পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাণিজ্য ও ব্যবসার সম্ভাবনা খুঁজে বের করার লক্ষ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এ আহ্বান জানান।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, কিছু বাধা রয়েছে। আমাদের সেগুলো অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়ার উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
গত ১৫ বছর পরে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের দ্বিপাক্ষিক সভা হচ্ছে ঢাকায়, যেখানে আমনা বালুচ পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
অতীতের কথা উল্লেখ করে আমনা বালুচ বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগানোর উপায় খুঁজে বের করতে হবে।তিনি আরও বলেন, আমাদের নিজেদের মধ্যে বিশাল আঞ্চলিক বাজার রয়েছে। আমাদের এটি কাজে লাগানো উচিত। আমরা প্রতিবারই সুযোগ হারাতে পারি না। দুই দেশের বেসরকারি খাতের মধ্যে নিয়মিত ব্যবসা-ব্যবসা (বিটুবি) যোগাযোগ এবং সব পর্যায়ে সফর বিনিময় হওয়ার প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানের শীর্ষ ব্যবসায়ী চেম্বার এফপিসিসিআইয়ের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করেছে এবং এ সময় এফবিসিসিআইয়ের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে।
গণহত্যার জন্য ক্ষমা
প্রেস ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন বলেন, বৈঠকে একাত্তরের গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি তুলেছে বাংলাদেশ। পাকিস্তান এ নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে আগ্রহের কথা জানিয়েছে। এ ছাড়া ৪ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার ফেরত চেয়েছে বাংলাদেশ, তবে এ নিয়ে আরও আলোচনা হবে। মুক্তিযুদ্ধের পর আটকে পড়া তিন লাখ ২৫ হাজার পাকিস্তানিকে ফেরত নেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছে ঢাকা।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আশা প্রকাশ করেন, এপ্রিলের শেষের দিকে দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী ইসহাক দারের আসন্ন সফর দুই দেশের সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করবে।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তিনি বরাবরই পাকিস্তানসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার পক্ষে ছিলেন, বিশেষ করে সার্ক কাঠামোর আওতায়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে আরও বেশি যুব বিনিময় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আদান-প্রদান করা উচিত, যাতে জনগণের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার হয়। আমরা অনেক দিন ধরে একে অপরকে মিস করেছি, কারণ আমাদের সম্পর্ক হিমায়িত ছিল। আমাদের সেই বাধা অতিক্রম করতে হবে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে নিউইয়র্কে এবং ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ডি-৮ সম্মেলনের ফাঁকে কায়রোতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে তার বৈঠক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অগ্রগতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সার্ক, ওআইসি এবং ডি-৮-এর মতো বহুপাক্ষিক ও আঞ্চলিক ফোরামে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাবে।
এ সময় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফসহ অন্যরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
শিল্প-বাণিজ্য-কৃষি
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ঢাকা-ইসলামাবাদ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের ওপর জোর দিচ্ছে। পাকিস্তানের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য প্রবেশের সুযোগ বৃদ্ধি, বাণিজ্য প্রক্রিয়া সহজ, শুল্ক বাধা দূর এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানের বিনিয়োগ বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
জসীম উদ্দিন বলেন, কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও বন্যা প্রতিরোধে দু’দেশের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের ওপর জোর দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতে আমনা বালুচ বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের নিজেদের বিশাল আঞ্চলিক বাজার রয়েছে। এটি দু’দেশেরই কাজে লাগানো উচিত।
পরিবহন
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, সম্প্রতি দু’দেশের মধ্যে সরাসরি নৌ যোগাযোগ (শিপিং রুট) চালু হয়েছে। পুনরায় সরাসরি ফ্লাইট চালু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, শিগগির বিমান যোগাযোগ চালু করা সম্ভব হবে।
গাজা ইস্যু
বৈঠকে পূর্ব এশিয়ার দুই দেশ মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছে। গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর গণহত্যা ও চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা জানিয়েছে তারা। জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদে প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের সমর্থনও চেয়েছে বাংলাদেশ।
