দেখতে দেখতে ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের ৩ মাস ১৩ দিন অতিক্রান্ত হলো। এই অল্প সময়ে একটি সরকারের পারফরমেন্স পর্যালোচনার জন্য যথেষ্ট নয়। আবার সাড়ে তিন মাস একেবারে খুব কম সময়ও নয়। এই সময়ে নির্মোহ পর্যালোচনা করলে, অন্তত এটুকু বোঝা যাবে যে, সরকারের শুরুটা কেমন হয়েছে এবং সাড়ে তিন মাস তারা কতদূর কী করতে পেরেছে। কথাটাকে সরাসরি বলা যেতে পারে যে, এই সাড়ে তিন মাস এই সরকার কতটুকু সফলতা, দক্ষতা ও যোগ্যতা দেখাতে পেরেছে। এসব দিক সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ, নিরাসক্ত এবং বস্তুনিষ্ঠভাবে পর্যালোচনা করতে হলে আমাদের সঠিকভাবে জানতে হবে যে, জনগণ এই সরকারকে কেন ক্ষমতায় বসিয়েছে। এটিকেই কোনো কোনো চিন্তক একটু দার্শনিকভাবে বলছেন, জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে জনগণের অভিপ্রায় কী ছিল এবং কী আছে? জনগণের সেই আকাক্সক্ষা বা অভিপ্রায়ের কতটুকু প্রতিফলন এই সাড়ে তিন মাসে দেখা গেছে। আসুন, আমরা সেভাবেই বিষয়টি বিবেচনা করার চেষ্টা করি।
একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার। এবার ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত যে গণঅভ্যুত্থান দেখলাম, বিশেষ করে আগস্ট মাসের ৫ দিন যা দেখা গেল, সেটি আমার জীবদ্দশায় দেখিনি। লক্ষ লক্ষ নয়, কোটি কোটি মানুষ রাস্তায় বেরিয়েছিল শেখ হাসিনার মাফিয়াতন্ত্রকে (স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদ মাফিয়াতন্ত্রের কাছে ম্লান হয়ে যায়) উৎখাত করতে। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি। সেখানেও লক্ষ কোটি মানুষ স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। সেটি তো ছিল একটি অল আউট ওয়ার। এদেশের মানুষকে যারা হত্যা করেছে তারা ছিল বিদেশী। কিন্তু এবার স্বদেশীরা একটি স্বাধীন দেশে নিজের দেশের মানুষকে হত্যা করলো ১০০ বা ২০০ নয়। হত্যা করলো ১ হাজার ৬০০ ছাত্র-জনতাকে। আহত করলো ২০ হাজার ছাত্র-জনতাকে। সমকালীন ইতিহাসের একই দেশের মানুষকে (বাংলাদেশী) সেই একই দেশের শাসক গোষ্ঠি কর্তৃক হত্যার হোলি খেলা কোথাও দেখা যায় না।
রবিবার সন্ধ্যার পর এই লেখা যখন শুরু করেছি তখন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১০০ দিবস পূর্ণ হওয়া উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। একটু আগে আমি জনগণের অভিপ্রায় বা আকাক্সক্ষার কথা বলেছি। ড. ইউনূসের এই ভাষণে জনগণের সেই অভিপ্রায় বা আকাক্সক্ষার অনেক কিছুই প্রতিধ্বনিত হলো। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করলেন যে, স্বৈরাচারী শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে ফেরত চাওয়া হবে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ড এবং প্রতিটি গুলি বর্ষণের বিচার করা হবে। ইতোমধ্যেই বিচারের কাজ শুরু হয়েছে। শুধুমাত্র বাংলাদেশই নয়, হল্যান্ডের রাজধানী দি হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও স্বৈরাচারের হোতাদের বিচারের জন্য আবেদন করা হয়েছে। ড. ইউনূস জানালেন যে, প্রতিটি শহীদ পরিবারকে ৩০ লক্ষ টাকা করে দেওয়া হবে। যারা গুরুতর আহত হয়েছেন তাদেরকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হবে। যারা ফ্যাসিবাদের গুলিতে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন তাদের জন্য নেপাল থেকে কর্নিয়া আনা হবে।
॥দুই॥
তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদের আমলে যত হত্যাকাণ্ড হয়েছে তার প্রত্যেকটির বিচার হবে। শুধুমাত্র জুলাই-আগস্টের গণহত্যারই বিচার নয়, গত সাড়ে ১৫ বছরে যতগুলি গুম, খুন এবং হত্যাকাণ্ড হয়েছে তার প্রত্যেকটির বিচার করা হবে। কাউকেও ছাড়া হবে না।
