বাংলাদেশী নাগরিক প্রবাসীদের লাশ আসছে প্রতিনিয়ত। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৩ সাল থেকে গত ৩১ বছরে ৫২ হাজার ৩৭১ প্রবাসীর লাশ দেশে এসেছে। এই তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছরই লাশের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। এর বাইরেও মৃত্যুর ঘটনা আছে এবং সেসব মৃত ব্যক্তির লাশ দেশে আসেনি। অনেক লাশ বিদেশের মাটিতেই দাফন করা হয়।
নাম দিয়েছেন রেমিটেন্স যোদ্ধা। কিন্তু এসব সম্মানিত যোদ্ধাদের জন্য রাষ্ট্র কি করছেন সেটা খতিয়ে দেখার কেউ নেই।
বাংলাদেশের অর্থনীতির কথা বললে রেমিটেন্সের কথা আগে আসবে। অথচ এই রেমিটেন্স পাঠানো ব্যক্তিদের দুর্দশার কথা বলার যেন কেউ নেই। আর বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসে তো শ্রমিকদের কোনো ঠাঁই হয় না। আমি নিজেও দেখেছি সে অবস্থা। প্রকৃত পক্ষে শ্রমিকদের দুর্দশা শুরু হয় ঢাকা বিমানবন্দর থেকেই। এই দুর্দশা প্রবাস জীবনের পুরোটা সময় বয়ে বেড়াতে হয়। অথচ সরকারের একটু সহায়তা তাদের মুখে হাসি ফোটাতে পারতো। কারণ প্রবাসে যাওয়ার আগে সরকারের খোঁজখবর নেওয়া, স্বাস্থ্য পরীক্ষার সরকারি উদ্যোগ, অবৈধভাবে বিদেশ গমনে কড়াকড়ি আরোপসহ অনেক বিষয় আছে সরকার ও সংশ্লিষ্টরা আন্তরিক হলেই কেবল সেগুলোর সমাধান হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক পাঠানোর ব্যাপারে আরো বেশি নজরদারি বাড়ানো দরকার। আর দূতাবাসগুলো যেন শুধু সরকারের প্রতিনিধি এবং ভিআইপিদের আচার অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ না থেকে শ্রমিক শ্রেণির বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে এগিয়ে আসে সেদিকেও দৃষ্টি দেওয়া উচিত। শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্স আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। আমাদের একথা ভুলে গেলে চলবে না। তাই প্রবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুর মিছিল যেন আর বড় না হয় সে ব্যাপারে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।
প্রবাসী শ্রমিকের লাশ দেশে এলে বিমানবন্দরে অবস্থিত প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের মাধ্যমে দাফন ও লাশ পরিবহনের জন্য ৩৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়, ফলে লাশের একটা হিসাব পাওয়া যায়।
সেই হিসাব অনুযায়ী দেখা যায়, ২০০৫ সালের পর থেকে দেশে প্রবাসীদের লাশ আসার সংখ্যা বাড়ছে। ২০০৫ সালে লাশ এসেছে ১ হাজার ২৪৮ জনের, ২০০৬ সালে ১ হাজার ৪০২, ২০০৭ সালে ১ হাজার ৬৭৩, ২০০৮ সালে ২ হাজার ৯৮, ২০০৯ সালে ২ হাজার ৩১৫, ২০১০ সালে ২ হাজার ৫৬০, ২০১১ সালে ২ হাজার ৫৮৫, ২০১২ সালে ২ হাজার ৮৭৮, ২০১৩ সালে ৩ হাজার ৭৬, ২০১৪ সালে ৩ হাজার ৩৩৫, ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৩০৭, ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৪৮১, ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৩৮৭, ২০১৮ সালে ৩ হাজার ৭৯৩, ২০১৯ সালে ৩ হাজার ৬৫১ জন, ২০২০ সালে ৩ হাজার ১৪০, ২০২১ সালে ৩ হাজার ৮১৮ জন, ২০২২ সালে ৩ হাজার ৯০৪, ২০২৩ সালে ৪ হাজার ৫৫২টি লাশ এসেছে দেশে। দেশ বা অঞ্চল অনুযায়ী ভাগ করলে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি লাশ আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। কাজের জন্য যারা বিদেশে যান তাদের প্রায় সবাই বয়সে তরুণ-যুবক। তাদের কেউ কোনো রোগে মারা গেলে সেটিকে স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু দেখা যায়, প্রবাসীদের বেশিরভাগ মৃত্যুর কারণ হচ্ছে দুর্ঘটনা। যদিও প্রবাসী কর্মীদের মৃত্যুর কারণ জানতে সরকারিভাবে কোনো গবেষণা হয়নি।
বৈধভাবে কাজের নিশ্চয়তা, দেশ থেকে যাবার সময় যে অর্থ ব্যয় হয়েছে তা তুলে আনার তাগিদ এবং আত্মীয়-পরিজনহীন থাকার পরিবেশ, এসব কিছু মিলিয়ে তাদের স্ট্রেস বা মানসিক অনেক বেশি থাকে।
তবে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, প্রবাসী কর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা যান মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত বা ব্রেন স্ট্রোকের কারণে। আবার মৃতদের একটা বড় অংশই মধ্যবয়সী কিংবা তরুণ। এ ছাড়াও হৃদরোগসহ বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, সড়ক দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা কিংবা প্রতিপক্ষের হাতেও খুন হন বাংলাদেশিরা। এসব মৃত্যুর ক্ষেত্রে বয়স পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বেশিরভাগই মারা গেছেন ৩৮ থেকে ৪২ বছরের মধ্যে এবং কাজে যোগদান করার অল্প সময়ের মধ্যে। যার আয়ের ওপর স্বপ্ন বুনতে শুরু করে একটি পরিবার তার অকাল মৃত্যুতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার পুরো পরিবার। বেসরকারি সংস্থা অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ) ২০২০ সালের একটি জরিপ থেকে দেখা যায়, ৯৫ শতাংশ অভিবাসী কর্মীর মৃত্যুর পর আর্থিক সংকটে পড়ে যায় তার পুরো পরিবার। তার মধ্যে ