• ৫ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ২০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ৩রা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

নাহেদুল বেঁচে থাকতে আমাদের এত কষ্ট করতে হয়নি , সুমন মিয়া সহ আরো কয়েকজনের মারা যাওয়ার বিষয়

usbnews
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৪
নাহেদুল বেঁচে থাকতে আমাদের এত কষ্ট করতে হয়নি , সুমন মিয়া সহ আরো কয়েকজনের মারা যাওয়ার বিষয়
নিউজটি শেয়ার করুনঃ

গোয়াইনঘাট উপজেলার সদর ইউনিয়নের ফেনাইকোনা গ্রামের আবদুন নূর বিলাল ও কমলা বেগমের সন্তান সুমন মিয়া (২৫)। ছয় ভাইবোনের মধ্যে সুমন ছিলেন সবার ছোট। বড় ভাই লোকমান মিয়া কৃষি কাজ করেন। রুবিনা, রুজিনা ও ফারহানা তিনবোনই বিবাহিত। আরেক ভাই জাকির মিয়া ও সুমন মিয়া বাবার সো-মিল দেখা শোনা করেন।

৩০ সেপ্টেম্বর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে  প্রতিবেদন

গোয়াইনঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহকারি স্বাস্থ্য পরিদর্শক মো. মতিউর রহমান ৩০ সেপ্টেম্বর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে একটি প্রতিবেদন দেন। তাতে সিয়াম আহমদ রাহিম, নাহেদুল ইসলাম ও সুমন মিয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন।

সুমনের বাবা আবদুল নূর বিলাল বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে বিগত সরকারের পতন হলে এলাকায় বিজয় মিছিল বের হয়। সবার সাথে ওইদিন সুমনও মিছিলে যোগ দেয়। মিছিলটি মাতুরতল বাজারের মাঝামাঝি সোনার হাট বিজিবির ক্যাম্পের সামনে এলে বিজিবির সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে। বিজিবির সদস্যদের ছোড়া গুলিতে অনেকে আহত হয় এবং তার ছেলে সুমন মিয়া সহ তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়।

তিনি আরো বলেন, আমার ছেলে প্রতিদিন আমার সাথে কাজ করতো। আমাদের নিজস্ব সো-মিল। আমরা বাবা ছেলে একসাথে কাজ করি। ওইদিন সে আমাকে দোকানের কাছে নামিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে আন্দোলনে যায়। সরকার পতনের খবরে তারা মিছিল নিয়ে উপজেলার বিভিন্ন স্থান ঘুরে বেড়ায়।
সন্ধ্যায় সোনার হাট ক্যাম্পের সামনে মিছিলকারী ও বিজিবির সদস্যদের সংঘর্ষ হয়। তখন আমার ছেলে সহ অনেকেই আহত হয়। সুমন গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে আত্মীয়-স্বজনরা তাকে বিজিবির গেইটের ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে রাস্তা থেকে উদ্ধার করে। প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরে ওসমানি হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষনা করেন। পুলিশি কার্যক্রম না থাকায় ময়নাতদন্ত ছাড়াই তার দাফন করা হয়।

May be an image of 1 person, beard, smiling and text

সুমন মিয়া 

২০ আগষ্ট স্মারক (নং-(২০২৪/৫)(৮)২৪) গোয়াইনঘাট সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গোলাম রাব্বানী সুমন ও ১নং ইউপি সদস্য মো. দেলোয়ার হোসেনের যৌথ স্বাক্ষরিত প্রত্যয়ন পত্রে, গোয়াইনঘাট বিজিবি ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগহণ করে বিজয় মিছিল দেওয়ার প্রাক্কালে স্থানীয় বিজিবি সদস্য কর্তৃক অতর্কিত গুলিতে আঘাত প্রাপ্ত হয়ে সুমনের মৃত্যুর নিহত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। প্রত্যয়ন পত্র প্রদানের সত্যতা নিশ্চিত করেন তারা দুজনেই।

অপরদিকে গুলিতে নিহত সুমন মিয়ার বাবা আবদুন নূর বিলাল ২৭ আগষ্ট জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ১ম আদালতে একটি মামলা করেন। গোয়াইনঘাট থানার মামলা (নং-২২(৮)২৪)। মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সিলেট-৪ আসনের সাবেক সংসদ ও সাবেক মন্ত্রী ইমরান আহমদ, সাবেক সড়ক ও পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, বিজিবি সদস্য ও সাবেক ক্যাম্প কমান্ডার হাবিলদার মিজান, ভিআইপি শহিদ, সিপাহী আল আমিন, সিপাহী আতিক সহ ৬৭ জনের নামোল্লেখ এবং ৫ আগষ্ট সোনার হাট ক্যাম্পে কর্মরত সকল বিজিবি সদস্যসহ অজ্ঞাত ১০০/১৫০ জনকে আসামি করা হয়। মামলায় বিলাল তার ছেলে সুমন মিয়া সহ আরো কয়েকজনের মারা যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন।

