ফুলন দেবীর সেই হত্যাকাণ্ডের রায় হলো ৪৩ বছর পর , ঠাকুরদের গণধর্ষণের প্রতিশোধ নেয়া দস্যুরাণী
ফুলন দেবীর সেই হত্যাকাণ্ডের রায় হলো ৪৩ বছর পর , ঠাকুরদের গণধর্ষণের প্রতিশোধ নেয়া দস্যুরাণী
usbnews
প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৪
নিউজটি শেয়ার করুনঃ
১৯৬৩ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের জালৌন জেলার ঘোড়া কা পুরয়া নামক অজ পাড়া গাঁয়ে হিন্দু ধর্মের নিম্ন বর্ন মাল্লার সম্প্রদায়ের (পেশা হচ্ছে নৌকা চালানো) এক দরিদ্র পরিবারে ফুলনের জন্ম।
মাত্র ১১ বছর এর শিশু ফুলন এর বিবাহ দেয়া হয় ৩০ বছর বয়সী পুট্টিলাল নামের এক লোকের সাথে। যিনি ছিলেন অসৎ চরিত্রের পুরুষ। স্বামীর নির্যাতন সইতে না পেরে ফুলন পিতৃগৃহে ফিরে আসে।
ভারতের উত্তর প্রদেশের কানপুরের বেহমাই গ্রাম ‘দস্যুরানী’ ফুলন দেবী ও তাঁর বাহিনীর হাতে সংঘটিত চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের চার দশক পর স্থানীয় আদালতের রায় ঘোষণা করা হয়েছে।
আশির দশকে ধর্ষণের বদলা নিতে ২০ জনকে খুন করেছিলেন ফুলন দেবী ও তার দলের সদস্যরা। ওই কাণ্ডের ৪৩ বছর পর সাজা ঘোষণা করল ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের কানপুরের একটি আদালত। ওই ঘটনায় অভিযুক্তদের মধ্যে বর্তমানে দুজন বেঁচে আছে। তার মধ্যে একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে কানপুরের আদালত।
জানা যায় , ২০০১ সালের ২৫ জুলাই তাঁকে নয়াদিল্লিতে সরকারি বাসভবনের বাইরে হত্যা করা হয়। যাঁদের ফুলন দেবী হত্যা করেছিলেন, তাঁদের পরিবারের পক্ষ থেকেই চালানো হয়েছিল এই হত্যাকাণ্ড।
এছাড়া প্রমাণের অভাবে অন্যজনকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে। উত্তরপ্রদেশের বেহমাই ওই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। ঠাকুর সম্প্রদায়ের উচ্চবর্ণের পুরুষদের হাতে গণধর্ষণের শিকার হয়েছিল ফুলন দেবী। আর গণধর্ষণের বদলা নিতে ২০ জন ঠাকুর সম্প্রদায়ের পুরুষকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করেছিল ফুলন দেবী এবং তার দলের সদস্যরা।
ওই ঘটনায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। ঘটনার চাপে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ভিপি সিং। এ ঘটনায় ৩৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। তবে বিচার চলাকালীন ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে গণহত্যার সাথে জড়িত আর দুজন বেঁচে আছে। এর মধ্যে একজন শ্যামবাবু কেওয়াত এবং অন্যজন বিশ্বনাথ। প্রথমজনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের সাজা ঘোষণা করেছেন কানপুরের দেহাতের অতিরিক্ত জেলা বিচারক অমিত মালব্য এবং দ্বিতীয়জনকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন। এই মামলা চলাকালীন ২৮ জন সাক্ষীর মৃত্যু হয়েছে। ২০১২ সালে কানপুরের ওই আদালতে চার্জ গঠন হয়েছিল।
হত্যাকাণ্ডের পর ফুলন দেবী আত্মসমর্পণ করেন। তবে তিনি হয়ে ওঠেন ভারতে অত্যাচারিত, দলিত, নিম্ন বর্ণের মানুষ ও আদিবাসীদের প্রতিবাদের মুখ। তাঁকে নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে তৈরি হয় চলচ্চিত্র, যা পরিচালনা করেছিলেন শেখর কাপুর।
বিচারক অমিত মালবিয়ার আদালত শ্যাম বাবুকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন, কিন্তু প্রমাণের অভাবে অপর অভিযুক্ত বিশ্বনাথকে খালাস দিয়েছেন বলে সরকারপক্ষের আইনজীবী রাজু পোরওয়াল জানিয়েছেন।
