হিগুচি তাকাশি বলেন, উন্নয়ন ক্ষেত্রে তার কাজ এমন একটি প্রস্তাব দিয়ে শুরু হয়েছিল, যা তিনি প্রত্যাখ্যান করতে পারেননি, অথবা বলা যেতে পারে, এমন একজন ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে সে প্রস্তাব এসেছিল, যাকে তিনি না বলতে পারেননি৷ এটি ছিল ২০১৭ সালের কথা। নাকামুরা তেৎসু তখন জাপানে ফিরে এসেছিলেন এই প্রকৌশলীর সাহায্য চাইতে। হিগুচি বলেন, তিনি স্বনামধন্য এই ডাক্তারকে খালি হাতে পাঠাতে পারেননি:
“আমি কাজটি শুরু করেছিলাম এই আশা নিয়ে যে ডাঃ নাকামুরা এতে একটু আনন্দের সাথে আফগানিস্তানে ফিরতে পারবেন।”
বর্তমানে হিগুচি পেশোয়ার-কাই’এর পরিচালনা পরিষদের একজন সদস্য এবং প্রযুক্তিগত উপদেষ্টা। তিনি নদীর পানি সংগ্রহে বাঁধ নির্মাণের একজন বিশেষজ্ঞ। এটি নদীকে সেচ খালের সাথে সংযুক্ত করার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা। তার এই বিশেষ জ্ঞান আফগানিস্তানের রুক্ষ ভূমির একটি বিশাল অংশকে সবুজ খামারে রূপান্তর করতে সাহায্য করেছে৷
একটি পুরানো বাঁধ এবং একটি ব্যক্তিগত যোগসূত্র
ডাক্তার নাকামুরার সাথে হিগুচির যোগাযোগের সূত্রপাত হয়েছিল কয়েক শতাব্দি পুরানো একটি বিস্ময়কর জাপানি প্রযুক্তির কারণে; আর সেটি হলো আসাকুরা শহরের ইয়ামাদা বাঁধ।
এদো যুগে নির্মিত ইয়ামাদা বাঁধ, কোন বিদ্যুৎ বা যন্ত্রপাতি ছাড়াই চিকুগো নদী থেকে পানি এনে পার্শ্ববর্তী কৃষি জমিকে সিক্ত করে চলেছে।
নাকামুরা, যিনি নিজে ফুকুওকা জেলার একজন বাসিন্দা ছিলেন, বিশ্বাস করতেন আফগানিস্তানের শুকনো ভূমিতে প্রাণের নিঃশ্বাস বয়ে আনতে হলে একটি বড় নদীর ধার বরাবর পানি সংগ্রহের বাঁধ নির্মাণের প্রয়োজন হবে। তবে পদ্ধতিটি হতে হবে সহজ, যাতে স্থানীয় লোকজন তা নিজেরাই নির্মাণ করতে, সচল রাখতে এবং রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারেন। এঅবস্থায় ইয়ামাদা বাঁধকে তার কাছে মনে হয়েছিল একটি উৎকৃষ্ট নমুনা।
সাহায্যের জন্য নাকামুরা’র অনুরোধে সাড়া দিতে প্রথমে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন হিগুচি। তবে নাছোড়বান্দা এই ডাক্তার তার অনুরোধ অব্যাহত রাখেন এবং একদিন প্রকৌশলির কর্মস্থলে গিয়ে হাজির হন।
“যখন আমার নাকামুরার সাথে সামনাসামনি দেখা হয়, তখন আমি বুঝতে পারি তিনি অত্যন্ত দয়ালু এবং ভদ্র একজন মানুষ; সামান্যতম ঔদ্ধত্বও নেই তার। আমার ধারণা তার অনুরোধে সাড়া না দেয়া অধিকাংশ মানুষের পক্ষেই অসম্ভব।”
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কাজ করা
হিগুচি সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নেন। তার ভাষ্যমতে, তার অংশীদারিত্বের সিদ্ধান্তের কারণ ছিল “স্থানীয় জনগণের সাথে একত্রে কাজ করার” বিষয়ে নাকামুরার প্রতিশ্রুতি।
তার প্রথম কাজটি ছিল একটি মডেল তৈরি করা, যাতে ইয়ামাদা বাঁধের কার্যকারিতাকে সহজ করে দেখানো হবে। নাকামুরা চেয়েছিলেন এটি স্থানীয়দের জন্য সহজে বোঝার মতো হোক। ঐতিহাসিক নথি থেকে উপাত্ত ও পরিমাপ নিয়ে, ইয়ামাদা বাঁধের আশপাশ থেকে জোগাড় করা প্রকৃত নুড়ি এবং গাছ ব্যবহার করে অত্যন্ত সাবধানতার সাথে বাঁধটির একটি ছোট সংস্করণ তৈরি করেন হিগুচি।
মডেলটি তৈরি করতে একবছর সময় লেগেছিল, যা দেখে নাকামুরা অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন। এটি বর্তমানে আফগানিস্তানের পেশোয়ার-কাই অফিসে প্রদর্শিত রয়েছে। মডেলটি স্থানীয় পানি সংগ্রহের বাঁধ নির্মাণের জন্য একটি আদর্শ মানদন্ড হিসাবে কাজ করছে।
হিগুচি ২০১৯ সালে নাকামুরার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিন বছর ধরে ইয়ামাদা বাঁধ বিষয়ে প্রশিক্ষণের আয়োজন করেন।
নাকামুরা মাঠ পর্যায়ে হাতে-কলমে যুক্ত থাকাকে অগ্রাধিকার দিতেন, যে মনোভাবের কারণে তিনি হিগুচির প্রতি তার পরবর্তী অনুরোধটি নিয়ে এসেছিলেন; তা হলো, আফগানিস্তানের লোকজনকে এবিষয়ে সরাসরি নির্দেশনা প্রদান করা। এটি এমন একধরনের সহায়তা, যা তাদের দারিদ্র্য থেকে মুক্ত হতে এবং স্বাধীন জীবনযাপন করতে সাহায্য করবে।
২০১৯ সালে নাকামুরার মৃত্যু পর্যন্ত টানা তিন বছর ইয়ামাদা বাঁধে বার্ষিক প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেন হিগুচি। সঠিক সাইট জরিপের মাধ্যমে পানি সংগ্রহের বাঁধ নির্মাণের জন্য যে দক্ষতা প্রয়োজন, তা তিনি নাকামুরার আফগান সহকর্মীদের শিখিয়েছিলেন।
এই প্রশিক্ষণে নাকামুরা দোভাষী হিসেবে কাজ করতেন। তার আফগান সহকর্মীরা হিগুচিকে নানা ধরনের প্রশ্ন করতে আগ্রহী ছিলেন।
হিগুচি বলেন, “নাকামুরা নিজেও জরিপ যন্ত্রটি দেখে অভিভূত হয়েছিলেন এবং এও জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, তিনি এটি ব্যবহার করার চেষ্টা করতে পারেন কি না। তার আফগান সহকর্মীদের নির্মাণ দক্ষতার ব্যাপকভাবে উন্নতি হচ্ছিল, তাই আমার ধারণা তিনি নিজেকে চ্যালেঞ্জ করতে চাইছিলেন।”
হিগুচি উল্লেখ করেন যে, আফগান প্রশিক্ষণার্থীদের একজন পরবর্তীতে তার অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে ফিল্ড সুপারভাইজার হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন।
সহজ প্রযুক্তি
নাকামুরা সবসময় সহজ প্রযুক্তি ব্যবহার করার উপায় খুঁজতেন। প্রশিক্ষণের সময় তিনি ইয়ামাদা বাঁধের নুড়ি নিঃসরণ ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন, যা সেচ খালে পানি সঞ্চয়ের সময় পানি থেকে পলিমাটি আলাদা করার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
“যদি নুড়ি পাথরের নিঃসরণ পথে আধুনিক বৈদ্যুতিক গেট বসানো হতো, তবে তা ভেঙ্গে গেলে স্থানীয়ভাবে সারিয়ে নেয়া সম্ভব হতো না। আমরা এজাতীয় সব অংশগুলো প্রতিস্থাপন করেছি, যাতে সেগুলো স্থানীয়ভাবে প্রয়োগ করা যায়,” বলেন হিগুচি৷ “আমাদের লক্ষ্য ছিল স্থানীয় জনগণের জন্য পুরো ব্যবস্থাটির পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব করা। নাকামুরা এই বিষয়টিতে সবচেয়ে মনোযোগ দিয়েছিলেন।”
নাকামুরা আফগানিস্তানে মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে পুরকৌশল এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে দক্ষতা প্রদানের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন। পানি সংগ্রহের বাঁধের নির্মাণ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী প্রায় ৪শ’ জন স্থানীয় প্রকৌশলী প্রশিক্ষণ লাভ করেছেন সেখানে।
তৃণমূল পর্যায়ে অংশীদারিত্বকে বিস্তৃত করার নাকামুরার এই অভিপ্রায় ফল বয়ে এনেছিল ২০২৩ সালের আগস্টে, একটি জরুরি অবস্থার সময়। আফগানিস্তানের একটি প্রধান জলপথ কুনার নদী প্লাবিত হয়ে পানি সংগ্রহের বাঁধের পাশে কিছু অংশ ধসে পড়ে। মূল অবকাঠামো বিকল হয়ে পড়লেও পুরকৌশলের জ্ঞান থাকা স্থানীয় লোকজন ধসে পড়া অংশগুলোর পুনর্নির্মাণের প্রচেষ্টা নিজেরাই শুরু করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
নাকামুরার অপরাজেয় কর্মমালা
পেশোয়ার-কাই’এর ৪০ বছরের যাত্রায় যুদ্ধ, বড় ভূমিকম্প এবং নাকামুরার মর্মান্তিক মৃত্যুসহ অসংখ্য চ্যালেঞ্জের সাথে লড়াই করতে হলেও সংগঠনটি এখনও অটুট রয়েছে। নাকামুরার সুদূর প্রসারী চিন্তাভাবনা এবং গভীর আবেগ উৎসাহ জোগায় এই সংগঠনের নানা কাজকে।
“এমনকি একটি বিধ্বস্ত দেশেও আমি মনে করি একটি ‘আলো’ সত্যিই ছড়িয়ে পড়ছে”, হিগুচি বলেন। “আমি সকলকে জানাতে চাই যে পৃথিবীর কোথাও এমন কিছু মানুষ আছেন, যারা অন্যের জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিতে পারেন।”
পেশোয়ার-কাই’এর ভাষ্যমতে, আফগানিস্তানে ১১টি পানি সংগ্রহের বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, যা এক সময়ের অনুর্বর ভূমিকে প্রাণবন্ত কৃষি জমিতে রূপান্তরিত করেছে। এই জমিগুলো সাড়ে ছয় লাখেরও বেশি মানুষকে জীবিকা চালাতে সাহায্য করছে৷ উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, নাকামুরার মৃত্যুর পরেও পেশোয়ার-কাইতে ১০ হাজারের বেশি নতুন সহযোগী যোগ দিয়েছেন।