আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিবিদরা নাগরিকদের প্রজা মনে করেন। আমলাতন্ত্র ও রাষ্ট্রের কর্মচারীদের , বিচারতন্ত্রকে , রাজনীতিকদের জবাবদিহিতার আওতায় না আসবেন ততক্ষণ পর্যন্ত জনগণকে প্রজা হয়েই থাকতে হবে। সংসদের নামে জমিদারতন্ত্র চলতে দেয়া যাবে না। সংবিধান জনগণের জন্য এবং জনগণের চাহিদার বাহিরে কোন সংবিধান রচিত হতে পারে না বা চাপিয়ে দেয়া যাবে না।
সংখ্যালঘু নয়, ভিন্ন মত ও ভিন্ন গোষ্ঠীর নিয়ে আলাদা মায়াকান্নার কারণে মূলত সংবিধানই জটিলতার জন্ম দেয়। নারী , ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সমপ্রদায় ও তৃতীয় লিঙ্গের নাগরিকদের জন্য সংরক্ষিত আইন রচিত করে জাতির মধ্যে আলাদা একটি শ্রেণীর জন্ম দেয়া হয়। মূলত সকল নাগরিকের সমান অধিকার থাকবে। এখানে নারী , ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সমপ্রদায় ও তৃতীয় লিঙ্গের বিশেষ শ্রেণী তৈরী করে নাগরিকদের অধিকারের মধ্যে বৈষম্যই জন্ম দেয়া হয়।
সংসদকে যেন ব্যক্তি বন্দনা এবং তোষামোদের ক্ষেত্র তৈরী না হয় তার জন্য কঠিন আইন তৈরী করা উচিত। কারণ জনগণের টাকায় প্রতিটি মিনিট খরচের দায়ভার তো জনগণের উপর চালিয়ে দেয়া হয়। জাতীয় পরিষদ হবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ও আইনপ্রণয়ন সভা। যেখানে অর্থনৈতিক নীতি, জাতীয় নিরাপত্তা নীতি, বৈদেশিক সম্পর্কের নীতি এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি নিয়ে আলোচনা হবে এবং সময়ের চাহিদার উপর নির্ভর করে আইন রচিত হবে।
জাতীয় পরিষদ এবং সংসদ নিজেদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা নিজেরাই বৃদ্ধি করতে পারবেন না এমন আইন সংবিধানেই লিপিবদ্ধ করতে হবে।
জনগণের অধিকার বাস্তবায়ন ও রক্ষার জন্য আদালতের অনুমতি ব্যতিরেকে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন দণ্ড হতে পারে-এমন অপরাধে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে আদালতের অনুমতি ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। তবে গুরুতর অপরাধ সংঘটিত করবে-এমন সন্দেহজনক কোনো ব্যক্তি ছাড়া কাউকে আটক রাখা যাবে না। তবে সন্দেহের উপযুক্ত ভিত্তি থাকতে হবে , যদি না থাকে তাহলে গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিলকারী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের বিষয়ে জামিন অযোগ্য আইন করতে হবে । আদালতে হাজিরের সময় প্রতিবেদনে উপযুক্ত কারণগুলো উল্লেখ করতে হবে। অহেতুক হয়রানি করা যাবে না। অহেতুক হয়রানির সাথে জড়িতদের আমলাতন্তের জটিলতার ফাঁকফোকর দিয়ে রক্ষা করা যাবে না এমন ধারা সংবিধানেই থাকতে হবে।
জাতীয় সংসদের নির্বাচনের সাথে আলাদা ব্যালট দিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করা হলে , তখন দলীয় অনুকম্পায় কোন রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না। সরাসরি জনগণ তাদের রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে পারবেন।
উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ দিবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন। প্রয়োজনে সংসদে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারে। প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারী , প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ভোটের অধিকার নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র করলে কিংবা ভোট প্রয়োগে বাধা সৃষ্টি করলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এমন ধারা সংযুক্ত করা জরুরি। প্রেসিডেন্টের দণ্ড মওকুফের কোনো স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা থাকবে না। প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশের উপর প্রেসিডেন্টের কার্যক্ষমতা নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
