স্থবির ও হতাশ রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে আশার সঞ্চার হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগের ফলে। গত সাত বছর ধরে জন্মভূমি মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী প্রত্যাবাসনের আশাহীন জীবন কাটাচ্ছিল। তাদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের পাশাপাশি জন্ম নিয়েছিল মাদক, অস্ত্র ও মানব পাচারের মতো অপরাধ প্রবণতা। জুলাই বিপ্লবের পর নতুন সরকারের বহুমাত্রিক প্রচেষ্টা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে উদ্দীপনা জাগিয়েছে।
নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি কয়েকদিন টেকনাফ, উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সরজমিন গবেষণা তথ্য সংগ্রহকালে এই আশাবাদী দৃশ্যপট দেখা গেছে। তরুণ গবেষকদের দলটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)-এর নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর ড. মাহফুজ পারভেজের নেতৃত্বে ফিল্ডওয়ার্ক পরিচালনাকালে দেখতে পান যে, রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধান এবং মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ‘নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ’ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে ‘একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন’ আয়োজনসহ রোহিঙ্গা সংকটের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ‘জরুরি মনোযোগ’ দেয়ার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আহ্বান রোহিঙ্গা কমিউনিটিতে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দ জানান, ‘আমাদের সমস্যা সমাধানে বিশ্বনেতৃত্বের ভূমিকা রয়েছে। আন্তর্জাতিক সাহায্য ছাড়া মিয়ানমার ফিরে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব ও নিরাপদ নয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আহ্বান বিশ্বকে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের পাশে এনে দাঁড় করাবে ও সমস্যার সমাধানের পথ দেখাবে।’
উল্লেখ্য, গত ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ দিবস উপলক্ষে এক বাণীতে ড. ইউনূস একটি ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সব মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে জাতিসংঘকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্বচ্ছ করতে এর সংস্কারের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘রাখাইন রাজ্য (মিয়ানমার) বা গাজায় যারা অব্যাহতভাবে নিপীড়ন, উৎখাত ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছেন, আমরা তাদের উপেক্ষা করতে পারি না।’
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশ তার অভিন্ন স্বার্থে আরও ন্যায়সংগত ও শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়ে তুলতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করছে। একই সঙ্গে সবার জন্য মর্যাদা ও অধিকার আদায়ের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে হবে।’
এর আগে, প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে জোরালো পদক্ষেপ নিতে কানাডাসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ২০ নভেম্বর বাংলাদেশে নবনিযুক্ত কানাডার হাইকমিশনার অজিত সিং প্রেসিডেন্টের কাছে তার পরিচয়পত্র পেশ করতে গেলে প্রেসিডেন্ট এ আহ্বান জানান।
জুলাই বিপ্লবের পর নতুন সরকারের নীতি ও পরিকল্পনায় রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার দেখতে পাচ্ছেন শরণার্থী নেতারা। যারা স্বদেশে ফিরতে না পেরে হতাশ ছিলেন এবং সন্ত্রাস ও বঞ্চনায় আক্রান্ত ছিলেন, তারা এখন আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন। কক্সবাজারে আশ্রয় গ্রহণকারী, আত্মপরিচিতি ও নাগরিকতার সংকটে পর্যুদস্ত এই উদ্বাস্তু ও গৃহহীন জনগোষ্ঠীর মনে জাগ্রত হয়েছে নতুন জীবনের স্বপ্ন।
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের শরণার্থী শিবিরকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় রিফিউজি ক্যাম্প। ক্যাম্পের বাসিন্দা যুবক আবদুস সালাম মোটামুটি বাংলা জানেন। ক্যাম্পের ভেতরের অমানবিক পরিস্থিতির বিবরণ দিয়ে বললেন, ‘কোনও রকমে বেঁচে আছি। দিন দিন পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। এভাবে আর কতদিন থাকবো?’
রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক সফিক টিপু মনে করেন, ‘বিশ্বে নতুন নতুন সংকট সৃষ্টি হওয়ায় আন্তর্জাতিক ফোকাস রোহিঙ্গাদের দিক থেকে ক্রমশ সরে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকট প্রলম্বিত হওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ অন্যদিকে সরে যাওয়ায় রোহিঙ্গাদের জন্য আর্থিক সহায়তা কমেছে এবং তাদের জন্য পরিচালিত কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে আর্থিক সংকটে পড়েছে সংশ্লিষ্টরা। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আহ্বানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশার সঞ্চার হয়েছে।’
তিনি জানান, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্বাস্থ্যকেন্দ্র ১৬০ থেকে কমে এখন ১২০-এ দাঁড়িয়েছে এবং আর্থিক সংকটের কারণে বর্তমানে চালু স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোও তাদের সেবা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দের পরিমাণও অনেক কমেছে।’
স্থানীয়রা মনে করেন, ‘অভাব, বঞ্চনা ও হতাশার কারণে রোহিঙ্গারা অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের অনেকেই মাদক, অস্ত্র ও মানব পাচারে অংশ নিতে বাধ্য হচ্ছে। সন্ত্রাসের সঙ্গেও অনেকের সংযোগ তৈরি হচ্ছে। এই পরিস্থিতির আশু অবসান হওয়ার জন্য বিকল্প পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।’
এসব বক্তব্য বহুলাংশে সত্য। প্রায়ই ক্যাম্পে আন্তঃগোষ্ঠী সশস্ত্র লড়াই হচ্ছে। কিছুদিন আগে উখিয়ার ১৭ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঘরে ঢুকে একই পরিবারের ৩ জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। প্রায়ই ওয়ালাপালং পুলিশ ক্যাম্পের আওতাধীন বর্ধিত ক্যাম্প-২০ এর লাল পাহাড় সংলগ্ন এস-৪ ও বি-৭ ব্লক এলাকা দিয়ে ১৫-২০ জন অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারী ক্যাম্পে হানা দেয়। স্থানীয় লোকজনও এ কারণে ভীত-সন্তস্ত্র।
রোহিঙ্গাদের একাধিক সংগঠন স্বদেশ প্রত্যাবাসনের জন্য আগ্রহী হলেও তারা কিছু শর্ত দিয়েছে। যার মধ্যে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব প্রদান এবং স্ব স্ব ঘরবাড়িতে নিরাপত্তার সঙ্গে প্রত্যাবাসন অন্যতম। তাদের মতে, ‘প্রাণ নিয়ে যেখান থেকে পালিয়ে এসেছি, জীবনের নিরাপত্তা না পেলে সেখানে কেন যাবো?’
প্রবীণ রোহিঙ্গা শকুর মাহমুদ বলেন, ‘আমরা আন্তর্জাতিক সহায়তায় নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পেলে জেনেশুনে মৃত্যুর মুখে ফিরে যেতে পারি না।’
এদিকে, মিয়ানমার সরকার এবং আরাকান বা রাখাইন প্রদেশ দখলকারী আরাকান আর্মি (এএ), কেউই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। তাদের মতে, রোহিঙ্গারা বহিরাগত। কিন্তু রোহিঙ্গারা দাবি করেন যে, ‘ঐতিহাসিকভাবে তারা আরাকান অঞ্চলের বাসিন্দা। মিয়ানমারের জাতীয় ইতিহাসে তাদের সংগ্রামী অবদান রয়েছে। কিন্তু জাতিগত বিদ্বেষের কারণে তারা গণহত্যা ও নিপীড়নের শিকার হয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। আরাকানে তাদের জন্মগত অধিকার রয়েছে। সেখানে তাদের জমিজমা, সহায়-সম্পদ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও পূর্বপুরুষের কবর বিদ্যমান। তারা তাদের জাতীয়তা ও নাগরিকতার দাবি ত্যাগ করবেন না।’
‘রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ’ সম্পর্কে জানতে কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা ও স্থানীয় মানুষদের নিয়ে আলোচনাকালে তাদের নতুন রাজনৈতিক স্বপ্নের কথা জানা যায়। তারা বললেন, ‘চরম হতাশার মধ্যে থেকে রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসের দিকে যাচ্ছে। তীব্র বঞ্চনা তাদেরকে কঠোর পথে ঠেলে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি ঠেকাতে হবে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা স্থানে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গা কমিউনিটিকে একত্রিত করে স্বদেশ প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ ও প্রচারণা শুরু করতে হবে। রোহিঙ্গা গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত তৈরি করতে হবে। শুধু আশ্রয়
নিয়ে বসে থাকলে হবে না। নিজেদের দাবি নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক লড়াই করতে হবে।’
