রাশিয়ায় ভিন্নমতাবলম্বী আলেক্সি নাভালনির মৃত্যুতে বিশ্বজুড়ে নেতারা শ্রদ্ধা নিবেদন এবং ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। উল্লেখ্য, ভিন্নমতাবলম্বী এই রাজনীতিবিদ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সবচেয়ে স্পষ্টবাদী সমালোচকদের একজন ছিলেন৷
নাভালনি, পুতিনের অভ্যন্তরীণ চক্রের দুর্নীতি উন্মোচনের পাশাপাশি এর বিরুদ্ধে উচ্চকন্ঠ হওয়ার মাধ্যমে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। ২০২০ সালে তাকে বিষ প্রয়োগ করা হলেও কয়েক মাস জার্মানিতে চিকিৎসা নিয়ে তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন। রাশিয়ায় ফিরে আসার পর, তাকে নানা অভিযোগ গ্রেপ্তার করা হয়, যেগুলোকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে তিনি বাতিল করে দেন।
নাভালনিকে সুমেরুর উত্তরের একটি কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। গত শুক্রবার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে, হেঁটে আসার পর তিনি মারা যান। তারা এও জানায় যে, তাকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেয়া হলেও তারা “ইতিবাচক ফলাফল” অর্জন করতে সক্ষম হননি।
রুশ প্রেসিডেন্টের প্রেস সচিব দিমিত্রি পেসকভ বলেন যে, “আমাদের জানামতে বর্তমানের সব বিধি বিধান অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় সংশোধন পরিষেবা বিভাগ পরীক্ষানিরীক্ষা, স্পষ্টীকরণ ইত্যাদি পরিচালনা করছে।”
তিনি এও বলেন যে, নাভালনির মৃত্যুর জন্য রুশ নেতাদের দায়ী করা “অগ্রহণযোগ্য”।
এখনও অনেকেই সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের উপর দোষ চাপাচ্ছেন।
পশ্চিমা নেতারা এখবরে তাদের বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন যে, তিনি “অবাক হননি” তবে “ক্ষুব্ধ”। তিনি এও বলেন যে, “রুশ কর্তৃপক্ষ তাদের নিজস্ব গল্প ফাঁদতে যাচ্ছে। কোনো ভুল করবেন না, কোনো ভুল করবেন না, নাভালনির মৃত্যুর জন্য পুতিনই দায়ী।”
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তার হতাশা প্রকাশ করে বলেন যে, “পুতিন যতক্ষণ তার পদে বহাল থাকবেন ততক্ষণ তিনি কারও মৃত্যুকে পরোয়া করেন না। সেজন্য তাকে কিছুতেই রাখা যাবে না।”
কিছু রুশ নাগরিক নাভালনির প্রতি তাদের শ্রদ্ধা জানাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তবে, মস্কোতে গণসমাবেশ করার বিরুদ্ধে তাদের সতর্ক করেছেন কর্মকর্তারা।
রাশিয়ার একটি অধিকার গোষ্ঠী জানিয়েছে যে, কর্তৃপক্ষ দেশ জুড়ে কয়েক’শ লোককে আটক করেছে যারা কারাগারে আটকাবস্থায় মৃত্যুবরণ করা রাশিয়ার বিরোধী নেতা আলেক্সি নাভালনির জন্য শোক প্রকাশ করছিলেন।
গোষ্ঠীটির ভাষ্যানুযায়ী, শুক্রবার থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত মস্কো এবং সেন্ট পিটার্সবার্গ’সহ ৩২টি শহরে ৪শ’ জনেরও বেশি লোককে আটক করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সোচ্চার সমালোচক হিসেবে পরিচিত নাভালনি গত শুক্রবার কারাগারে মারা যান বলে জানা গেছে।
নাভালনির একজন মুখপাত্র তার মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেন এবং গতকাল শনিবার প্রকাশিত এক ভিডিওচিত্রে তাকে “খুন” করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
নাভালনির মা ও আইনজীবী, কারা কর্মকর্তাদের কথানুযায়ী যেখানে তার মৃতদেহ নেয়া হয়েছিল সেখানে যান, তবে সেখানে মৃতদেহটি ছিলনা।