তিনি এজাহারে দাবি করেন, ঘটনার দিন ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলে স্থানীয় জনগন আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে শতাধিক মোটর সাইকেলের শোভাযাত্রা বের করে। ওই সময় হাবিলদার মিজানের গুলিতে তার ছেলে সুমন মিয়া নিহত হয়। তখন অন্তত চার জন লোক নিহতের ঘটনা ঘটে।

 

বৃদ্ধ বাবার অভাবের সংসারে একমাত্র আশার আলো ছিলেন নাহেদুল ইসলাম 

নাহেদুলের বাবা উছমান বলেন, ‘আমি অসুস্থ ও বৃদ্ধ। একারনে আমার ছেলে হাল ধরে পরিবারের। দিনমজুরী করে যা পেত তা দিয়েই কোনোরকম চলছিল আমাদের সংসার। সে মারা যাওয়ায় বিয়ের উপযুক্ত দুই মেয়েকে নিয়ে আছি দুশ্চিন্তায়। আছে ছোট ছেলে মেয়ের পড়ালেখার খরচও। সব মিলিয়ে নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে। নাহেদুল বেঁচে থাকতে আমাদের এত কষ্ট করতে হয়নি। উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে আমরা দিশেহারা হয়ে পড়েছি।’

নাহেদুলের মৃত্যুর ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো মামলা করা হয়নি। তবে, একই উপজেলার ফেনাইকোনা গ্রামের আবদুন নূর বিলাল ২৭ আগষ্ট জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ১ম আদালতে একটি মামলা করেন। গোয়াইনঘাট থানার মামলা (নং-২২(৮)২৪)। মামলায় বিলাল তার ছেলে সুমন মিয়াসহ আরো কয়েকজনের মারা যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন।

বাদি আবদুন নূর বিলাল দাবি করেন, ঘটনার দিন ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলে স্থানীয় জনগন আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে শতাধিক মোটর সাইকেলের শোভাযাত্রা বের করে। ওই সময় সোনারহাট বিজিবি ক্যাম্পের কমান্ডার হাবিলদার মিজানের গুলিতে তার ছেলে সুমন মিয়া নিহত হয়। তখন অন্তত চার জন লোক নিহতের ঘটনা ঘটে।

May be an image of 1 person and smiling

নাহেদুল ইসলাম

নাহেদুল ইসলাম (২২)। ভাইবোনসহ সবার ভরনপোষনের দায়িত্ব ছিল তার ওপর। বাবা অসুস্থ হওয়ায় অল্প বয়সেই ধরেছিলেন পরিবারের হাল। ছোট ভাই বোনের পড়ালেখার খরচসহ পরিবারের সকল চাহিদা মেটাতে হত তাকে। দিনমজুরের কাজ করে যা পেতেন তা দিয়েই চলত সংসার। নিজের কষ্টের বিনিময়ে চেয়েছিলেন পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর।

পরিবারের দাবি, সন্ধ্যায় বাজার থেকে বাসায় ফেরার পথে সোনারহাট বিজিবির ক্যাম্পের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান নাহেদুল।

গোয়াইনঘাট উপজেলার পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের ইসলামাবাদের উছমান আলী ও শফিকুন নেছার সন্তান নাহেদুল ইসলাম (২২)। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে নাহেদুল ছিলেন সবার বড়। ছোট বোন ইয়াসমীন ও নাজমিন ৯ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। ছোট ভাই জাহিদুল এসএসসি পরীক্ষার্থী। সবার ছোট তাসনিম মাদরাসায় অধ্যায়নরত। নাহেদুল পেশায় ছিলেন দিনমজুর। যখন যে কাজ পেতেন তাই করতেন। পাশাপাশি কৃষিকাজও করতেন প্রতি মৌসুমে।

 

২ আগষ্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে গুলিতে নিহত হন তিনি। হবিগঞ্জ সদরের তিনকোণা পুকুরপার এলাকায় মোস্তাক গুলিবদ্ধ হন। মোস্তাকের পিঠের ডানদিকে এবং ডান হাতে গুলি লাগে।