রাজু পোরওয়াল বলেন, ফুলন দেবীসহ মোট ৩৫ জনকে এই মামলায় আসামি করা হয়েছিল। শ্যাম বাবু ও বিশ্বনাথ ছাড়া বাকি সবাই মারা গেছেন।
১৯৮১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ফুলন দেবী এবং তাঁর দল ধর্ষণ ও অন্যান্য অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে কানপুরের রাজপুর থানা এলাকায় অবস্থিত বেহমাই গ্রামে ২০ জনকে হত্যা করেছিলেন বলে অভিযোগ। মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৭ জন উচ্চবর্ণের ঠাকুর সমাজের মানুষ ছিলেন। ঠাকুর সমাজ ও উচ্চবর্ণের প্রতিনিধিরা কোনো কারণ ছাড়াই ফুলন দেবীকে একটি ঘরে আটকে রেখে টানা কয়েক দিন ধর্ষণ করেন। এর প্রতিশোধ নিতেই ফুলন দেবী ডাকাত দলে যুক্ত হয়ে ২০ জনকে হত্যা করেন।
১৯৯৪ সালে সমাজবাদী পার্টির তৎকালীন প্রধান এবং উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদবের আদেশে ফুলন দেবীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়েছিল। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি সমাজবাদী পার্টিতে যোগ দেন এবং ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে উত্তর প্রদেশের মির্জাপুরের এমপি হিসেবে লোকসভায় নির্বাচিত হন। নিরক্ষর হলেও তাঁর রাজ্য ও কেন্দ্রে অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন ফুলন দেবী।
১৯৮৩ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ফুলন দেবী জেলে ছিলেন। বেহমাই থেকে পালিয়ে আরেক দস্যু মান সিংয়ের সাথে ডাকাত দল তৈরি করেন ফুলন দেবী। এরপর ১৯৮১ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি দল নিয়ে বেহমাই গ্রামে ফিরে যান ফুলন দেবী।
সেখানে গিয়ে তারা গ্রামবাসীর বলেছিলেন শ্রীরামকে তার হাতে তুলে দিতে। কিন্তু পুরো গ্রামে শ্রীরামকে খুঁজে না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ২২ জন ঠাকুর সম্প্রদায়ের পুরুষকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে ফুলন দেবীর দলের সদস্যরা।
এগারো বছর বয়সে চাচাদের চাপে তার পরিবার তাকে বিয়ে দিতে বাধ্য হয় পুতিলাল নামে ত্রিশোর্ধ্ব এক ব্যক্তির সাথে, যে ফুলন দেবীকে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করতো।
অত্যাচারের মুখে শিশু ফুলন দেবী বেশ কয়েকবার স্বামীর বাড়ি থেকে নিজ বাড়িতে ফিরে আসলেও সামাজিক চাপের মুখে বারবার তাকে স্বামীর বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয়।
১৯৭৯ সালে জমি দখল নিয়ে পারিবারিক বিরোধের জের ধরে চাচাতো ভাইকে পাথর ছুঁড়ে আহত করেন কিশোরী ফুলন দেবী। এই ঘটনার পর প্রায় এক মাসের জন্য তাকে স্থানীয় থানা পুলিশ আটক করে রাখে।
তার জীবনী লেখক মালা সেন ফুলন দেবীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে থানায় তাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল কিনা।
জবাবে তিনি বলেছিলেন, “তারা আমাকে নিয়ে অনেক মজা করেছিল, আর আমাকে প্রচন্ডভাবে মারধর করেছিল।”
ঐ বছরের জুলাই মাসেই ফুলন দেবীকে তার বাবার বাড়ি থেকে অপহরণ করে বাবু গুজ্জর নামের এক ডাকাতের দল। মালা সেনকে দেয়া ফুলন দেবীর ভাষ্য অনুযায়ী, বাবু গুজ্জর তাকে টানা তিনদিন ধর্ষণ করে।
কিন্তু ঐ দলের আরেক ডাকাত বিক্রম মাল্লার ভালো লেগে যায় ফুলন দেবীকে।
