মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট-নির্বাচিত হওয়ার পর নতুন করে প্রায় চার হাজার পদে নিয়োগ দিতে হয়।সেই তালিকায় মন্ত্রীসভার সদস্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা পর্যন্ত নির্ধারণ করেন তিনি।ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ার পর একে একে তার প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে যারা থাকবেন তাদের নাম ঘোষণা করছেন।
ইতোমধ্যেই তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে পিট হেগসেথ ও হোমল্যান্ড সিকিউরিটির (স্বরাষ্ট্র) জন্য ক্রিস্টি নোয়েমের নাম জানিয়েছেন।পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে মার্কো রুবিওকে নিয়োগ দেয়া হতে পারে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে বিবিসি’র সহযোগী গণমাধ্যম সিবিএস।
আগামী ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন ট্রাম্প। এর আগেই ট্রাম্প তাঁর প্রশাসনে কাকে কাকে নিয়োগ দিচ্ছেন, তা নিয়ে অনেক জল্পনাকল্পনা চলছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, প্রথমবারের মতো এবারও অনুগতদের নিয়েই প্রশাসন সাজাবেন ট্রাম্প।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল সূত্রের বরাতে মার্কিন সংবাদ মাধ্যমে বলা হয়েছে , ফ্লোরিডার কট্টরপন্থী সিনেটর এবং চীনের সমালোচক হিসেবে পরিচিত মাইকেল ওয়ালৎসকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। ট্রাম্পের প্রশাসনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর (হোমল্যান্ড সিকিউরিটি) দায়িত্ব পাচ্ছেন সাউথ ডাকোটা অঙ্গরাজ্যের গভর্নর ক্রিস্টি নোয়েম। বিষয়টি সম্পর্কে জানে, এমন দুটি সূত্র গতকালে রয়টার্সকে এ তথ্য জানিয়েছে।
নিউইয়র্কের কংগ্রেস উইম্যান এলিস স্টেফানিককে জাতিসংঘের দূত হিসেবে বেছে নিয়েছেন ট্রাম্প। পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থার (ইপিও) প্রধান হচ্ছেন ট্রাম্পের দীর্ঘদিনের মিত্র লি জেলডিন। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ফ্লোরিডার সিনেটর মার্কো রুবিওকে নিয়োগ দিতে যাচ্ছেন ট্রাম্প।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যাপকভাবে সক্রিয় ছিলেন শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক।অনুদানও দিয়েছেন প্রায় ২০ কোটি ডলার।অবশ্য ট্রাম্প জেতার পরে মাস্কের সম্পদ বাড়ছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার।বিজয়ী ভাষণে বিশেষভাবে মাস্কের কথা বলেছেন সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।তার ভূঁয়সী প্রশংসাও করেন।আভাস পাওয়া যাচ্ছিল, আগামী প্রশাসনে টেসলার মালিককে ইলনকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে দেখা যেতে পারে।
অবশেষে ডোনাল্ড ট্রাম্প জানালেন, ইলন মাস্ক ও সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বিবেক রামাস্বামীকে নতুন একটি দপ্তরের দায়িত্ব দিতে যাচ্ছেন তিনি।দপ্তরটির নাম হবে ‘ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি’।আগে থেকেই আলোচনায় ছিল যে,ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইলন মাস্ক সরকারি কর্মকাণ্ডে দক্ষতা বৃদ্ধির দিকে মনোনিবেশ করছেন।ট্রাম্প তার বিবৃতিতে লিখেছেন, “এই দু’জন অসাধারণ আমেরিকান মিলে সরকারি আমলাতন্ত্রের অবসান ঘটানোর পথ তৈরি করবেন।”
“বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের বাড়াবাড়ি ও অর্থের অপচয় রোধ এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠনে কাজ করবেন তারা।যা, ‘সেইভ আমেরিকা’ উদ্যোগের জন্য অপরিহার্য,” যোগ করেন তিনি।ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এজেন্সির সংক্ষিপ্ত রূপ, ডিওজিই বা ডোজ।এর সঙ্গে ক্রিপ্টোকারেন্সি ডোজকয়েনের নামের মিল লক্ষণীয়।
মাস্ক ডোজকয়েনকে “দ্য পিপল’স্ ক্রিপ্টো” বলে আখ্যায়িত করেছেন।দপ্তরের দায়িত্ব পাওয়া অপর রিপাবলিকান বিবেক রামাস্বামী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে ছিলেন। পরবর্তীতে অবশ্য ট্রাম্পের পক্ষে সোচ্চার থেকেছেন তিনি।
মাস্ক ট্রাম্পের প্রশাসনে কী করবেন?
