যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। আইসিসির তিন বিচারকের প্যানেল (প্রি-ট্রায়াল চেম্বার-১) এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করেছে।
আইসিসির ২২ বছরের ইতিহাসে নজিরবিহীন পদক্ষেপ এটি। কারণ পশ্চিমাদের মিত্র হিসেবে পরিচিত কোনো উচ্চপদস্থ নেতার বিরুদ্ধে আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির ঘটনা এটাই প্রথম। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বিলম্ব হওয়ায় অনেকেই ধারণা করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল আইসিসির ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে, যা এই বিলম্বের কারণ হতে পারে।
বিগত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্র আইসিসির এখতিয়ারকে চ্যালেঞ্জ করে আসছে এবং এর বিচারকদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দিয়েছে। এর মধ্যে নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ বেশ কিছু ব্যবস্থা নেওয়ারও কথা বলা হয়েছিল। এছাড়া ইসরায়েল আইসিসির বিচারকদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। তবে, গত ২১ নভেম্বর আইসিসি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছায়।
আইসিসির যে তিন বিচারকের প্যানেল নেতানিয়াহু ও গ্যালান্তের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন, তারা হলেন-
১. নিকোলাস গুইয়ু (ফ্রান্স): তিনি ‘প্রি-ট্রায়াল চেম্বার-১’-এর সভাপতি এবং এই প্যানেলের নেতৃত্ব দিয়েছেন, যার অধীনে নেতানিয়াহু এবং গ্যালান্তের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
২. রেইন আলাপিনি-গানসু (বেনিন) আইসিসির দ্বিতীয় সহ-সভাপতি এবং ‘প্রি-ট্রায়াল চেম্বার-১’-এর সদস্য। তিনি একজন বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ।
৩. বেটি হোহলার (স্লোভেনিয়া) তিনি ‘প্রি-ট্রায়াল চেম্বার-১’-এর একজন সদস্য এবং মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক অপরাধ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ।
আইসিসির বিচারকদের নির্বাচিত হওয়ার জন্য রোম স্ট্যাটিউটের অংশ দেশগুলো তাদের মনোনয়ন দেয়। এই বিচারকদের জন্য উচ্চ নৈতিক চরিত্র, নিরপেক্ষতা এবং সততা প্রদর্শন করা প্রয়োজন। তাদেরকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও আইনগত মানদণ্ডে সেরা বিচারিক ক্ষমতার অধিকারী হতে হয়। একবার নির্বাচিত হলে, তারা নয় বছরের জন্য দায়িত্ব পালন করেন।
ইসরায়েল এই সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং এটিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিহিত করেছে। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলছেন, আইসিসি এমন একটি পদক্ষেপ নিয়েছে যা তাদের সার্বভৌমত্ব এবং নিরাপত্তার জন্য হুমকির সৃষ্টি করতে পারে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রও আইসিসির এই সিদ্ধান্তের নিন্দা করেছে, তবে তারা এটিকে আইনি প্রক্রিয়া হিসেবে গ্রহণ করেছে।
বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা আইসিসির এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে, এটি আন্তর্জাতিক অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে, পশ্চিমা মিত্ররা এই পদক্ষেপকে একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবেই দেখছে এবং এতে তাদের দেশগুলোর সঙ্গে আইসিসির সম্পর্কের উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে।
আইসিসির রায় মানতে বাধ্য ইউরোপ
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকর করা হবে কিনা তা নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত ইউরোপের দেশগুলো। হাঙ্গেরি তো আগেভাগে নেতানিয়াহুকে বুদাপেস্ট সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছে।
তবে ইইউর পররাষ্ট্র নীতি প্রধান শনিবার জোসেফ বোরেল বলেছেন, দুই ইসরাইলি নেতা এবং একজন হামাস কমান্ডারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কর্তৃক জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকর করা হবে কিনা, তা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সরকারগুলো এড়াতে পারে না।
যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বৃহস্পতিবার ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এবং হামাস নেতা মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধে এই পরোয়ানা জারি করে আইসিসি। সব ইউরোপীয় ইউনিয়ন সদস্য রাষ্ট্র আইসিসির প্রতিষ্ঠাতা চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী, যাকে বলা হয় রোম কনভেনশন।
সাইপ্রাস সফরের সময় ইইউর শীর্ষ কূটনীতিক জোসেফ বোরেল বলেন, যে দেশগুলো রোম কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে তারা আদালতের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে বাধ্য। এটি কোনো ঐচ্ছিক রায় নয় যে মানলাম না। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, সেই একই বাধ্যবাধকতা রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদান করতে আগ্রহী দেশগুলোর জন্যও। যুক্তরাষ্ট্র আইসিসির সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ইসরাইল বলেছে আইসিসির পদক্ষেপ ইহুদিবিরোধী।
তবে জোসেফের কণ্ঠে ভিন্ন সুর। তার দাবি, ইহুদি বিদ্বেষের অভিযোগ ছাড়াই ইসরাইলি সরকারের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করার অধিকার আমার আছে, সেটা নেতানিয়াহু হোক বা অন্য কেউ হোক। ইহুদি বিদ্বেষের অভিযোগ তোলা গ্রহণযোগ্য বরং আইসিসির রায় যথেষ্ট সঙ্গতিপূর্ণ।