শিক্ষা ও সংস্কৃতি
বৈঠকে উচ্চশিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় পারস্পরিক সহযোগিতার নতুন সুযোগ সন্ধানের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে দুই দেশ। জসীম উদ্দিন জানান, সংস্কৃতি ও ক্রীড়াক্ষেত্রে সম্পর্ক জোরদারের বিষয়ও আলোচনায় এসেছে। দুই দেশের শিল্পী, চিত্রশিল্পী, সংগীতশিল্পী, লেখক ও শিক্ষাবিদদের সফরের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বিনিময়কে উভয় পক্ষ থেকেই উৎসাহিত করা হয়েছে।
সম্পর্ক জোরদারের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূস পাকিস্তানের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনা অনুসন্ধানে জোর দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার আমনা বালুচ সাক্ষাৎ করতে গেলে প্রধান উপদেষ্টা এ কথা জানান।
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, দু’দেশের মধ্যে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। আমাদের সেগুলো অতিক্রমের উপায় খুঁজে বের করতে হবে এবং সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
এ সময় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আশা প্রকাশ করেন, এপ্রিলের শেষে দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী ইসহাক দারের আসন্ন সফর দুই দেশের সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তিনি সবসময় পাকিস্তানসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পক্ষে। বিশেষ করে সার্ক কাঠামোর মধ্যে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সার্ক, ওআইসি এবং ডি-৮ এর মতো বহুপক্ষীয় ও আঞ্চলিক ফোরামে একসঙ্গে কাজ চালিয়ে যাবে।
এ সময় এসডিজি-বিষয়ক সিনিয়র সচিব লামিয়া মোরশেদ, ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফসহ অন্যান্য কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকায় এসে খুশি বালুচ
পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকের পর বালুচ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য বৈঠক করেন। এর পর তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ঢাকায় এসে আমি খুশি। আলোচনা খুব চমৎকার হয়েছে। বাংলাদেশের খাবার, এখানে কেনাকাটা কেমন হয়েছে– জানতে চাইলে বলেন, ‘খুব ভালো হয়েছে’।
ইসহাক দার ঢাকায় আসছেন ২৭ এপ্রিল
ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন বলেন, বৈঠকে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের ঢাকা সফরসূচিও চূড়ান্ত হয়েছে। তিনি ২৭ ও ২৮ এপ্রিল ঢাকা সফর করবেন।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব বাংলাদেশে, যা বলছে ভারত
প্রায় ১৫ বছর পর ঢাকা ও ইসলামাবাদের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে ফরেন অফিস কনসাল্ট্যাশন (এফওসি) অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় আয়োজিত বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচ তাদের নিজ নিজ পক্ষের নেতৃত্ব দেন।
এবার এ নিয়ে মন্তব্য করল ভারত। বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) নিয়মিত সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালের কাছে এক সাংবাদিক জানতে চান, প্রায় ১৫ বছর পর এই বৈঠক হলো। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচ এখন বাংলাদেশে। এ ব্যাপারে ভারতের মতামত কী?
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমরা অবগত আছি।’
ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলের পর বাংলাদেশ-ভারত অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে এক সাংবাদিক জানতে চাইলে মুখপাত্র বলেন, ‘এ নিয়ে আমরা অনেকবার বলেছি। আগেও বেশ কয়েকবার বলা হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের সময়ও ব্যাপারটি স্পষ্ট করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি, বাংলাদেশের সঙ্গে ইতিবাচক ও গঠনমূলক সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় ভারত। একটি গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমৃদ্ধির বাংলাদেশের পাশে আমরা সব সময়ই রয়েছি।’
ট্রান্সশিপমেন্টে ব্যাখ্যায় রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ‘ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা নিয়ে গত সপ্তাহে আমরা ঘোষণা দিয়েছি। আমাদের বন্দর ও বিমানবন্দরগুলোতে জট লেগে যাওয়ার কারণে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। আমি আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই, নতুন এই সিদ্ধান্তের আগে বাংলাদেশ ইস্যুতে আমরা কতটা এগিয়েছি, সেদিকে নজর দিন।’
তিনি বলেন, এই ঘোষণা বাংলাদেশ থেকে নেপাল ও ভুটানে রপ্তানিতে প্রভাব ফেলেনি। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে আমি এভাবেই দেখি।’