ড. ইউনূসের নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা খুঁটিনাটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, দেশের প্রতিটি সমস্যা, সেটি ছোট হোক বা বড় হোক, তিনি এ্যাড্রেস করেছেন। তিনি সচেতন যে অনেক রাজনৈতিক দল নির্বাচনের কথা বলছে। তিনি বলেছেন, জনগণ নির্বাচনের সাথে সাথে সংস্কারও চায়। নূন্যতম যে সংস্কার সেটি না করে তো তিনি দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। এই ন্যূনতম সংস্কারের জন্য প্রয়োজন হলে নির্বাচন কয়েক মাস বিলম্বিত হতে পারে। এজন্য জনগণকে তিনি ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আহত এবং নিহত সকল ছাত্র-জনতা এবং শ্রমিককে পুনর্বাসন করা হবে। ফ্যাসিবাদ আতঙ্ক ছড়িয়েছিল যে, তাদের পতন হলে নাকি ৫ লক্ষ লোককে হত্যা করা হবে। কিন্তু আপনারা দেখেছেন ফ্যাসিবাদ বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার পর বোধগম্য কারণে ৭ দিন পুলিশ প্রশাসন এক প্রকার অকার্যকর ছিল। কিন্তু তারপরেও নগন্য সংখ্যক সহিংসতা হয়েছে। সংখ্যালঘু নির্যাতনের কাহিনী ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু এবার ৩২ হাজার পূজা মণ্ডপে দূর্গা পূজা হয়েছে। হয়েছে শান্তিপূর্ণভাবে এবং কোনো রকম গোলযোগ হয়নি।
তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সম্পর্কে তিনি সচেতন। এজন্য তার সরকার যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সেগুলির ফলাফল কিছুদিনের মধ্যেই পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যেই সংস্কার কাজ মোটামুটি শেষ হবে। ইত্যবসরে নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। অতঃপর পূর্ণদ্যোমে নির্বাচনের কাজ শুরু হবে। সেই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করতে গেলে প্রয়োজন হবে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা। তিনি দেশবাসীকে এই মর্মে হুঁশিয়ার করেন যে, ফ্যাসিবাদের দোসররা বসে নেই। তারা যেকোনো ছুতো নাতায় দেশের ভেতর ঢুকতে চায়। বিপুল অর্থ লুট করে তারা বিদেশ নিয়ে গেছে। সেই টাকা দুহাতে ছড়িয়ে তারা বাংলাদেশের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করতে চায়। তিনি বিশ^াস করেন যে, বাংলাদেশের মানুষ ঐসব কুচক্রী ষড়যন্ত্রের জালে পা দেবেন না।
॥তিন॥
আমি শুরু করেছিলাম এই বলে যে, এই সরকারের ৩ মাস ১৩ দিনের পারফরমেন্সের নির্মোহ বিশ্লেষণ করবো। ড. ইউনূস তার বক্তৃতায় বেশ কয়েকবার রাজনৈতিক দলসমূহের ঐক্যমতের কথা বলেছেন। কিন্তু সব বিষয়ে কি ঐক্যমত সম্ভব? বিশেষ করে সংবিধান সংশোধন বা নতুন সংবিধান রচনায়? অন্তত এই পয়েন্টটি দার্শনিক দৃষ্টিতে না দেখে প্র্যাগমেটিক বা কঠোর বাস্তবতার আলোকে বিবেচনা করা দরকার। গত ১৬ নভেম্বর শনিবার এক আলোচনা সভায় অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, সংবিধান এখনো বহাল রয়েছে। এই সরকার আদতেই সংবিধান সংশোধন করতে পারবে কিনা সেটা ভেবে দেখতে হবে। কারণ, বর্তমান সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদে এই বিষয়ে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
ঠিক এই জায়গায় আমি মনে করি, কোদালকে কোদাল বলার সময় এসে গেছে। ৫ আগস্ট যে বিপ্লবটি সম্পন্ন হয়েছে, সেটি কিন্তু বর্তমান সংবিধানকে অনুসরণ করে নয়। বরং সংবিধানকে সম্পূর্ণ পাশ কাটিয়ে বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরাচারকে হটিয়ে দেওয়া হয়েছে। ড. ইউনূস স্বীকার করেছেন যে, ছাত্ররাই তাকে নিয়োগ দিয়েছে। কারণ, আওয়ামী লীগের কয়েক জন উচ্ছিষ্টভোগী ছাড়া ১৭ কোটি মানুষ এবারের বিপ্লবে রাস্তায় নেমেছিল। তারা বিপ্লব করেছে ছাত্রদের নেতৃত্বে। তাই ছাত্র নেতৃবৃন্দ ঐ ১৭ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। সাংবিধানিক সরকারের ক্ষমতার উৎস হলো সংবিধান। কিন্তু বিপ্লবের বা গণঅভ্যুত্থানের সরকারের ক্ষমতার উৎস হলো লক্ষ কোটি জনগণ। গণতন্ত্রের সুতিকাগার যুক্তরাজ্যে জনগণের এই সুপ্রিম পাওয়ারকে রাজনৈতিক পরিভাষায় বলা হয়েছে The Awful Majesty of the People. জার্মানিতে আইনের উৎস বলা হয়েছে Basic Norm. জার্মান ভাষায় Grundnorm. এটিই হলো জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা বা The Awful Majesty of the People.. সুতরাং ড. ইউনূস সরকার প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতিনিধি হিসেবে।
