‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল-হামদা ওয়াননি’মাতা লাকা ওয়াল-মুলক, লা শারীকা লাক’- অর্থাৎ উপস্থিত ‘হে আমার আল্লাহ, উপস্থিত। উপস্থিত, তোমার কোনো অংশীদার নেই, উপস্থিত। নিশ্চয় সকল প্রশংসা ও নিয়ামত তোমার এবং রাজত্ব, তোমার কোনো অংশীদার নেই’- এ তালবিয়াহ উচ্চারণ ও মহান আল্লাহ তা‘আলার এককত্ব ও সার্বভৌমত্ব ঘোষণায় আকাশ-বাতাস মুখর করে ২০ লক্ষাধিক হজযাত্রী আজ মহানবী হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিদায় হজ্জের স্মৃতিবিজড়ি আরাফাত ময়দানে সমবেত ।
হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তার স্ত্রী-পুত্রকে জনমানব ও খাদ্যপানীয় বিহীন মরুপ্রান্তরে ছেড়ে যাওয়ার সময় দো‘আ করেছিলেন, ‘সুতরাং মানবের মধ্য থেকে একদলকে এর দিকে ধাবিত করে দাও এবং তাদেরকে ফলফলাদি দ্বারা আহার যোগাও’। এ দোয়ার প্রতিফলন দেখা যায় পবিত্র হজে। সমগ্র বিশ্বের মুসলিমরা পাগলপারা হয়ে ছুটে আসেন সউদী আরবের মক্কা নগরীর পানে। তাদের একটাই চাওয়া আল্লাহ তা‘আলা সন্তুষ্টি ও তার ক্ষমা।
গতরাতেই অধিকাংশ হজযাত্রীকে মোয়াল্লিমরা গাড়িতে করে নিয়ে আসেন আরাফাতে নির্ধারিত তাঁদের তাঁবুতে। অনেকে আজ সকালেও আসবেন। তাদের সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করতে হবে। এটাই মূলত হজ। আল্লাহর নবী মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আল-হাজ্জু আরাফাহ’। অর্থাৎ আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করাই হচ্ছে হজ। এখানে হজযাত্রীদের ফজর ছাড়াও যোহর ও আসর নামাজ আদায় করতে হবে।
সৌদি আরবে আজ ৯ জিলহজ্ব। গতকাল সারাদিন ও রাতে হাজীগণ মিনায় অবস্থান করেছেন। আজ ফজরের নামাজ মিনায় আদায় করার পর আরাফার ময়দানে হাজীগণ অবস্থান করবেন। এখানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত থাকতে হবে। সূর্যাস্তের পর মুযদালিফার উদ্দেশে আরাফার ময়দান ত্যাগ করবেন এবং মুযদালিফায় গিয়ে মাগরিব ও এশা’র নামাজ এশা’র ওয়াক্তে একত্রে পড়বেন এবং সমস্ত রাত অবস্থান করবেন। মিনায় জামারাতে নিক্ষেপ করার জন্য ৭০টি কংকর এখান থেকে সংগ্রহ করবেন। মুযদালিফায় ফজরের নামাজ পড়ে মিনার উদ্দেশে রওয়ানা হবেন।
পবিত্র মক্কা থেকে প্রায় ৯ মাইল পূর্বদিকে একটি পাহাড়ের নাম ‘জাবালুর রহমত’ বা রহমতের পাহাড়। এই পাহাড় সংলগ্ন দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রলম্বিত বিরাট প্রান্তরটি আরাফাত প্রান্তর নামে পরিচিত। পাহাড়টি মধ্যম আকৃতির এবং গ্রানাইট শিলা দ্বারা গঠিত। এর উচ্চতা প্রায় ২০০ ফুট। এই পাহাড়ের পূর্বদিকে প্রস্তরের সিঁড়ি রয়েছে। এর ষষ্ঠ ধাপের উচ্চতা বরাবর আগে একটি উন্নত মঞ্চ ও একটি মিম্বর ছিল। এই মিম্বরে দাঁড়িয়ে প্রতি বছর ৯ জিলহজ্ব আরাফার দিন ইমাম সাহেব খুতবা প্রদান করতেন। এখন আর সেই মঞ্চ ও মিম্বার নেই এবং এখান হতে হজ্বের খুতবাও প্রদান করা হয় না। বরং এখন খুতবা দেয়া হয় মসজিদে নামিরা হতে। সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি এ খুতবা প্রদান করবেন।
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রতি বছর মাত্র ১ দিন হাজীরা আরাফার ময়দানে অবস্থান করেন। তখন তাদের পরনে থাকে কাফনের কাপড়ের মতো সেলাইবিহীন সাদা দুই টুকরো কাপড়। হাজীরা আরাফাতের ময়দানে অবস্থানকালে উচ্চস্বরে লাব্বাইকা পাঠ করেন, যদি সম্ভব হয় হজ্বের খুতবা শ্রবণ করেন। যোহর ও আছরের নামাজ একত্রে এবং মাগরিব ও এশা’র নামাজও একত্রে আদায় করেন, আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করেন, কুরআন তেলাওয়াত, দরূদ ও সালাম প্রেরণ এবং ইহ ও পরকালের কল্যাণ কামনায় অবস্থানকালটি অতিবাহিত করেন।