নাভালনির সমর্থক গোষ্ঠীর একজন জেষ্ঠ্য কর্মকর্তা বলেন যে, তাদের বলা হয় যে নাভালনি “আকস্মিক মৃত্যু সিন্ড্রোমে” মারা গেছেন।
মুখপাত্রটি বলেন যে, নাভালনির সহযোগীরা তার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করবেন এবং মৃতদেহটি তার পরিবারের কাছে হস্তান্তরের দাবি জানাবেন।
গতকাল শনিবারও, বিভিন্ন স্থানে নাভালনির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে লোকজনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা অব্যাহত ছিল।
দেশটির ২য় বৃহত্তম শহর সেন্ট পিটার্সবার্গে, সোভিয়েত আমলে নিপীড়নের শিকারদের জন্য নির্মিত একটি স্মৃতিস্তম্ভে শোকার্তরা সমবেত হন। নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতিতে তারা প্রার্থনা করেন এবং পুষ্পস্তবক অর্পন করেন।
৮৩ বছর বয়সী একজন মহিলার ধরে থাকা একটি প্ল্যাকার্ডে, “মৃত্যু হয়নি, খুন হয়েছে” লেখা ছিল। তিনি বলেন যে, নাভালনি এবং রাশিয়ার কথা ভাবলে তার হৃদয়ে ব্যথা অনুভূত হয়। তিনি মনে করেন, দেশটি ধ্বংসের পথে ধাবিত হচ্ছে।
তার ভাষ্যমতে, তিনি আর তার দেশের ভবিষ্যতে বিশ্বাস করেন না এবং মনে করেন রাশিয়া এখন জোসেফ স্ট্যালিনের শাসনাধীন সোভিয়েত ইউনিয়নের চেয়েও খারাপ অবস্থায় রয়েছে।
দৃশ্যত পরে ওই মহিলাকে সাময়িকভাবে আটক করা হয়।
পর্যবেক্ষকদের ভাষ্যানুযায়ী, পুতিন প্রশাসনের সমালোচনা ছড়িয়ে পড়া নিয়ে কর্তৃপক্ষ উদ্বিগ্ন।
ইতিমধ্যে, স্বাধীন রাশিয়ান মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ গ্রুপ ওভিডি-ইনফো অনুসারে, নাভালনির মৃত্যুর পরে রাশিয়া জুড়ে নজরদারি এবং সমাবেশের পরে রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ প্রায় ৩৪০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। নাভালনির মৃত্যুতে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে “ঠগ” হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
আলেক্সি নাভালনির দেহ ঘিরে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা
বার্তা সংস্থা এএফপির মতে, নাভালনির সমর্থকরা রাশিয়ান কর্তৃপক্ষকে “হত্যাকারী” বলে অভিযুক্ত করেছে, তাদের দাবি সেকারণেই নাভালনির দেহ হস্তান্তর করা হচ্ছে না। ৪৭ বছর বয়সী এই ক্রেমলিন সমালোচক “sudden death syndrome” -এ আক্রান্ত হওয়ার পরে শুক্রবার একটি আর্কটিক কারাগারে মারা যান, তখনই তার মা লিউডমিলাকে রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ বলেছিল, নাভালনির দেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে না তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত।
এক্স-এর একটি পোস্টে, নাভালনির মুখপাত্র, কিরা ইয়ারমিশ বলেছেন যে নাভালনির মা, একজন আইনজীবী সহ, রাশিয়ার সালেখার্ড মর্গেও গিয়েছিলেন, কিন্তু তার লাশ পাননি। যদিও রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ তাদের আশ্বস্ত করে বলেছিলো নাভালনির দেহ সেখানে রয়েছে। যদিও পরে নাভালনির আইনজীবীকে পুলিশ বলে, মর্গে নিহত নেতার দেহ নেই! ফলে উদ্বেগ বাড়ছে নাভালনির সমর্থক ও পরিবারের। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সমালোচক হিসাবেই খ্যাত নাভালনি। জালিয়াতি ও দুর্নীতি-সহ একাধিক অভিযোগে নাভালনিকে দোষী সাব্যস্ত করে রাশিয়ার একটি আদালত। তার সাজার মেয়াদ বাড়িয়ে ৯ বছর করা হয়। পরে তা আরও বেড়ে একলাফে হয় ১৯ বছর।