সরকারি দক্ষতা বিভাগ ঠিক কী কী কাজ করবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।কিন্তু,এটিকে সরকারের গতানুগতিক কাঠামোর বাইরের একটি প্রতিষ্ঠান বলেই ধারণা করা হচ্ছে।ট্রাম্পের বিবৃতিতে বলা হয়েছে,সরকারের বাইরে থেকে পরামর্শ এবং নির্দেশনা দেবে ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি।এর লক্ষ্য, সরকারের মধ্যে “উদ্যোক্তার দৃষ্টিভঙ্গি” নিয়ে আসা।
“এটা হবে আমাদের সময়ের ‘দ্য মানহাটন প্রজেক্ট’,”যোগ করেন ট্রাম্প।ম্যানহাটন প্রজেক্টের মাধ্যমে আমেরিকার প্রথম পারমাণবিক বোমা তৈরি করা হয়েছিল।২০২৬ সালের ৪ই জুলাই নাগাদ এ দপ্তরের কাজ সমাপ্ত করার সময়সীমা নির্ধারণ করেছেন তিনি।জুলাই ৪ যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস।ট্রাম্পের পক্ষ থেকে ঘোষণা আসার পর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মাস্ক ও রামাস্বামী।দু’জনই একরকম হুঁশিয়ারি জানিয়েছেন তাদের বক্তব্যে।
“এটা সিস্টেমের মধ্যে একটা শকওয়েভ হিসেবে আবির্ভূত হবে।সেইসঙ্গে সরকারি অপচয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে কারো জন্যই কাল হয়ে দাঁড়াবে,” নিজের মালিকানাধীন সামাজিক মাধ্যম এক্সের এক পোস্টের জবাবে লিখেছেন ইলন মাস্ক।রামাস্বামীও তার এক্স অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, “আমরা কোনো ভদ্রতা দেখাতে যাবো না।”
ট্রাম্পেকে সমর্থন জানিয়ে যা করেছিলেন মাস্ক
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী এই ব্যক্তি চলতি বছরের শুরুতে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির পক্ষে তার সমর্থন ঘোষণা করেছিলেন।এর আগে, ২০২২ সালে অবশ্য তিনি ট্রাম্পের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের পতনের ইঙ্গিত দিয়ে মন্তব্য করেছিলেন “ট্রাম্পের টুপি খুলে ঝুলিয়ে রাখা এবং সূর্যাস্তের দিকে যাত্রা করার সময় এসেছে।”তবে সময় বদলেছে।
প্রযুক্তি বিলিয়নিয়ার থেকে ট্রাম্পের অন্যতম দৃশ্যমান এবং সুপরিচিত সমর্থক হিসাবে প্রকাশ্যে এসেছেন ইলন মাস্ক।চলতি বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন করতে ‘আমেরিকা পিএসি’ নামে একটা রাজনৈতিক অ্যাকশন কমিটি গঠন করেছিলেন তিনি।
এই নির্বাচনি চক্রে সেখানে ২০ কোটি ডলার অনুদান দিয়েছেন মাস্ক।টেসলা ও স্পেসএক্সের প্রধান এবং সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্ম এক্স (সাবেক টুইটারের)-এর মালিক ইলন মাস্ক। ভোটার রেজিস্ট্রেশন অভিযান (ভোটার নিবন্ধন অভিযান) চালু করেছিলেন।
আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে রিপাবলিকান হিসাবে রেজিস্ট্রেশন করেন তিনি।এরপর থেকেই তাকে অবৈধ অভিবাসন এবং ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকারসহ একাধিক বিষয় নিয়ে সোচ্চার হতে দেখা গিয়েছে।
১৩ই জুলাই পেনসিলভানিয়ার বাটলারে হত্যা প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাম্পকে প্রথম সমর্থন দেয়ার পর থেকে, ইলন মাস্ক ট্রাম্পের প্রচারাভিযানের একটি অংশ হয়ে ওঠেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলোর একটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ‘অবৈধ অভিবাসী সমস্যা সমাধান। নির্বাচনী প্রচারণায় বলেছেন, ক্ষমতা গ্রহণের দিনই দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ‘অবৈধ অভিবাসী বিদায় অপারেশন’ পরিচালনা করবেন। সেই প্রতিশ্রুতি মোতাবেক সাবেক পুলিশ ও অভিবাসন কর্মকর্তা টম হোমানকে সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব দিচ্ছেন নব-নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট। পাশাপাশি, অভিবাসন বিষয়ক হক স্টিফেন মিলারকে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ হিসেবে নিয়োগ দিতে যাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যদিও ট্রাম্প সরাসরি আনুষ্ঠানিকভাবে তার মনোনয়ন ঘোষণা করেননি।
সোমবার নবনির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এক পোস্টে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এবং মিলারকে নিয়োগের জন্য ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এটি প্রেসিডেন্টের আরেকটি চমৎকার পছন্দ। মিলার ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের সময় পলিসি উপদেষ্টা এবং ভাষণ লেখক হিসেবে কাজ করেছিলেন। তার প্রচারের সময়ও এই ভূমিকা পালন করেছেন, প্রায়ই ট্রাম্পের র্যালিতে তার সঙ্গে সফর করেছেন। গত সপ্তাহে ট্রাম্প ঘোষণা করেন যে তিনি তার প্রধান প্রচারণা পরিচালক সুসান উইলেসকে চিফ অব স্টাফ হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছেন। রোববার রাতে ট্রাম্প বলেন, তিনি টম হোমানকে সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব দিচ্ছেন, যিনি বহিষ্কার এবং সীমান্ত নিরাপত্তা কঠোর করার দায়িত্বে থাকবেন। মিলার এবং হোমান একসঙ্গে কাজ করবেন এমন কিছু আশা করা হচ্ছে, যা ট্রাম্প তার প্রচারণার কেন্দ্রে রেখেছিলেনÑঅবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া।
তাদের নিয়োগ ট্রাম্পের অভিবাসন বিষয়ে যে গুরুত্ব দেন, তার একটি ইঙ্গিত হিসেবেও দেখা যাচ্ছে। মিলার মিডিয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, অবৈধ অভিবাসীদের আটক করে শিবিরে রাখা উচিত, যতক্ষণ না তারা দেশে ফেরত চলে যায়। গত বছর নিউইয়র্ক টাইমসে এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেছেন, আমরা ফেডারেল ক্ষমতার বিশাল সম্পদ ব্যবহার করে অভিবাসন বিষয়ে সবচেয়ে বড় অভিযান শুরু করব। মিলারের একটি বিতর্কিত প্রস্তাব হলো জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের অধিকার শেষ করা, অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী সব শিশু, তাদের পিতামাতার অবস্থান যাই হোক না কেন, নাগরিকত্ব পাওয়ার যে অধিকার রাখেন, তা বাতিল করা। এই প্রস্তাব ট্রাম্পও সমর্থন করেছেন। মিলারের এই নিয়োগের জন্য সিনেটের অনুমোদনের প্রয়োজন নেই। মিলার তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন কনজারভেটিভ রিপাবলিকান কংগ্রেসওম্যান মিচেল বাচম্যানের সহকর্মী হিসেবে এবং পরবর্তীতে অ্যাটর্নি জেনারেল জেফ সেশনের সঙ্গে কাজ করেছেন, তারপর তিনি ট্রাম্পের ২০১৬ সালের নির্বাচনি প্রচারণায় যোগ দেন।
এদিকে, হোমানকে ‘সীমান্ত সম্রাট’ (বর্ডার জার) নামে অভিহিত করেন ট্রাম্প। এর আগেও ট্রাম্প প্রশাসনে ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস) এজেন্সির পরিচালক হিসেবে অভিবাসী নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে ছিলেন হোমান। এর আগে ওবামা প্রশাসনেও তিনি আইসের নির্বাহী সহযোগী পরিচালক ছিলেন। ট্রাম্পের নতুন এই যোদ্ধা ‘ঝেঁটিয়ে’ বিদায় করবেন অবৈধদের, এমনটাই ভাবছেন বিশ্লেষকরা। নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্পের কথাবার্তাতেও এ ধরনের মনোভাবের প্রকাশ পেয়েছে। নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে দেয়া এক বার্তায় ট্রাম্প লিখেন, ‘আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি সাবেক আইস পরিচালক ও অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের কিংবদন্তি টম হোমান ট্রাম্প প্রশাসনে যোগ দেবেন। এই ‘সীমান্ত সম্রাটের’ হাতেই দেশের সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব তুলে দিচ্ছি।’ ‘আমি টমকে অনেকদিন ধরে চিনি। সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে রাখায় তারচেয়ে ভালো কেউ নেই,’ যোগ করেন ট্রাম্প।
বার্তায় ট্রাম্প নিশ্চিত করেন, ‘অবৈধ অভিবাসীদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর’ দায়িত্বে থাকবেন হোমান। ১৭৯৮ সালের ‘এলিয়েন শত্রু আইন’ অনুযায়ী অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা করছেন ট্রাম। এই আইন অনুযায়ী, শত্রু দেশগুলো থেকে আসা লোকজনকে গ্রেপ্তার করে ফেরত পাঠানোর এখতিয়ার রাখে সরকার। এই আইনে পাওয়া ক্ষমতাবলে ‘অপারেশন অরোরা’ নামে একটি অভিযান পরিচালনা করবে ট্রাম্প প্রশাসন। এই অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেয়া লাখো অভিবাসীকে দেশ থেকে বিদায় করার পরিকল্পনা করছেন তারা। যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে এক কোটিরও বেশি অবৈধ অভিবাসী বসবাস করছে। সূত্র : ওয়াশিংটন পোস্ট।