আরাফাত প্রান্তরে অবস্থিত মসজিদে নামিরায় আজ পবিত্র হজের মূল খুতবা দেবেন মসজিদুল হারামের ইমাম ও খতিব শায়খ মাহের বিন হামাদ আল-মুআইকিলি। ২০ লাখেরও বেশি হাজির উদ্দেশে তিনি হজের খুতবা পেশ করবেন। মক্কা ও মদিনার পবিত্র দুই মসজিদের তত্ত্বাবধানকারী জেনারেল প্রেসিডেন্সি বিভাগ জানায়, এ বছর আরাফার ময়দান থেকে প্রচারিত হজের খুতবার অনুবাদ প্রচারিত হবে বিশ্বের ৫০টি ভাষায়। খাদেমুল হারামাইন শরীফাইন বাদশা সালমান বিন আব্দুল আজিজের তত্ত্বাবধায়নে এটিই এখন পর্যন্ত হজের খুতবা অনুবাদের সবথেকে বড় প্রজেক্ট। ৫০টি ভাষার মধ্যে অন্যতম হলো বাংলা, ফরাসি, ইংরেজি, ফার্সি, উর্দু, হাউসা, রুশ, তুর্কি, পাঞ্জাবি, চীনা, জার্মান, সুইডিশ, ইতালিয়ান, মালায়ালাম, বসনিয়ান, ফিলিপিনো, মালয়, সোয়াহিলি, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ এবং আমহারিক ইত্যাদি। আর এ অনুবাদ খুতবা চলাকালীন বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের অন্তত একশ’ কোটি মানুষ সরাসরি শুনতে পাবেন। আজ হজের খুতবার বাংলা অনুবাদের দায়িত্বে থাকবেন সউদী আরবে অধ্যয়নরত বাংলাদেশের চার শিক্ষার্থী। তারা হলেন– ড. খলীলুর রহমান, আ ফ ম ওয়াহিদুর রহমান মাক্কী, মুবিনুর রহমান ফারুক ও নাজমুস সাকিব। গত বছরও এই চার বাংলাদেশি হজের খুতবার অনুবাদের দায়িত্বে ছিল।
সূর্যাস্তের সাথে সাথে মাগরিব না আদায় করেই হাজী সাহেবদের যাত্রা শুরু হবে মুযদালিফার উদ্দেশ্যে। সেখানে যাওয়া মাত্র মাগরিব ও এশা এক আজানে, দুই ইকামাতে আদায় করবেন তারা। এরপর মুযদালিফায় মসজিদে মাশআরিল হারামের আশপাশে উন্মুক্ত আকাশের নিচে মাথা খোলা অবস্থায় রাত্রীযাপন করবেন হজযাত্রীরা। পরের দিনগুলোতে জামারাতে নিক্ষেপের জন্য এখান থেকেই পাথর সংগ্রহ করেন হজযাত্রীরা। এজন্য বিশেষ ধরনের ছোট ছোট পাথর ছড়িয়ে রাখা হয় পুরো মুযদালিফাজুড়ে।

১০ যিলহজ সূর্যোদয়ের পর আবার মিনায় ফিরে সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাওয়ার পূর্বে বড় জামারাতে ৭টি কঙ্কর নিক্ষেপ, কুরবানী সম্পন্ন করার পর মাথা মু-ন করে ইহরাম পরিত্যাগ করবেন হাজী সাহেবরা। সুযোগ বুঝে মক্কায় গিয়ে ফরজ তাওয়াফ করতে হবে ৩ দিনের মধ্যে। ১১ ও ১২ যিলহজও হাজী সাহেবদের সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাওয়ার পর ৩টি জামারাতে ৭টি করে মোট ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে। যারা সংক্ষেপ করতে চান ১২ যিলহজ সূর্যাস্তের পূর্বে মিনা ত্যাগ করবেন। নইলে ১৩ যিলহজ সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাওয়ার পর আবারও ৩টি জামারাতে ৭টি করে ২১টি কঙ্কর মেরে মিনা ত্যাগ করতে হবে।
পরিশেষে মক্কায় ফিরে বিদায়ের দিন বিদায়ী তাওয়াফের পূর্ব পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবে প্রতি ওয়াক্তের নামাজ ও যত বেশি সম্ভব তাওয়াফে সময় কাটাবেন হাজী সাহেবরা। আল্লাহ তা‘আলা সকলকে সহীহ তরিকায় হজ পালন করে মাসুম বা গুনাহমুক্ত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমীন।
বিশ্ব মুসলিমের সবচেয়ে বড় এই জনসমাগম চলাকালে তীব্র গরম থাকতে পারে বলে আগেই সতর্ক করেছিল সউদী আরব কর্তৃপক্ষ। চলমান তাপমাত্রা ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও পৌঁছাতে পারে বলে হজযাত্রীদের সতর্ক করেছে দেশটি। এর আগে সউদী আরবের আবহাওয়া অফিস জানিয়েছিল, হজের সময় মক্কার তাপমাত্রা ৪৫ থেকে ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকবে।