আসলে সংবিধান বহির্ভূত পন্থায় সরকারের পরিবর্তন ঘটলে তাৎক্ষণিকভাবে সংবিধান বিলোপ করা হয়। সেটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হোক অথবা গণঅভ্যুত্থান বা গণবিপ্লবের মাধ্যমে হোক। পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে প্রথম যে কাজটি করেছিলেন, সেটি হলো ১৯৫৬ সালে পাশ করা শাসনতন্ত্র বাতিল। ১৯৬৯ সালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয় অঞ্চলে প্রবল গণঅভ্যুত্থানের পিঠে সওয়ার হয়ে আইয়ুব খানকে হটিয়ে মাশাল ল’ জারি করেছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। তিনিও সাথে সাথেই শাসনতন্ত্র বাতিল করেছিলেন।
বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যে পট পরিবর্তন হয়েছিল, সেখানে সংবিধান এবং জাতীয় সংসদ কোনোটাই বাতিল হয়নি। তার কাফফারাও পরিবর্তনের নায়কদেরকে দিতে হয়েছে। কিন্তু ৩ নভেম্বর মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ সেই ভুলটি করেননি। তিনি সংবিধান এবং জাতীয় সংসদ উভয়ই বাতিল করেন।
॥চার॥
২০২৪ এ ১৭ কোটি মানুষের বিপ্লবের পরও সংবিধান বহাল রয়েছে। এটি বাতিল করা হয়নি, স্থগিতও করা হয়নি, এমনকি আংশিকভাবে বাতিলও করা হয়নি। আজ তাই দেখা দিচ্ছে অনেক জটিলতা। ইন্টারিম সরকার গঠনের জন্য জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দিতে হয়েছে। কিন্তু ইন্টারিম সরকারের প্রভিশন সংবিধানে নাই। তাই সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ মোতাবেক সুপ্রিম কোর্টে রেফারেন্স পাঠিয়ে ইন্টারিম সরকার গঠনকে ঠধষরফধঃব করা হয় বা বৈধতা আনা হয়। কিন্তু তারপরেও পদে পদে সংবিধান মানতে হচ্ছে।
আমি এই পয়েন্টে আজ আলোচনা লম্বা করবো না। সংবিধান নিয়ে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে সেটি নিয়ে আমি মনে করি, আমাকে আরো লিখতে হবে। সর্বজনশ্রদ্ধেয় ড. ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমতের কথা বলেছেন। কীভাবে ঐক্যমত হবে?
২১ দফা, ৬ দফা বা ৭০-এর আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টো, ইয়াহিয়ার কাছে পেশকৃত শেখ মুজিবের সাংবিধানিক খসড়া এবং মুজিবনগরে ১০ এপ্রিল গৃহীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের কোথাও ধর্মনিরপেক্ষতা বা ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করার অঙ্গীকার ছিল না। ঐতিহাসিক ২১ দফা কর্মসূচির মূলনীতি হিসেবে বিধৃত ছিল নিম্নোক্ত লাইনসমূহ, ‘কোরআন ও সুন্নার মৌলিক নীতির খেলাফ কোন আইন প্রণয়ন করা হইবে না এবং ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে নাগরিকগণের জীবনধারণের ব্যবস্থা করা হইবে।’ ২১টি দফার একটি দফাতেও সমাজতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতার কোন দফা ছিল না।
অথচ, তারপরেও ৭২-এর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র এবং বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এগুলো তো জনগণের আকাঙ্খা বা অভিপ্রায়ের বিপরীত। তাই ৭২ এর সংবিধান জনগণের ইচ্ছা বা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটায় না। এই সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে সব দল বিলোপ করে একটিমাত্র দল রাখা হয়, যার নাম বাকশাল। তার শ্লোগান ছিল, ‘এক নেতা এক দেশ/ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ’। সুতরাং শেখ হাসিনই প্রথম ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করেননি। স্বৈরাচার প্রথম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। জেনারেল জিয়া চতুর্থ সংশোধনী বাতিল করে বহুদলীয় সরকার ব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭২-এর সংবিধান অনেকটাই পুনঃস্থাপিত হয়।
ঐ সংবিধানে বরং ৭ (খ) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অজুহাতে সংবিধানের এক তৃতীয়াংশ অনুচ্ছেদ সংশোধনের উর্ধ্বে রাখা হয়। যদি সেখানে হাত দেওয়া হয় সেটাকে বলা হয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহ। রাষ্ট্রদ্রোহের কারণে রাখা হয়েছে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান। আরো অনেক পয়েন্ট আছে। ভবিষ্যতে বলার আশা রাখি।
আজকে যেটুকু বললাম তার আলোকে বলা যায় যে, অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান ভুল কিছু বলেননি। বরং সময় মতো তিনি সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেছেন।
– মোবায়েদুর রহমান
Email: journalist15@gmail.com