• ১০ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ২৬শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ১৫ই মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি

যুদ্ধে ইরানকে দ্রুত কাবু করতে ইসরায়েল নতুন ‘দাহিয়া কৌশল’ প্রয়োগ, পাল্টা পদক্ষেপ ইরানের

Usbnews.
প্রকাশিত জুন ১৮, ২০২৫
যুদ্ধে ইরানকে দ্রুত কাবু করতে ইসরায়েল নতুন ‘দাহিয়া কৌশল’ প্রয়োগ, পাল্টা পদক্ষেপ ইরানের
নিউজটি শেয়ার করুনঃ

কয়েক দশকের মধ্যে ১৩ জুন ইরানে আগ্রাসী হামলা চালায় ইসরায়েল। লেবাননে অতীত সাফল্যের পুনরাবৃত্তি করতে হামলার ছক কষেছিল দেশটি। গত বছরের সেপ্টেম্বরে চালানো ওই হামলায় হিজবুল্লাহর অভিজাত রাদওয়ান ইউনিটকে নেতৃত্বশূন্য করা হয়েছিল। অত্যন্ত দ্রুতগতির সঙ্গে পরিচালিত সেই হামলায় শেষ পর্যন্ত মহাসচিব হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যা করেছিল তেল আবিব। তবে ইরানে সেই কৌশল কাজ করেনি।

প্রথম দিন ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ইরানজুড়ে একাধিক আক্রমণ চালায়। একটি আবাসিক টাওয়ারে ৬০ জন বেসামরিক লোক নিহত হন, বেশ কয়েকজন শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী এবং সিনিয়র সামরিক কমান্ডারকে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বিমান প্রতিরক্ষা এবং পারমাণবিক অবকাঠামোগত স্থাপনাগুলোয় আঘাত করা হয়।

চলমান যুদ্ধে ইরানকে দ্রুত কাবু করতে ইসরায়েল নতুন ‘দাহিয়া কৌশল’ প্রয়োগ করছে ইসরায়েল। ২০০৬ সালে লেবাননের বৈরুতে সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে কৌশলটি ব্যবহার করেছিল তারা। এর মাধ্যমে বৈরুতের দাহিয়া জেলায় হিজবুল্লাহর সদরদপ্তর সহজে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ইসরায়েল।

যুদ্ধ পরিকল্পনাটি প্রকাশ করেছে ইসরায়েলের সম্প্রচার চ্যানেল ফোরটিন। তাতে বলা হয়েছে, কৌশলগত স্থানগুলোতে নিয়মিত বোমা হামলা করা হবে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় হামলা চালিয়ে বাসিন্দাদের বাস্তুচ্যুত করা হবে। জনগণ যাতে অতিষ্ঠ হয়ে ইরান সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নামে ও সরকার অস্থিতশীল হয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ ইরানের বিরুদ্ধে এ পরিকল্পনা অনুমোদন করেছেন।

একটি ব্যর্থ কৌশল

অপ্রতিরোধ্য শক্তি ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে শত্রুর ওপর দ্রুত আধিপত্য অর্জনের এই কৌশল লেবাননে সাফল্য পেয়েছিল। তবে ইরানের আরও অনেক বেশি স্থিতিস্থাপক জাতির সঙ্গে এ কৌশলে সফলতা পাওয়া সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না। তবে অন্তত কৌশলগতভাবে ইসরায়েল তার হামলার মাধ্যমে ইরানকে হতবাক করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও এর বেশির ভাগই অভ্যন্তরীণ অনুপ্রবেশ এবং নাশকতামূলক অভিযানের কারণে হয়েছিল।

তেহরানের জবাব

ইসরায়েলের হামলার জবাবে ইরানের প্রতিক্রিয়া ছিল দ্রুত। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তেহরান তিনটি উল্লেখযোগ্য প্রতিশোধমূলক অভিযান শুরু করে। দেশের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার, ড্রোন ইউনিট পুনরায় সক্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কমান্ড পোস্টগুলো পূরণ করা হয়। আবার অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া ইরানি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুর ছবি ও ভিডিও তেহরানের অপারেশনাল পুনরুদ্ধার এবং কৌশলগত বার্তারও ইঙ্গিত দেয়।

বার জন্য অথবা কারও জন্য নয়

যুক্তরাষ্ট্র যদি আক্রমণ করে, তবে ইরান স্পষ্টভাবে তার কৌশল ঘোষণা করেছে। সবার জন্য অথবা কারও জন্য নয়– যার অর্থ সমুদ্র নিরাপত্তা, জ্বালানি নিরাপত্তা এবং পশ্চিম এশিয়ায় মার্কিন ঘাঁটির নিরাপত্তা। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির শীর্ষ পররাষ্ট্রনীতি উপদেষ্টা জাওয়াদ লারিজানি যেমনটা বলেন, পারস্য উপসাগরে একটি পুরোনো নিয়ম রয়েছে। যদি আমাদের (ইরানের) তেল স্থাপনাগুলো গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে আমরা এই অঞ্চলের কোনো দেশকে তাদের তেল ব্যবহার করতে দেব না।