ইসরাইলের অবরোধে হজে যেতে পারলেন না গাজার ২৫০০ ফিলিস্তিনি : সউদী আরবের মক্কা নগরীতে শুরু হয়েছে পবিত্র হজের আনুষ্ঠানিকতা। সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লাখ লাখ মুসলমান এবার হজ পালনের সুযোগ পেয়েছেন। ফিলিস্তিনের অধিকৃত পশ্চিম তীর থেকেও হাজারও ফিলিস্তিনি গেছেন হজ পালন করতে। তবে এবার গাজা থেকে কোনো ফিলিস্তিনি হজে যেতে পারেননি। মূলত রাফা ক্রসিং ইসরাইলের দখলে থাকায় এবং ভূখ-টি অবরুদ্ধ করে রাখায় গাজার ২৫০০ মুসল্লি এবার হজ করতে যেতে পারেননি। গতকাল এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে তুরস্কের সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ড।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবরুদ্ধ গাজায় ইসরাইলের গণহত্যা এবং গাজাকে মিসরের সাথে সংযুক্তকারী রাফা ক্রসিংয়ে আক্রমণ ও দখলে নেওয়ার ফলে এই বছর ২৫০০ ফিলিস্তিনি হজ যাত্রা করতে পারেননি বলে অবরুদ্ধ এই ভূখ-টির এনডাউমেন্টস মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। বৃহস্পতিবার আনাদোলু এজেন্সিকে মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইকরামি আল-মুদাল্লাল বলেছেন, হজে যেতে বাধা সৃষ্টি করা ‘ধর্মীয় স্বাধীনতার স্পষ্ট লঙ্ঘন’। তিনি বলেন, ইসরাইলি আগ্রাসন ও যুদ্ধের কারণে মিসর ও সউদী আরবের মধ্যে দিয়ে পরিবহন চুক্তি স্বাক্ষর এবং মক্কা ও মদিনায় হাজিদের থাকার জায়গা বুকিংসহ হজের স্বাভাবিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে পারেনি মন্ত্রণালয়। আল-মুদাল্লাল জানান, ‘রাফা ক্রসিং বন্ধ করা এবং চলমান সংঘাত ২৫০০ গাজার মুসলিম ও সহগামী মিশনগুলোকে হজের জন্য ভ্রমণ করা থেকে বিরত রেখেছে। এই দলটি মোট ৬ হাজার ৬০০ ফিলিস্তিনি হজযাত্রীর ৩৮ শতাংশ।’ আল-মুদাল্লাল বলেছেন, মন্ত্রণালয় সউদী আরব এবং মিসরের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করছে। তারাও এটিকে ফিলিস্তিনি হজযাত্রীদের অধিকারের ‘স্পষ্ট লঙ্ঘন’ হিসাবে বর্ণনা করেছে।
অ্যাম্বুলেন্সে হজ পালন করবেন ১৮ জন : এবার অ্যাম্বুলেন্সে হজ পালন করছেন ১৮ ব্যক্তি। গতকাল গালফ নিউজের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অ্যাম্বুলেন্সে হজ করতে আসা যাত্রীরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসাপাতালে ভর্তি ছিলেন। তাদের জন্য ৩১টি অ্যাম্বুলেন্সে এ ব্যবস্থা করা হয়েছে। সউদী আরবের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অসুস্থদের জন্য এমন পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা বিভিন্ন দেশের নাগরিক। গালফ নিউজ জানিয়েছে, চিকিৎসাসেবা যাতে ব্যাহত না হয় সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। এসব অসুস্থ ব্যক্তিকে হজের পবিত্র স্থানগুলোতে নিয়ে যাওয়া হবে।
হাজিদের নিয়ে আসা এসব অ্যাম্বুলেন্সের প্রত্যেকটিতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এগুলোর পরিচালনায় স্বাস্থ্যবিষয়ক ১০৬ কর্মী রয়েছেন। এর মধ্যে নার্স, চিকিৎসক ও প্যারামেডিকরাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। অ্যাম্বুলেন্সে হজযাত্রীদের এ বহরে আরো রাখা হয়েছে রক্ষণাবেক্ষণ গাড়ি, অক্সিজেন সাপ্লাই, ভ্রাম্যমাণ ওয়ার্কশপ ও কুইক রেসপন্স টিম।