জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তীকার আত্মহত্যার ঘটনায় তার সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকী ও সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের গোয়েন্দা বিভাগের লালবাগ জোনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
শনিবার রাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার হাবিবুর রহমান গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন এবং বলেন, ওই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনার পর থেকে এই দু’জনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছিল। তারা পুলিশ হেফাজত রয়েছেন।
শনিবার অবন্তীকার আত্মহত্যার ঘটনায় তার সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকী ও শিক্ষক দ্বীন ইসলামকে গ্রেপ্তারে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন শিক্ষার্থীরা। এই দাবি পূরণ না হলে সোমবার ভাইস চ্যান্সেলরের কার্যালয় ঘেরাওয়ের হুঁশিয়ার দেয়া হয়।
উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয়টির আইন বিভাগের ১৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী অবন্তীকা শুক্রবার রাতে ফেসবুক স্ট্যাটাসে আটক দু’জনকে দায়ী করে আত্মহত্যা করেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফাইরুজ অবন্তিকা আত্মহত্যা করার আগে ফেসবুকে পোস্টে যেসব অভিযোগ করে গেছেন, তা তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। কমিটি আগামীকাল রোববার থেকে কাজ শুরু করবে। কমিটিকে দ্রুত উপাচার্যের কাছে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি জাকির হোসেনকে আহ্বায়ক করে গঠিত তদন্ত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন আবুল হোসেন, আইন অনুষদের ডিন মাসুম বিল্লাহ, সংগীত বিভাগের চেয়ারম্যান ঝুমুর আহমেদ এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার (আইন) রঞ্জন কুমার।
ফাইরুজ অবন্তিকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ১৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন
জবি শিক্ষার্থী অবন্তীকা আত্মহত্যার ঘটনায় কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানায় দুই জনের বিরুদ্ধে আত্মহত্যা প্ররোচনার মামলা দায়ের করেছে তার মা। শনিবার রাত নয়টায় কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানায় অবন্তীকার সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকি ও সহকারী প্রক্টর দীন ইসলামের বিরুদ্ধে তিনি এই অভিযোগ দায়ের করেন। কোতয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. ফিরোজ হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
মামলার বিবরণ থেকে জানা গেছে, অবন্তিকার সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকী অফলাইনে ও অনলাইনে অবন্তীকাকে যৌন হয়রানি করে আসছিল। যার বিরুদ্ধে সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের নিকট অভিযোগ করলে তিনি অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উলটো অবন্তিকাকেই নানানভাবে অপমান করে আসছিলেন।
এ বিষয়ে ওসি ফিরোজ বলেন, অবন্তিকার মা তাহমিনা শবনম বাদি হয়ে সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকি ও সহকারী প্রক্টর দীন ইসলামের আসামি করে মামলা দায়ের করেন। আমরা কর্তৃপক্ষের আলোচনা করে তাদের দিকনির্দেশনা মতো মামলার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
উল্লেখ, শুক্রবার রাত ১০টার দিকে ফেসবুক আইডিতে এক পোস্টে নিজের আত্মহত্যার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকীকে দায়ী করেন অবন্তীকা।
ফেসবুকে দেওয়া ওই পোস্টের পর কুমিল্লার বাগিচাগাঁও ফায়ার সার্ভিস পুকুরপাড়ের নিজ ঘরের ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় ফাইরুজ সাদাফ অবন্তীকার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। রাত সোয়া ১০টার দিকে তাকে কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
অবন্তিকার আত্মহত্যার খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা এই ঘটনার বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ করেন। যার প্রেক্ষিতে আইন বিভাগের ওই সহপাঠীকে সাময়িক বহিষ্কার ও দ্রুত গ্রেপ্তারের নির্দেশ এবং অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে সহায়তাকারী শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত ও প্রক্টরিয়াল বডি থেকে তাৎক্ষণিক অব্যাহতি প্রদান করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সুইসাইড নোটে এমনটিও ইঙ্গিত উল্লেখ আছে, অভিযুক্ত সহকারী প্রক্টর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতা ছিলেন।
যে ফেসবুক পোস্টটি দেওয়ার পর নিজ বাড়িতেই আত্মহননের পথ বেছে নেন আইন বিভাগের এই শিক্ষার্থী, সে পোস্টটিতে অন্তত বিষয়টা স্পষ্ট। দীর্ঘ সেই পোস্টে তিনি বারবার উল্লেখ করেছেন কীভাবে তাঁকে ক্রমাগত হুমকির মুখে রাখা হয়েছে। সহপাঠীর যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্যের প্রতিবাদ করায় অনলাইনে এবং বাস্তবে প্রতিনিয়ত তাঁকে হয়রানি করা হচ্ছিল বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। অবন্তিকার অভিযোগ, একজন সহকারী প্রক্টর অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পর্যায়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি অভিযুক্ত সহপাঠীর পক্ষ নিয়ে তাঁকে হয়রানি করতে শুরু করেন। অন্তত সাতবার তাঁকে কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে অবমাননা, অপমান ও হয়রানি করা হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। কুৎসা রটানোর মাধ্যমে সামাজিকভাবেও তাঁকে হেয় করা হয়।
ফাইরুজ অবন্তিকা নামে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক শিক্ষার্থী শুক্রবার রাতে আত্মহত্যা করেছেন। মৃত্যুর আগে ২৪ বছর বয়সী এ তরুণী একটি সুইসাইড নোট লিখে গিয়েছেন। সেখানে তিনি তাঁর একজন ব্যাচমেট বা সহপাঠী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী প্রক্টরকে তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী করে গেছেন।
তিনি সুইসাইড নোটে লিখেছেন—‘আমার উপর দিয়ে কী গেলে আমার মতো নিজেকে এতো ভালোবাসে যে মানুষ সে মানুষ এমন কাজ করতে পারে। আমি জানি এটা কোনো সলিউশন না, কিন্তু আমাকে বাঁচতে দিতেসে না বিশ্বাস করেন। আমি ফাইটার মানুষ। আমি বাঁচতে চাইসিলাম!…এটা সুইসাইড না, এটা মার্ডার। টেকনিক্যালি মার্ডার।’