিল, অন্যদিকে ইসরায়েলের আশঙ্কা ছিল যে, সেনা প্রত্যাহার করলে হামাস আবার সংগঠিত হয়ে ভবিষ্যতে ইসরায়েলে হামলা চালাতে পারে।
যুদ্ধবিরতি চুক্তি কেন ভেস্তে গেল?
ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারে মতবিরোধ : হামাস দাবি করেছিল, ইসরায়েলকে গাজা থেকে সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহার করতে হবে। তবে ইসরায়েল মনে করছিল, এটি করলে হামাস পুনরায় সংগঠিত হয়ে ইসরায়েলে নতুন করে হামলা চালাতে পারে।
বন্দি বিনিময় ও জিম্মিদের পরিস্থিতি : সম্প্রতি হামাস যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের দ্বৈত নাগরিক এবং ইসরায়েলি বাহিনীর সেনা সদস্য ইদান আলেক্সান্ডারসহ চারজন দ্বৈত নাগরিকের মরদেহ ফেরত দেয় ইসরায়েলকে। ইসরায়েল দাবি করে, হামাস ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের হত্যা করেছে। তবে হামাস এই অভিযোগ অস্বীকার করে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা : বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ বাড়াতে চেয়েছিল, কিন্তু পরবর্তী ধাপগুলো বাস্তবায়ন করতে আগ্রহী ছিল না। এছাড়া, হামাস যে নতুন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছিল, সেটিও যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল উভয় প্রত্যাখ্যান করে।
মানবিক সহায়তা বন্ধ করা : হামাসকে চাপে ফেলতে ২ মার্চ থেকে গাজায় খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়, যা এখনো পর্যন্ত চলমান রয়েছে।
ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রভাব
বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিও যুদ্ধবিরতির ভেস্তে যাওয়ার একটি বড় কারণ। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু তার রাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করতে এবং ডানপন্থি জোটকে ধরে রাখতে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে তিনি জনগণের চাওয়া উপেক্ষা করে চুক্তি বাস্তবায়ন না করার নীতি অনুসরণ করছেন।
যুদ্ধবিরতির সমাপ্তি ও বর্তমান পরিস্থিতি
সোমবার (১৭ মার্চ) রাতে ইসরায়েলি সেনারা গাজায় নতুন করে সামরিক অভিযান শুরু করেছে। এতে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩ শর অধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর ফলে, ১৯ জানুয়ারি যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছিল, তা কার্যত শেষ হয়ে গেছে।
মানবিক সংকটের ভয়াবহতা
এদিকে গাজায় যুদ্ধবিরতি ব্যর্থ হওয়ার ফলে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চলমান হামলা ও অবরোধের কারণে খাদ্য, পানি ও ওষুধের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি দ্রুত কোনো সমাধান না আসে, তাহলে গাজায় আরও ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। নিরীহ ফিলিস্তিনিরা জীবন হারাচ্ছে, যারা বেঁচে আছেন তারা ভয়ংকর মানসিক ট্রমার শিকার হচ্ছেন। যুদ্ধবিরতির ব্যর্থতা গাজাকে দীর্ঘমেয়াদী সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
সূত্র: মিডলইস্ট আই, আলজাজিরা