ফুলন দেবীকে অপহরণের তিন দিনের মধ্যেই বাবু গুজ্জরকে খুন করে দলের নেতা হয় বিক্রম মাল্লা। বিক্রম ফুলন দেবীকেও অস্ত্র চালানো শেখায় এবং ডাকাত দলের সদস্য করে নেয়।
পরের প্রায় এক বছর তাদের ডাকাত দল উত্তর প্রদেশের দেভারিয়া, কানপুর আর ওরাই অঞ্চলে ত্রাস সঞ্চার করে।
একদিন ধনী ঠাকুর বংশের ছেলের বিয়েতে সদলবলে ডাকাতি করতে যান ফুলন। সেখানে ফুলন খুঁজে পান এমন দুজন মানুষকে, যারা তাকে ধর্ষণ করেছিল। ক্রোধে উন্মত্ত ফুলন দেবী আদেশ করেন বাকি ধর্ষণকারীদেরও ধরে আনার। কিন্তু বাকিদের পাওয়া না যাওয়ায় লাইন ধরে ঠাকুর বংশের ২২ জনকে এক সঙ্গে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলা হয়। বেমাইয়ের এই গণহত্যা ভারতবর্ষে ব্যাপক সাড়া ফেলে।
ফুলনকে ধরার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে সরকার। আবার ফুলনের পক্ষেও ভারত জুড়ে চলে আন্দোলন। একপর্যায়ে ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন সরকার সন্ধিপ্রস্তাব করেন এবং ফুলন সন্ধির জন্য বেশ কিছু শর্ত দেন।
শর্তসমূহ হচ্ছে:
ফুলন ও তার অন্যান্য সঙ্গীরা কেবল মধ্যপ্রদেশে আত্মসমর্পন করিবেন, বিচারের জন্য তাদের উত্তরপ্রদেশে নেওয়া হবেনা।
ফাঁসী দিতে পারিবেননা ও ৮ বৎসরের অধিক সময় কারাবাস হবেনা।
সম্পর্কীয় ভাতৃ মায়াদিন অবৈধভাবে দখল করা জমি ফুলনের পিতাকে ফেরত দিতে হবে।
ফুলনের পিতৃ-মাতৃকে মধ্যপ্রদেশে সংস্থাপিত করতে হবে।
সরকার ফুলনের ভাইকে চাকুরি দেওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে।
সরকার তার সবকয়েকটি শর্তে সম্মত হয়। বেহমাই হত্যাকাণ্ডের প্রায় দুই বৎসর পর ১৯৮৩ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রায় ৮০০০ জন দর্শকের উপস্থিতিতে ফুলন আত্মসমর্পন করেন। ১৯৯৪ সনে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন।
আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ফুলন দেবী
১৯৯৪ সালে তার বিরুদ্ধে থাকা সব মামলা তুলে নেয়া হয় এবং তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান।
এরপর ১৯৯৬ সালে তাকে সমাজবাদী পার্টি লোকসভা নির্বাচনের টিকেট দিলে তিনি মধ্য প্রদেশ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এরপর ১৯৯৯ সালে তিনি দ্বিতীয় দফায় লোকসভা নির্বাচনে জেতেন।
সাংসদ থাকা অবস্থাতেই ২০০১ সালের ২৫শে জুলাই তার দিল্লির বাসভবনের সামনে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে শের সিং রানা নামের এক যুবক।আততায়ী শের সিং রানাকে দুইদিনের মধ্যেই গ্রেফতার করা হয় এবং তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে হাই সিকিউরিটি তিহার জেলে পাঠানো হয়।তিন বছরের মধ্যে ২০০৪ সালে জেল থেকে আদালতে নেয়ার সময় তিনি পালিয়ে যান এবং ২০০৬ সালে আবার ধরা পড়েন।২০১৪ সালে দিল্লির একটি আদালত ফুলন দেবী হত্যার দায়ে শের সিং রানাকে দোষী সাব্যস্ত করলেও ২০১৬ সালে জামিনে মুক্তি পান তিনি।
ঠাকুরদের হাতে নিজের গণধর্ষণের বদলা নিতে ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে উত্তরপ্রদেশের বেহমই-তে ঠাকুর সম্প্রদায়ের ২০ জনকে এক সঙ্গে হত্যা করেন এই ফুলন দেবী। দু’বছর গা ঢাকা দেওয়ার পর তিনি এবং তাঁর দলবল ১৯৮৩-র ফেব্রুয়ারিতে আত্মসমর্পণ করেন। ১১ বছর জেলে কাটানোর পর ফুলন দেবী সমাজবাদী পার্টিতে যোগ দিয়ে দু’বার সাংসদ হন।