বছরের পর বছর গণহত্যা ও নির্যাতনে গৃহহীন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী শরণার্থী শিবিরের বিপন্ন পরিস্থিতিতে সন্ত্রাস ও বঞ্চনা কবলিত হলেও তাদের মধ্যে নতুন ও ইতিবাচক রাজনৈতিক স্বপ্নের ঝিলিক এক আশাবাদী ভবিষ্যতের জন্ম দিচ্ছে। বিশেষ করে, রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার জন্য একাধিক আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত ২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশেনের ফাঁকে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের এক আলোচনায় বক্তব্য রাখতে গিয়েও তিনি এ আহ্বান জানান।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আমাদের সতর্ক হতে হবে, এই সঙ্কটের সমাধান না হলে শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র অঞ্চল সমস্যায় পড়বে।’ রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের এক আলোচনায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের অব্যশই এ বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে।’ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি, আইসিসি প্রসিকিউটর করিম এ এ খান, আইওএম মহাপরিচালক অ্যামি পোপ প্রমুখ বক্তব্য দেন। প্রধান উপদেষ্টা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে নতুন করে ভাবার প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, ‘প্রথমত আমরা চাই জাতিসংঘ মহাসচিব যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে সকল পক্ষের উপস্থিতিতে একটি সম্মেলনের আয়োজন করুক।’ সম্মেলনে সঙ্কটের সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা পূর্বক নতুন এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সমাধানের উপায় কী হতে পারে, তেমন প্রস্তাব আসতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, দ্বিতীয়ত জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ যৌথভাবে পরিচালিত ‘জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান’ কার্যক্রমে নতুন করে প্রাণশক্তি যোগ করার প্রয়োজন। যেহেতু এখন রোহিঙ্গাদের পেছনে ব্যয় করার মতো তহবিলের অভাব রয়েছে, তাই রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে অর্থ সংগ্রহের প্রক্রিয়া আরও জোরদার করতে হবে। তৃতীয় প্রস্তাবে ড. ইউনূস বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যা অপরাধের বিচার নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই আন্তরিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, দীর্ঘমেয়াদি শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার দ্বারা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পেরে সম্মানিত বোধ করছি। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও অনুষ্ঠান হচ্ছে তবে ড. ইউনূসের উপস্থিতি ও তার দৃষ্টিভঙ্গি এবারের আলোচনাকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।’ তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য বৈষম্য, রাষ্ট্রহীনতা এবং জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত বন্ধ করতে আমাদের অবশ্যই প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বৈঠকের পরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বাসসকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে এবারের বৈঠকটি অত্যন্ত সফল ছিল। সবাই বাংলাদেশের প্রচেষ্টার প্রশংসা এবং তাদের অব্যাহত সমর্থনের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।’ আইওএম মহাপরিচালক অ্যামি পোপ বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। তিনি বলেন, ‘এই সঙ্কট সমাধানে আমাদের আরও কাজ করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা ও দীর্ঘমেয়াদী সমাধান প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে হবে।’ আইওএম মহাপরিচালক জানান, তারা এই লক্ষ্য অর্জনে সম্ভাব্য সবকিছু করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের এই আলোচনায় অংশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং বাংলাদেশ ও তাদের আশ্রয়দানকারী জনগোষ্ঠীর জন্য প্রায় ১৯ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলারের নতুন সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেন। এই মার্কিন সহায়তা জীবন রক্ষা বিশেষ করে সহিংসতা ও নিপীড়নের কারণে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা, আশ্রয় এবং খাদ্য সরবরাহে সহায়তা করবে। এদিকে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালে বাংলাদেশে অবস্থানরত কিছু রোহিঙ্গা শরণার্থী বিশ্ব নেতাদের উদ্দেশ্যে ‘আমাদের হতাশ করবেন না’ মর্মে একটি বার্তা পাঠিয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ওই ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ভুলে যাওয়া যাবে না।’
