সংবিধান পুনর্লিখনের ক্ষেত্রে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হল, এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা। সাধারণত রাজনৈতিক বিপ্লব, যুদ্ধ, গণ-অভ্যুত্থান বা সরকার কাঠামোর বড় ধরনের পরিবর্তনে সংবিধান পুনর্লিখনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। প্রতিটি দেশ বা জাতির সংবিধান মূলত তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক আকাক্সক্ষার দলিল। স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার সংস্থা গঠন , নাগরিকদের কাছে জবাবদিহি , হ্যা না জাতীয় সংসদের মাধ্যমে দেখা যায় আগেই আইন করে দলীয় এমপিদের আলোচনার পথে দলের বিরুদ্ধে কথা না বলার জন্য আইন করে রাখা হয়।
জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা ভবিষ্যতে যেন যেকোন সরকার সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে পারে পারে না সেটা স্পষ্ট থাকতে হবে । তাহা দ্বারা উহা দ্বারা বিধান কম করে স্পষ্ট আইনের ব্যাখ্যা সংযুক্ত থাকতে হবে এমন কল্যাণ মূলক সংবিধান হলো রাষ্ট্রের সকল স্তরের জন্য উপযুক্ত।সংবিধানে সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার এবং সুরক্ষা নিশ্চিত এই জাতীয় ধারা যুক্ত থাকলে নাগরিকদের মধ্যে পার্থক্য ও ঐক্যের মধ্যে ফাটল তৈরী হয়।
স্বাধীনতার পর গত ৫৩ বছরে সংবিধান সতেরোবার সংশোধন করা হয়েছে এবং এসব সংশোধনের মধ্যে দুটি ব্যতীত (দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ) বাকি সবই করা হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের বা ব্যক্তি/ব্যক্তিবর্গের সুবিধার্থে, জাতীয় স্বার্থে নয়। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের এ আন্দোলনে কখনো কোনোভাবে সংবিধান সংশোধন বা বাতিল বা পুনর্লিখনের কোনো দাবি বা প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে বলে মনে পড়ে না। এ দাবি উঠেছে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে। অনেকে এর মধ্যে ও বিতর্কিত ব্যক্তি চিহ্নিত করে বেশ সমালোচনা করছেন টকশো ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
১৯ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘গণতান্ত্রিক শাসনে উত্তরণের জন্য সাংবিধানিক সংস্কার’ শীর্ষক পরামর্শমূলক সেমিনারে এসব মতামত উঠে আসে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পলিসি স্টাডিজ (বিআইপিএস) এ সেমিনারের আয়োজন করে। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আইনজীবী, সংবাদপত্রের সম্পাদক, আইনের শিক্ষকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি সেমিনারে বক্তৃতা করেন।
এতে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. আবদুল মতিন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফসল এবার যাতে বেহাত না হয়, সে বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার এই আন্দোলনকে যে নামেই ডাকেন, এটি একটি সফল আন্দোলন। যে কারণে মানুষের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো জেঁকে বসা স্বৈরশাসককে দেশ থেকে পালাতে হলো। এই যে সরানো হলো, এটি হলো সাংবিধানিক অধিকার। সব অধিকার লেখা থাকে না। এ বিষয়ে তিনি বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও উদাহরণ তুলে ধরেন।
বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয় সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের কাছে ফিরে আসা অতীব জরুরি।
১৯৭২ সালে প্রণীত মূল সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ছিল। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে অর্পণ করা হয়। পরে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয় সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের কাছে। মার্শাল প্রক্লেমেশনে করা পঞ্চম সংশোধনীতে এক্ষেত্রে ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন আনা হয়েছিল।
পরে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ষোড়শ সংশোধনীতে সেটা বাতিল করে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হয় সংসদকে। বিলটি পাসের পর একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। বিষয়টি নিয়ে আদালতে এখনো বিচারাধীন। কিন্তু যদি বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা ফিরলো সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে না দেয়া হয় , তাহলে আদালতের উপর ক্ষমতাসীনদের চাপ স্পষ্টই থাকবে। আশা করা যায় আদালত উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’র হাতে ফিরিয়ে দেবে।
শাসনতন্ত্রের সংস্কার বলেন, পুনর্লিখন বলেন, যা-ই বলেন, এটির অধিকার কার ?
সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ২ থেকে ৮ পর্যন্ত বিধান ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যম বাতিল করা হয়েছিল। বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিল আনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। সে বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর বিলটি সংসদে পাস হয়।
বিষয়টি নিয়ে আইন জ্ঞানীদের মধ্যে পক্ষ বিপক্ষ হয়ে বিবৃতি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। পরে এর বৈধতা নিয়ে হাইকোর্টে রিট করেন নয়জন আইনজীবী। ২০১৬ সালের ৫ মে হাইকোর্টের তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন।
এই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। একই বছরের ৩ জুলাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার (এস কে সিনহা) নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সর্বসম্মতিতে আপিল খারিজ করে রায় দেন। ফলে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকে।
আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালের ১ আগস্ট। বহুল বিতর্কিত বিচারপতি সিনহা তাঁর লেখা রায়ে গণতন্ত্র, রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, সুশাসন, দুর্নীতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দেন। রায়ে তাঁর বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগের সরকারের মন্ত্রী, দলীয় নেতা ও দলটির সমর্থক আইনজীবীরা। তাঁরা প্রধান বিচারপতি সিনহার পদত্যাগের দাবি তোলেন। এর মধ্যে আরেক বিতর্কিত বিচারপতির কাহিনী ও একাট্টা হয়ে যায়।
একপর্যায়ে বিচারপতি সিনহা ছুটি নিয়ে বিদেশে চলে যান। তাঁকে অসুস্থতার কথা বলে ছুটিতে যেতে বাধ্য করা হয়েছে বলেও তখন আলোচনা ছিল। যদিও ২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর বিদেশে যাওয়ার প্রাক্কালে তিনি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, তিনি অসুস্থ নন, ক্ষমতাসীনদের সমালোচনায় তিনি বিব্রত। পরে অবশ্য বিদেশে থাকা অবস্থায়ই তিনি পদত্যাগ করেন। আর দেশে ফেরেননি। এর পরের কাহিনী অনেক লম্বা।
বিভিন্ন দেশে বিপ্লবের পর সম্পূর্ণভাবে নতুন সংবিধান প্রণীত হয়
ভেনেজুয়েলা,ইকুয়েডর , কেনিয়া, ফিলিপাইন, চীন, ইরান, কিউবাসহ বিভিন্ন দেশে বিপ্লবের পর সম্পূর্ণভাবে নতুন সংবিধান প্রণীত হয়। কারণ এসব বিপ্লবের মাধ্যমে পূর্বের শাসনব্যবস্থাকে পুরোপুরিভাবে উপড়ে ফেলা হয়। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে ৩৭০ বছরের জার শাসনের অবসান ঘটে এবং বলশেভিকরা ক্ষমতা দখল করে বিশ্বের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে।ফরাসি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু হয় একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে। পরবর্তীকালে দেড়শ বছরে নানাভাবে শাসন ক্ষমতার পটপরিবর্তনে তাদের সংবিধানও কয়েকবার পরিবর্তিত হয়। সর্বশেষ ১৯৫৮ সালে নতুনভাবে বর্তমান সংবিধান প্রণীত হয় এবং এর মাধ্যমে সেখানে পঞ্চম প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।সম্পূর্ণভাবে নতুন সংবিধান প্রণীত বিষয়ে এমন শতাধিক উদাহরণ আছে।
নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার পৃথক্করণের (সেপারেশন অব পাওয়ার) নিয়ে আলোচিত ধারা উপধারা সাজাতে হবে। প্রধান বিচারপতি নিয়োগে বার বার হোঁচট খেয়েছে বাংলাদেশ। কারণ সেখানে সিনিয়রিটি মণ হয় নাই। সহজ সরল ভাবেই বলা যায় প্রধান মন্ত্রীর খেয়াল খুশিতে প্রধান বিচারপতি বানানো হয় , শুধু নামকাওয়াস্তে রাষ্ট্রপতি বাকি কাজগুলো সম্পন্ন করেন।
২০১৪ সালে একটি নির্বাচন হলো, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো না, ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বতায় সংসদ সদস্য হয়ে গেলেন। এরপর ২০১৮ সালে দেখা গেল রাতের বেলায় ভোট হয়ে গেল। আর ২০২৪ সালে দেখা গেল ‘ডামি নির্বাচন’। বাংলাদেশের সংবিধান তাহলে তখন কি ভূমিকা রেখেছে সেটা বিজ্ঞ মহলের কাছে সব সময় প্রশ্ন। সভা সেমিনারে বিষিয়টি আলোচিত।
কিছু জ্ঞানী ব্যক্তি বলার চেষ্টা করছেন , বর্তমানে যাঁরা সংবিধান পুনর্লিখন বা নতুন সংবিধান লিখতে চাচ্ছেন, তা তাঁদের এখতিয়ারে নেই। তবে সংবিধান সংশোধন হতে পারে। তাহলে যেহেতু এখতিয়ারের প্রশ্ন আসে ঠিক তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ আমজনতার কিছু বক্তব্য এসেই যায়।
যেমন তখন তারা প্রশ্নের তীর ছুড়ে দিয়ে বলেন , পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চলের ১৬৭ জন সদস্য কর্তৃক অনুমোদিত কতটা বৈধ বা তাঁদের এখতিয়ার ছিল ?
পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চলের ১৬৭ জন সদস্য কর্তৃক অনুমোদিত বাংলাদেশের সংবিধান
জেহসান ইসলাম , অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব , ১৮ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে লিখেছেন , আমরা যদি আমাদের ইতিহাস ১৯৬৬ থেকে শুরু করি, তাহলে দেখা যায়, ওই সালে আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপনের মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) জনগণকে আকৃষ্ট করতে সফল হয়েছে। কারণ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এর ভিত্তিতে তারা পাকিস্তানের ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জনগণের ম্যান্ডেট পায়; কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর না করার কারণে পরিস্থিতি দুঃখজনক অধ্যায়ের দিকে মোড় নেয় এবং ১৯৭১ সালের ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু একথা মানতে হবে, ছয় দফা ছিল অখণ্ড পাকিস্তানের কাঠামোতে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য অধিকতর স্বায়ত্তশাসন অর্জন, স্বাধীনতা নয়। ফলে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক আদর্শ বা এজেন্ডা কী হবে, তার জন্য আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনেরই কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না; যা হয়েছে সবই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর। স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল সরকার গঠন এবং ১৭ এপ্রিল ওই সরকারের শপথ গ্রহণের মাধ্যমে। ১০ এপ্রিল সরকার গঠনের আগে স্বাধীন বাংলাদেশের একটি ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করা হয় এবং তা পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চলের ১৬৭ জন সদস্য কর্তৃক অনুমোদিত হয়। বলা যায়, এ ঘোষণাপত্রই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের প্রাথমিক ভিত্তি।