সংসদের জাতীয় নিরাপত্তা কমিশনের সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইসমাইল কাউসারির যুক্তি– হরমুজ প্রণালি বন্ধ করার মাধ্যমে সহজেই ইরান এ কাজ করতে পারে।

ইরানের যুদ্ধক্ষেত্রের ভুল ব্যাখ্যা

তেল আবিব ভুল করে ধরে নিয়েছে যে, লেবাননের কৌশলটি ব্যাপক ফলপ্রসূ। ইরানের নেতৃত্বকে সরিয়ে দিতে তাদের কপি-পেস্ট পরিকল্পনায় বেশ কিছু ভুল গণনা দুর্বল করে দিয়েছে। প্রথমত, ইরানের সামরিক কমান্ড বিশাল, অভিজ্ঞ ও দ্রুত পরিবর্তনযোগ্য।

দ্বিতীয়ত, ইরানের বিশাল আকার গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের কৌশলগত বিস্তৃত করার সুযোগ করে দেয়। ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলো পশ্চিমাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোয় হামলা করলেও দেশটির বেশির ভাগ অবকাঠামো পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলে রাখা আছে।

তৃতীয়ত, ইসরায়েলের গোয়েন্দা ব্যবস্থা ইরানি কমান্ড পর্যায়ে প্রবেশ করলেও এটি পূর্ণমাত্রায় আধিপত্য অর্জন করতে পারেনি। ইসলামিক প্রজাতন্ত্র কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স অপারেশনের ক্ষমতা ধরে রেখেছে।

সংহতির ইরানি সংস্করণ

তেল আবিবের সবচেয়ে বড় ভুল হিসাব ছিল, ইরানের অভ্যন্তরীণ সংহতির বিচার করায়। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিশ্বাস, হঠাৎ বহিরাগত হামলা ইরানের বিরোধী শক্তিগুলোকে সক্রিয় করবে এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী, জঙ্গি ও সরকার সমালোচকরা রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করে দেবে। কিন্তু বহিরাগত হুমকির মুখে ইরানের রাজনৈতিক ঐক্য বারবার প্রদর্শিত হয়েছে।

তেল আবিব তিন দিনের মধ্যে ২২৪ জন ইরানি নাগরিককে হত্যা করেছে, যাদের বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক। এই ধরনের উস্কানির পরিণতি রয়েছে। এই সংঘাতে ইরানের প্রতিরোধ কেবল সামরিক নয়, এটি সামাজিক।

যুদ্ধ পরিকল্পনাটি প্রকাশ করেছে ইসরায়েলের সম্প্রচার চ্যানেল ফোরটিন। তাতে বলা হয়েছে, কৌশলগত স্থানগুলোতে নিয়মিত বোমা হামলা করা হবে।

যে কোনো সংঘাতের মতো এ যুদ্ধের ফলাফলও অনিশ্চিত। এটি আরও বিস্তৃত যুদ্ধে পরিণত হবে নাকি আরেকটি আঞ্চলিক অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দেবে, তা ইসরায়েলের ওপর কম নির্ভর করছে। বরং তেল আবিবকে অনুসরণ করে যুক্তরাষ্ট্র পুরো অঞ্চলকে আগুনে পুড়িয়ে দিতে ইচ্ছুক কিনা, তার ওপর বেশি নির্ভর করে।

ইসরায়েলি সামরিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, দখলদার সেনাবাহিনী সামরিক স্থানের কাছাকাছি বাসিন্দাদের ফার্সি ভাষায় সতর্কতা জারি করা শুরু করেছে। এর আগে গাজা ও লেবাননে বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে বাস্তুচ্যুত করায় জোর দেওয়া হয়েছিল।

সোমবার ভোরে ইরানের প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সংলগ্ন বেসামরিক ঘরবাড়িকে লক্ষ্যবস্তু করেছে ইসরায়েল। এই পদ্ধতিতে লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন ও গাজায় তারা হামলা চালিয়ে আসছে। বিশ্ব সম্প্রদায় এ হামলাকে গণহত্যার কৌশল বলে মনে করে।
দাহিয়া কৌশল হলো ইচ্ছাকৃত ও সম্পূর্ণ ধ্বংসের একটি আনুষ্ঠানিক সামরিক কৌশল। এ পদ্ধতির মাধ্যমে সরাসরি বেসামরিক এলাকা ধ্বংস করা হয়। মানবাধিকার গোষ্ঠী ও আইন বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে এ যুদ্ধ কৌশলটিকে ধ্বংসের কৌশল বলে আখ্যায়িত করে আসছেন। যুদ্ধে আড়ালে বেসামরিক মানুষ ও সম্পদ নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক আইনে এ কৌশল নিষিদ্ধ। আন্তর্জাতিক বিধির তোয়াক্কা না করেই ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বারবার কৌশলটি কাজে লাগিয়েছে।

দাহিয়া কৌশলের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, বেসামরিক অবকাঠামো ও সম্পদ ধ্বংস করে শত্রু দেশের সরকারকে চাপে ফেলা। বেসামরিক শক্তির কেন্দ্রগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করা। ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল স্টাফ গাদি আইজেনকোটকে এ কৌশলের জনক বলা হয়।