সম্প্রতি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুর পর দেশটিতে সবচেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। রাইসি কি সত্যিই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন নাকি এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড এ বিষয়টিও গুরুত্বসহকারে আলোচনা করছেন রাজনৈতিক সমালোচকরা। এমন পরিস্থিতিতে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নতুন করে আলোচনায় এসেছেন দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনিজাদ।
এরইমধ্যে আসন্ন ২৮ জুন ইরানের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থীতা চূড়ান্ত করেছেন দেশটির কট্টরপন্থী এই নেতা। তবে এখনও তার প্রতিদ্বন্দ্বীতার বিষয়টি পরিষ্কার নয়। আগামী ১১ জুন কারা কারা প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করতে পারবেন তার তালিকা ঘোষণা করবে ইরানের ধর্মীয় নেতাদের দ্বারা পরিচালিত পরিষদ। মূলত এরপরই বোঝা যাবে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আহমেদিনেজাদ প্রার্থীতা করতে পারবেন কী না!
ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমকে উদ্বৃত করে অনলাইন সিএনএন এসব তথ্য জানিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আহমেদিনেজাদ ইরানের এলিট রেভল্যুশনারি গার্ডের একজন সদস্য ছিলেন। তিনি প্রথমবারের মতো ২০০৫ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এসময় দেশটির ধর্মীয় নেতাদের রাজনৈতিক বন্ধুতে পরিণত হন আহমেদিনেজাদ। তবে এ বন্ধুত্ব বেশি দিন স্থায়ীত্ব পায়নি।
২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন তিনি। এরপর থেকেই ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খমিনির সঙ্গে তার রাজনৈতিক বৈরিতা শুরু হয়।
সেই বৈরিতা এখনও চলছে বলে অনেক রাজনৈতিক সমালোচকদের ধারণা।

উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায় , আহমেদিনেজাদ রাজনীতিতে আসেন ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পরপরই। ২০০৩ সালে মেয়র নির্বাচিত হন তেহরানের। এরপর ক্রমশ এগিয়ে যান তিনি। দুই বছর তেহরানের মেয়র থাকার পর ২০০৫ সালে ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে আহমাদিনেজাদ ক্ষমতায় আসেন। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরপরই তিনি তার অফিসে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনেন। প্রেসিডেন্ট ভবনের দরজা-জানালা খুলে দেয়া হয় সাধারণের জন্য। প্রেসিডেন্ট অফিসে সপ্তায় পাঁচ দিন সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সাধারণ ইরানিদের চিঠি গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েই প্রেসিডেন্ট ভবনের দামি কার্পেটগুলো তেহরাণের মসজিদে দান করে দেন। এর পরিবর্তে সাধারণ মানের কার্পেট বিছানো হয় প্রেসিডেন্ট ভবনে। প্রেসিডেন্ট ভবনের ভি.আই.পি অতিথিশালা ও বন্ধ করে দেয়া হয়। একটি সাধারণ ঘরেই ভি.আই.পি দের সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা রাখা হয়।

২০১৭ সালে আবার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করেন আহমেদিনেজাদ। তবে ইরানের ধর্মীয় নেতাদের গার্ডিয়ান পরিষদ তার প্রার্থীপদ প্রত্যাখ্যান করে। প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন আসফানদিয়ার রহিম মাশাইকে প্রথম ডেপুটি হিসাবে নিযুক্ত করেন আহমেদিনেজাদ।
তবে তার এই সিদ্ধান্ত পছন্দ হয়নি আয়াতুল্লা আলি খমিনির। ব্যক্তিগত এক চিঠিতে খমেনি বলেছিলেন, মাহমুদ আহমেদিনেজাদের পছন্দকে সঠিক বলে মনে করেন না তিনি। খমেনির এমন কর্তৃত্ব পছন্দ হয়নি আহমেদিনেজাদের। এরপর থেকেই দেশটির ধর্মীয় পরিষদের সাথে বৈরি সম্পর্ক চলছে তার।

৩ আগস্ট ২০১৩ ইরানের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে বিদায় নেয়ার আগেও ইতিহাস তৈরি করে গেলেন আহমেদি নেজাদ। ইরানের বিচার বিভাগের প্রধান আয়াতুল্লাহ সাদেক লারিজানির কাছে লেখা এক চিঠিতে আট বছরে অর্জিত সম্পদের হিসাব দিয়ে যান তিনি। যে হিসাবে দেখা যায়, ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর তার সম্পদে যে পরিবর্তন এসেছে, তা হলো- তিনি তার পুরোনো বাড়িটি পুনর্নিমাণ করেছেন। তবে বাড়িটি পুন র্নিমাণের জন্য তিনি ব্যাংক ও প্রেসিডেন্ট দপ্তরের ফান্ড থেকে ঋণ নেন। প্রেসিডেন্টের দপ্তরের ফান্ড ও ব্যাংক থেকে বাড়ি নির্মাণের জন্য অসংখ্য মানুষ ঋণ নিয়েছেন। প্রেসিডেন্টও সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে সেই ঋণ নিয়েছেন। ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট হিসেবে কোন ধরনের প্রভাব খাটাননি। একইসঙ্গে বাড়ি পুনর্নিমাণের ক্ষেত্রে তার স্ত্রী, সন্তান ও স্বজনরাও সহযোগিতা করেছেন। পুনর্নিমিত দুই তলা ভবনে চারটি ফ্লাট রয়েছে। ওই ভবনেই তিনি ও তার স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে বসবাস করবেন। যে জমিতে বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে, সেটার আয়তন মাত্র ১৭৫ বর্গমিটার। জমিটুকু বাবার কাছ থেকে পাওয়া।

আহমেদিনেজাদের বয়স যখন চার বছর তখন তার বাবা জীবিকার সন্ধানে পরিবারসহ তেহরানে চলে আসেন। সেখানেই আহমেদিনেজাদের স্কুল জীবন শুরু। ১৯৭৬ সালে আহমেদিনেজাদ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেন এবং তিনি ৪০০,০০০০ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১৩২তম স্থান দখল করেন। তিনি ইরান ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড টেকনোলোজিতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হন এবং ১৯৯৭ সালে তিনি ট্রান্সপর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্লানিংয়ে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন।

প্রেসিডেন্ট হবার আগে তার জীবনযাপন যেমনটি ছিল এখনও ঠিক তেমনটিই রয়েছে। আভিজাত্য তাকে কখনও স্পর্শ করতে পারে নি। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বিলাসবহুল এক বাড়ি তার জন্য অপেক্ষা করছিল কিন্তু সেই বাড়িকে তুচ্ছজ্ঞান করে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বস্তির সেই দুই রুমের ছোট্ট বাড়িতেই বসবাস করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে সরকারের কর্মকর্তাগণের অনুরোধে তিনি প্রেসিডেন্ট ভবনেই বসবাস করেন তিনি। তার নিজের বাড়িতে যে আসবাবপত্র রয়েছে তা আমাদের দেশের অনেক কেরানির বাড়িতেও এর চাইতে ভালো আসবাবপত্র রয়েছে। তার বাসায় কয়েকটি কাঠের চেয়ার ছাড়া আর কোনও আসবাবপত্র নেই। প্রেসিডেন্ট ভবনেও তিনি ফ্লোরে কার্পেটের উপর ঘুমাতেন।

ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলতে তার আছে তেহরানের বস্তিতে অবস্থিত ছোট্ট একটি বাড়ি, যা ৪০ বছর আগে তিনি তার বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। বাড়িটির নাম Peugeot 504. বেতন হিসেবে তিনি তেহরান ইউনিভার্সিটি থেকে মাত্র ২৫০ ইউ এস ডলার পান। তিনি রাষ্ট্রের প্রধান অথচ রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য রাষ্ট্র থেকে তিনি কোনও টাকা নেন না। তিনি ইউনিভার্সিটি থেকে প্রাপ্ত বেতনের টাকা দিয়ে সংসার পরিচালনা করেন।
১৯৫৬ সালে তেহরানের পাশে গার্মসার নামে একটি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি খুব সাধারণ জীবন যাপন করে চলেছেন এবং সবসময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তিনি তেহরান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্রাফিক অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট বিষয় এর উপর পি এইচ ডি করেছেন। আহমাদিনেজাদ- ১৯৭০ সালের শেষের দিকে “সারকর্ড” শহরের মেয়রের উপদেষ্টা হিসেবে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ১৯৮০ সালে তিনি আর্মিতে যোগদান করেন। এরপর তিনি তুর্কী বর্ডারের কাছে “মাকু” শহরের মেয়র পদে নিযুক্ত হন। ১৯৯০ এর শেষের দিকে তিনি “আরদাবিল” শহরের গভর্নর পদে নিযুক্ত হন। এরপর তিনি হার্ডলাইন রেভুলেশনারি গার্ডের বিশেষ বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব লাভ করেন। ২০০৩ সালে আহমাদিনেজাদ তেহরানের মেয়র পদে নির্বাচিত হন।