বিভিন্ন মহলে ব্যাপক সমালোচনার পর পাঠ্যপুস্তক সংশোধন সংক্রান্ত সমন্বয় কমিটি বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। গত শনিবার এই কমিটি বাতিল ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। তবে পাঠ্যপুস্তক সংশোধন এবং পরিমার্জনের দায়িত্বে থাকা বিতর্কিত ব্যক্তিরা এখনো বহাল তবিয়তে আছেন। সংশ্লিষ্ট মহলে প্রশ্ন উঠেছে সমালোচনা ঠেকাতে হঠাৎ করে সমন্বয় কমিটি বাতিল ঘোষণা কি কেবল আইওয়াশ মাত্র? কেননা পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের চাপিয়ে দেয়া বিতর্কিত কারিকুলামের পাঠ্যপুস্তক সংশোধন এবং পরিমার্জনের জন্য যাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে বিতর্কিত অনেকেই আছেন। এ ছাড়া নির্দিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ না হলেও অনেককে রাখা হয়েছে পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনের দায়িত্বে।
অপর দিকে বিতর্কের মুখে সমন্বয় কমিটি বাতিল ঘোষণা করা হলেও ওই কমিটির অধিকাংশ সদস্য এখনো পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন কাজে সরাসরি সম্পৃক্ত রয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেহেতু সমন্বয় কমিটি বাতিল করা হয়েছে, সেহেতু এই কমিটির কোনো সদস্যই আর পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন কিংবা সংশোধনের কাজে সম্পৃক্ত থাকার নৈতিক অধিকার রাখেন না। সূত্র জানিয়েছে, সমন্বয় কমিটি বাতিল ঘোষণা করা হলেও বিলুপ্ত ওই কমিটির কয়েকজন সদস্য এখনো পাঠ্যপুস্তক সংশোধনের মূল কমিটিতে রয়েছেন। এদের মধ্যে ড. মোহাম্মদ আজম, রাখাল রাহা, প্রফেসর কামরুল ইসলাম মামুন, ড. সামিনা লুৎফা অন্যতম, যারা বিলুপ্ত সমন্বয় কমিটিতে ছিলেন এখন মূল কমিটিতে রয়ে গেছেন। এ ছাড়া জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) মধ্যে যারা আগের কমিটিতে ছিলেন তারাও পদাধিকার বলে এই কমিটিরও সদস্য। এনসিটিবির সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন- চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান, প্রফেসর রবিউল কবীর চৌধুরী সদস্য (শিক্ষাক্রম, মাধ্যমিক), অধ্যাপক এ এফ এম সারোয়ার জাহান সদস্য (শিক্ষাক্রম প্রাথমিক)। অপর দুই সদস্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব পদমর্যাদার।
এদিকে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিনামূল্যের পাঠ্যবই সংশোধন ও পরিমার্জনের লক্ষ্যে গঠিত সমন্বয় কমিটি বাতিল করলেও নতুন করে আর কোনো কমিটি গঠন করা হবে না। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্রের তথ্য মতে, এরই মধ্যে পাঠ্যবই সংশোধনের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। সম্পূর্ণ কাজ শেষে সংশ্লিষ্টরা এনসিটিবির কাছে তা হস্তান্তর করবেন। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংশোধিত বইয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন, পরিবর্ধন কিংবা সংশোধনের জন্য কারা কমিটির সদস্য হবেন তার নির্দিষ্ট একটি কাঠামো আইন ধারা স্বীকৃত। কিন্তু এবার পাঠ্যপুস্তক সংশোধনে যে কমিটি গঠন করা হয়েছে সেখানে সেই আইনের বা বিধির কোনো তোয়াক্কাই করা হয়নি। ফলে যাকে ইচ্ছা তাকে নিয়েই এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিশেষ করে বিষয়ভিত্তিক পাঠ্যবই সংশোধন করতে কমিটিতে যাদেরকে নেয়া হয়েছে তারাও কেউ ওই বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নন।
এনসিটিবির এক কর্মকর্তা গতকাল জানান, বিষয়ভিত্তিক বইয়ের সংশোধনের জন্য যাদেরকে নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে, তাদের অনেকেই ওই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন। উদাহরণ হিসেবে ওই কর্মকর্তা বলেন, মাধ্যমিক পর্যায়ের ইসলাম শিক্ষা বিষয়ের সংশোধন করতে তিনজনকে দায়িত্ব দেয়া হলেও একজন ছাড়া বাকি দু’জনই আলেম সমাজের প্রতিনিধি নন। এ ছাড়া এখানে এমন একজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যিনি ইসলাম শিক্ষায় উচ্চতর পর্যায়ে পড়াশোনাই করেননি। অন্য একটি সূত্র জানায়, ইসলাম শিক্ষা বিষয়ের বইয়ের সংশোধন কিংবা পরিমার্জনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ইংরেজি সাহিত্যের একজন শিক্ষাবিদকে। মাধ্যমিকের ইসলাম ধর্ম বইটি সংশোধনের দায়িত্ব পেয়েছেন আবু সাঈদ খান। তিনি ইসলাম শিক্ষা বিষয়ের ডিগ্রিধারী কোনো আলেম বা মাওলানা পর্যায়ের কেউ নন। তিনি ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করেছেন। এ বিষয়ে নয়া দিগন্ত থেকে তার সাথে কথা বলতে চাইলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে প্রথমে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। তবে পরে তিনি স্বীকার করেন যে, তিনি ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করেছেন। তাহলে কিভাবে তিনি ইসলাম ধর্ম বিষয়ের বইটি সংশোধনের কাজ করছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি আর কোনো কথা বলতে রাজি নই। এই কমিটির অপর একজন সদস্য রয়েছেন যিনি একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের সাব এডিটর।
একই অভিযোগ রয়েছে অন্য অনেক বিষয়ের জন্যও। বিভিন্ন বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং উচ্চ ডিগ্রিধারী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে বিষয়ভিত্তিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। অথচ মাধ্যমিক পর্যায়ের কোনো বইয়ের সংশোধনের জন্য মাধ্যমিকের ক্লাস টিচার বা সম পর্যায়ের শিক্ষকদের সমন্বয়েই কমিটি গঠন করার কথা। শিক্ষায় উঁচুমাপের পণ্ডিত ব্যক্তিদের দ্বারা মাধ্যমিকের বই সংশোধন বা পরিমার্জন করা হলে সেগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগী না হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন কেউ কেউ।
সমন্বয় কমিটি বাতিল এবং মূল কমিটিতে বিতর্কিত ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করে কাজ করা প্রসঙ্গে এনসিটিবির চেয়ারম্যান বলেন, আমরা এখন একটি অস্বাভাবিক পরিবেশ এবং পরিস্থিতি পাড়ি দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেকোনোভাবে আমাদের কাজ করে নতুন বছরে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিতে হবে। শিক্ষা উপদেষ্টা নিজেও সামনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে আমাদের কাজ করতে নিয়মিতভাবে তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন। আমরা সেভাবেই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।