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আহ্বানের প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শরণার্থী গোষ্ঠী আশাবাদী চোখে তাকিয়ে আছে। এক্ষেত্রে কিছু কিছু অর্জন তাদের আশাকে বাস্তবের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যেমন, রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানের জন্য ২০২৫ সালে সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনকে নিয়ে উচ্চপর্যায়ের জাতিসংঘ সম্মেলন আয়োজনের একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। ২২ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আহ্বানের অংশ হিসেবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ওআইসি ও ইইউর যৌথভাবে পেশ করা ‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্য সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক প্রস্তাবটি ইউএনজিএর তৃতীয় কমিটিতে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে, এটিকে ১০৬টি দেশ সমর্থন দিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক সমর্থনের একটি উল্লেখযোগ্য স্তরে পৌঁছেছে। প্রস্তাবটির মাধ্যমে সদস্য রাষ্ট্রগুলো ২০২৫ সালে যতটা দ্রুত সম্ভব মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুর পরিস্থিতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনকে একটি উচ্চ স্তরের সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নেয়। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনসহ সংকটের টেকসই সমাধানের জন্য একটি ব্যাপক, উদ্ভাবনী, সুনির্দিষ্ট ও সময়াবদ্ধ পরিকল্পনা প্রস্তাব করার জন্য সম্মেলনের লক্ষ্য সামগ্রিক সংকট পর্যালোচনা করা। এ বছর অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে প্রস্তাবটিতে অন্যান্য দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা মুসলিমসহ সব শরণার্থীর প্রত্যাবর্তনের অধিকার নিশ্চিত করা এবং স্বেচ্ছা, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবর্তন ও পুনর্মিলনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি তৈরি করতে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এতে হত্যা, ধ্বংস ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, মানবিক সহায়তা প্রবেশে বাধা, শিশুসহ বেসামরিক নাগরিক—বিশেষ করে রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুর জোরপূর্বক সশস্ত্র বাহিনী অথবা সশস্ত্র গ্রুপে নিয়োগসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অপব্যবহারের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়। প্রস্তাবে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য সমস্ত দায়বদ্ধতা প্রক্রিয়াকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। প্রস্তাবটি একটি আঞ্চলিক সংস্থা হিসেবে আসিয়ানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ওপর জোর দেয় এবং সম্পূর্ণভাবে পাঁচ দফার ঐকমত্যের উদ্যোগগুলো তুলে ধরা হয়।
সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে প্রস্তাবটি গৃহীত হওয়ার পর জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মুহম্মদ আবদুল মুহিত এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমাদের জন্য এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার স্বার্থে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের পরিস্থিতি তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ রাষ্ট্রদূত মুহিত আরও বলেন, ‘ঐক্যমত্যের মাধ্যমে প্রস্তাবটি গৃহীত হওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা সংকটের টেকসই সমাধানের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃঢ় প্রতিশ্রুতির প্রমাণ।’ তিনি বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘস্থায়ী উপস্থিতি কীভাবে একটি জটিলতা সৃষ্টি করেছে, তা বর্ণনা করেন। নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাব দুটির কথা উল্লেখ করে তিনি রোহিঙ্গা মুসলিমদের প্রত্যাবাসনে উপযুক্ত পরিস্থিতি তৈরির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা পরিকল্পনার জন্য পর্যাপ্ত অর্থায়নের ওপরও জোর দেন।
সম্প্রতি নতুন করে আসা ৪০ হাজার রোহিঙ্গাসহ বাংলাদেশ বর্তমানে ১৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। অতীতের সরকার এ সমস্যাকে সমাধানের বদলে জিইয়ে রেখেছে। সরজমিন তথ্য বলছে, নতুন সরকারের নেতৃত্বে এসেই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্যোগ ও আহ্বান মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের লাখ লাখ শরণার্থীর মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে।