গ্রিনল্যান্ড বিশ্বের বৃহত্তম অমহাদেশীয় দ্বীপ হলেও এর জনসংখ্যা খুব কম, মাত্র ৫৬ হাজারের চেয়ে কিছুটা বেশি। প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ ইনুইট আদিবাসী এবং পৃথিবীর উষ্ণায়ন তাদের জন্মভূমির জন্য প্রচুর ঝুঁকি তৈরি করছে, যার দুই-তৃতীয়াংশ আর্কটিক সার্কেল বা সুমেরু বৃত্তে অবস্থিত।
গ্রিনল্যান্ডের প্রায় ৮০ শতাংশ একটি বিশাল বরফের স্তর দ্বারা আচ্ছাদিত, তবে এই স্তর দ্রুত গলে যাচ্ছে। কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিমবিজ্ঞানী সামান্থা বুজার্ডের ভাষ্যানুযায়ী, গ্রিনল্যান্ড এবং অ্যান্টার্কটিকা উভয় অঞ্চলেই প্রতিদিনের গলিত বরফের পরিমাণ “গিজার পিরামিডের আয়তনের ৪শ গুণেরও বেশি।”
সুমেরু বৃত্তের ঠিক উত্তরে অবস্থিত একটি শহর কাঙ্গারলুসুয়াকের কাছে আমরা গত আগস্ট মাসে বুজার্ডের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসমূহ সেখানে বরফের স্তরের সাথে প্রবাহিত গলিত পানির মধ্যে অত্যন্ত স্পষ্ট ছিল। এই সতত প্রবাহিত হতে থাকা স্রোত শেষ পর্যন্ত বরফের স্তরের নিচে বিশাল সাব-গ্লেসিয়াল হ্রদ গঠন করে।
বুজার্ড বলেন, “এগুলো যে সেখানে রয়েছে তা আমরা আসলে খুব সম্প্রতি জানতে পারি”। “তাই আমরা বোঝার চেষ্টা করছি যে কীভাবে এগুলো পূর্ণ হয়ে স্রোতাকারে নির্গত হচ্ছে।”
তার ভাষ্যমতে, জলবায়ুর উষ্ণায়ন কীভাবে গ্রিনল্যান্ডের বরফের স্তরকে প্রভাবিত করার মধ্য দিয়ে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণ হচ্ছে, সে সম্পর্কে আরও জানার জন্য এই ভূগর্ভস্থ পানির ধারাগুলো অধ্যয়ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আর সময় কিন্তু দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। ২০২২ সালে ডেনমার্কের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, বরফের এই স্তর চলতি শতাব্দীতে ১১০ লক্ষ কোটি টন গলে যাবে এবং আমাদের মহাসাগরগুলোকে ২৭ সেন্টিমিটার উঁচু করবে -“এমনকি পুরো বিশ্ব যদি আজ জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো বন্ধও করে দেয়।”
আর ভবিষ্যতে এই ধরনের ব্যাপক পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকায়, বুজার্ডের ভাষ্যানুযায়ী, “টোকিওর মতো নিচু শহরগুলো বড় সমস্যায় পড়তে পারে।”
বরফের হ্রাস, সংস্কৃতির বিনাশ
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো গ্রিনল্যান্ডের চারপাশের জলরাশিতেও অত্যন্ত স্পষ্ট, এবং রপ্তানির ৯০ শতাংশ জুড়ে থাকা মৎস্য আহরণ শিল্পও এর সাথে মানিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে৷
এটি এমন এক সময়কাল, যখন সমুদ্রের বরফের আকার ছোট হয়ে আসছে, এবং স্তরগুলোও পাতলা থেকে পাতলা হয়ে পড়ছে। যারা নৌকায় মাছ ধরেন তাদের জন্য এটি আসলে একটি সুখবর হতে পারে, কিন্তু অন্যরা যারা স্লেজ কুকুর ব্যবহার করে একটি ঐতিহ্যগত পদ্ধতিতে মাছ ধরার সঙ্গে জড়িত, তারা এই ভেবে শঙ্কিত যে তাদের জীবিকা শীঘ্রই চিরতরে লুপ্ত হয়ে যাবে।
২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গ্রিনল্যান্ডের প্রায় ৮০ শতাংশ বাসিন্দা বিশ্বাস করেন যে, বরফের পথ অতিক্রম করা ক্রমশ আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে এবং ৬৭ শতাংশ মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তন শেষ পর্যন্ত স্লেজ কুকুরগুলোর জন্যও ক্ষতির কারণ হবে।
গ্রিনল্যান্ডে স্লেজ পদ্ধতিতে মাছ ধরার প্রবণতা কমছে, তবে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এই প্রবণতাকে কেবল ত্বরান্বিতই করবে। উপকূলীয় শহর ইলুলিসাটে, ২৫ বছর বয়সী একজন মৎস্যজীবী নিজে ঐতিহ্যবাহী এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করে দেখার সুযোগ না পাওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেন।
তবে এই শিল্প সংশ্লিষ্ট কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি অপেক্ষাকৃত কম হতাশ। একজন পুরুষ বলেন, স্লেজভিত্তিক মৎস্য শিকার “আমার পা ভেঙ্গে দিয়েছে”। “আর আমি যাদের সাথে কাজ করি, তাদেরও পায়ের অবস্থা খারাপ। কেউ কেউ ক্রাচ বা হাঁটার কাঠামো ব্যবহার করেন।”
আমাদের সাথে আলাপ হওয়া বয়স্ক জেলেদের আরেকটি দল, স্লেজ থেকে নৌকায় স্থানান্তরের বিষয়টির ব্যাপক প্রশংসা করেন। একজন এমনকি এও বলেন যে, তার ধৃত মাছের পরিমাণ বেড়ে চলেছে।
খনিজ সংস্থাগুলোর সম্মুখে বড় সুযোগ
সমুদ্রে বরফের এই হ্রাস এমনকি শিল্পখাতেও একটি বড় পরিবর্তন আনয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। সুমেরুর বাণিজ্যিক পথগুলো দিয়ে চলাচল করা এখন সহজ, এবং আরও বেশি বিদেশি সংস্থা গ্রিনল্যান্ডের সমৃদ্ধ খনিজ মজুদগুলোতে নিজেদের যুক্ত করতে চাইছে।
এর মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলীয় খনিজ আহরণ কোম্পানি ‘এনার্জি ট্রানজিশন মিনারেলস’ বা ইটিএম, দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর নারসাকে অবস্থিত নিজেদের কোয়ানেফজেল্ড প্রকল্পের মাধ্যমে যারা বৈদ্যুতিক গাড়ি এবং বায়ু টারবাইনে ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণে বিরল মৃত্তিকা ধাতু নিষ্কাশন করতে চাইছে।
কোম্পানির কর্মকর্তাদের ভাষ্যানুযায়ী, অন্তত ৩৭ বছর ধরে কার্যক্রম চালানোর জন্য যথেষ্ট মজুদ এই খনিটিতে রয়েছে।
তবে কাজটি ২০২১ সাল থেকে আটকে আছে, যেবছর গ্রিনল্যান্ড সরকার ইউরেনিয়াম নিষ্কাশিত হতে পারে, এরকম কোনো খনির কার্যক্রমের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
তারপরও, ইটিএম এই প্রকল্প পুনরায় চালু হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী, এবং কোম্পানির কর্মকর্তারা এই বিষয়ের উপর জোর দেন যে, প্রকল্পটি গ্রিনল্যান্ডের অর্থনীতিতে বছরে ২৪ কোটি ডলারের যোগান দিতে পারে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে, পরিবেশমন্ত্রী কালিস্ট্যাট লুন্ড ইউরেনিয়াম-মুক্ত অঞ্চলে খননকে স্বাগত জানাচ্ছেন। তবে নারসাকের প্রসঙ্গ আসলে তিনি বলেন, “সেখানে আমাদের মাছ ধরা এবং খামার শিল্প রয়েছে”। “এবং তাই পরিবেশের প্রশ্ন সেখানে এক নম্বরে।”