মোস্তাক নিহতের ঘটনায় ২১ আগষ্ট হবিগঞ্জ সদর থানায় একটি মামলা (নং-১২(৮)২৪) হয়। ওই মামলায় সাবেক এমপি আবু জাহির, সাবেক পৌর মেয়র আতাউর রহমান সেলিম, হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর চৌধুরীসহ ৮২ জনের নামোল্লেখ ও অজ্ঞাত ২০০ জনকে আসামি করা হয়। মামলাটি রেকর্ড করেন হবিগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) নুরুল হক।

May be an image of 1 person, slow loris and text

মোস্তাক আহমেদ

সিলেট সদর উপজেলার টুকেরবাজার গৌরিপুর এলাকার আব্দুল কাদির ও মায়া বেগমের সন্তান মোস্তাক আহমেদ। পেশায় ছিলেন ইলেক্ট্রিশিয়ান।
২ আগষ্ট বাদ জুমা শহরের কোর্ট মসজিদ চত্বর ও শহরের অপর প্রান্তে খোয়াই নদীর তীরে নূরুল হেরা জামে মসজিদের সামনে এ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। বেলা আড়াইটার দিকে নূরুল হেরা জামে মসজিদের সামনে থেকে মিছিল বের হয়। এ সময় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সাথে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়।

ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে কোর্ট মসজিদের সামনে অবস্থান নেওয়া আন্দোলনকারীরা ছুটে আসেন। তারা এসে ধাওয়া দেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের। তখন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। ওইদিন আওয়ামী লীগ কার্যালয় ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মো. আবু জাহিরের বাসার সামনে থাকা কয়েকটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

পরবর্তীতে বিকেল সোয়া ৪টায় পুলিশ এসে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে চেষ্টা করে। তারা রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হলে শতাধিক লোক আহত হোন । এবং মারা যান মোস্তাক ।
মোস্তাকের বাবা মারা যাওয়ায় বেশিদূর পড়ালেখা করতে পারেন নি। তাই ছোটবয়স থেকেই কর্মজীবন শুরু হয় মোস্তাকের। বাবাহীন মায়ের সংসার সচল রাখতে করে গেছেন বিভিন্ন কাজ। ওয়ার্কশপ মিস্ত্রির কাজ থেকে শুরু করে চালিয়েছেন সিএনজি অটোরিকশা। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি হওয়ায় সকলের যৌথ আয়ে চলতো তাদের সংসার। পরবর্তীতে নরসিংদী পিডিবি অফিসের অধীনে ইলেক্ট্রিক লাইনম্যানের কাজে যোগ দেন।

May be an image of one or more people and people smiling

সিয়াম আহমদ

কিশোর সিয়াম আহমদ রাহিমের কথা। নদীতেই মিলল বুলেটের আঘাতে নিঃশেষ হওয়া রাহিমের গুলিবিদ্ধ লাশ। ১৪ বছরের রাহিম গোয়াইনঘাট উপজেলার পান্তুমাই গ্রামের ফখর উদ্দিন ও শিরিনা আক্তারের ছোট ছেলে। স্থানীয় সোনারহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র সে।গোয়াইনঘাটের সোনারহাট সীমান্তের দিকে ছুটে যায় মিছিল। ওইদি সোনারহাট ক্যাম্পেও হামলা চালান মিছিলকারীরা। ওই সময় গুলিতে নাহেদুল, রাহিম ও সুমন নামে তিনজন মারা যান। তারা সকলেই বিজিবির গুলিতে মারা যান বলে পরিবারের লোকজন দাবি করেন।

তিনভাই বোনের মধ্যে রাহিম ছিল সবার ছোট।

নিহত রাহিমের দাদী বলেন, ‘দুপুরে ভাত খাইয়া মিছিলের পিছে পিছে গেল। আর ফিরিয়া আইল না ’তিনদিন বাদে পাইছি পানিত। মাথাত গুল্লি লাগছে’।
নিহত রাহিমের চাচা আলীমউদ্দিন বলেন, ওইদিন ছাত্র-জনতা বিজয় মিছিল নিয়ে বের হয়। আমার ভাতিজা রাহিমও মিছিলে যোগ দেয়। সন্ধ্যার দিকে বিজিবির সদস্যদের সাথে মিছিলকারীদের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে আমার ভাতিজা রাহিমও গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পাই।

তিনি দাবি করেন, স্থানীয়রা বলছিল রাহিমও রাস্তায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়েছিল। কিন্তু আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে তাকে খোঁজে পাইনি। নাহেদুল ও সুমন মিয়া নামের দুজনের লাশ পাওয়া গেলেও রাহিমকে পাওয়া যায়নি। ঘটনার তিনদিন পর ৮ আগষ্ট পিয়াইন নদীতে তার লাশ ভেসে ওঠে।