কথা বলার অধিকার ক্ষুন্ন সেই ৭০ অনুচ্ছেদের পরিবর্তন আন্তে হবে। সরকারের প্রতি আস্থা-অনাস্থা ভোট এবং অর্থ বিল ছাড়া ও সকল কিছুতে স্বাধীনভাবে মত প্রদান ও ভোট দেয়ার অধিকার আইন সভার সকল সদস্যদের থাকতে হবে।
নারীদের জন্য আসন বরাদ্দ রাখার আইনটিও পরিবর্তন করা উচিত। নারীরা এখনো সব দিকে এগিয়ে। তাই দলীয় করুনার সংসদ সদস্য না হয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে এলে তাদের নিজ জনসমর্থন জনগণ যাচাই করার সুযোগ পাবে। আসন বরাদ্দ আইনটি দুর্নীতির ও নানা বেআইনি কর্মকান্ডের জন্ম দেয়। নেতা / নেত্রীর সন্তুষ্টির উপর নারীদের জন্য আসন বরাদ্দ বিষয়টি সুস্পষ্ট।
কিছু পুলিশ কর্মকর্তা বিরোধী দলকে তাদের প্রতিপক্ষ বানিয়েছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নামে পুলিশের মামলা, দ্রুততম সময়ে তদন্ত শেষ করে চার্জশিট প্রদানে পুলিশের অতি আগ্রহ জনগণের মাঝে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। তাই পুলিশকে জনগণের সেবক ও দুষ্টের দমন চিন্তা মাথায় রেখে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে দূরে রাখার জন্য সংবিধানেই কিছু বিষয় সংযুক্ত থাকা জরুরি।
রাষ্ট্রীয় মৌলিক মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষে জনগণের চিন্তা-ভাবনা, তাদের যে চাওয়া-পাওয়া এগুলোকে ধারণ করে সংবিধান রচিত না হলে একসময় সরকারি দপ্তরে নেতা-নেত্রী বা সরকারপ্রধানদের নিয়ে ফ্যাসিস্টদের জন্ম হয়। রাষ্ট্রের কর্মচারীর কাছে জনগণ তাচ্ছিল্যের হয়ে যায়।
সশস্ত্র বাহিনীর অংশগ্রহণ রেখে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের আইনটি সংবিধানে স্পষ্টই থাকতে হবে। খুন, গুম-রাহাজানিসহ টাকা লুট বিষয়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধের আইন যুক্ত থাকতে হবে।
ব্যাংক দখল করে মানুষের জমানো টাকা হাতিয়ে নেয়া, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রভাবশালীদের ব্যাংক লুটপাট ও বাণিজ্যের নামে অর্থপাচার অপরাধের সাথে জড়িতদের আমলাতান্ত্রিক জঠিলতা মুক্ত ধারা সংবিধানে থাকতে হবে।
মেধাহীন প্রশাসনের জন্য মূলত: দলীয়ভিত্তিক নিয়োগ, বদলী ও পদোন্নতি বিশেষভাবে দায়ী। দায়ী দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যা সারাদেশের প্রশাসনিক শাসন ব্যবস্থার কেন্দ্র বিন্দুতে জনবান্ধব রাষ্ট্র গঠনে সরকারগণ সুপ্রশাসনিক সহায়তায় উচ্চশিক্ষিত, মেধাসম্পন্ন, উন্নত ও প্রযুক্তিনির্ভর জনপ্রশাসন গড়ে তোলার লক্ষে রাজনৈতিক বিবেচনার কোন প্রমাণিত সত্যতা পেলে যেন সেই ব্যক্তি ও সংস্থার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সহজ হয় , সেই ধারা ও সংবিধানে রাখতে হবে।
দেশে উন্নত ও গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নত ও যুগোপযোগী করতে সুস্পষ্ট আইন জরুরি। সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড বা এসএসবি’র অনিয়ম, কর্মকর্তাদের বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন (এসিআর), গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন, দক্ষতা ও যোগ্যতার নীতিমালা না মানা, মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক প্রশিক্ষণ , ট্রেনিং বা গবেষণার কাজে বিদেশ গিয়ে মেধাবী কর্মকর্তাদের ভ্রমণ , পদোন্নতি, পদায়ন নিয়েও সুস্পষ্ট নীতি জরুরি।বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন বা বিপিএসসি একটি সাংবিধানিক এবং স্বাধীন ও স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হলেও এর ওপর ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের কর্তৃত্ব দৃশ্যমান। সেটা বন্ধ করতে হবে। প্রশাসনকে সম্পূর্ণ দলীয়মুক্ত রাখার জন্য আইন তৈরী করতে হবে। এসব করতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। শুধু ইচ্ছা থাকলে হবে।
লেখক – এম জেড ফয়সাল , সম্পাদক -ইউএসবি নিউজ , যুক্তরাষ্ট্র।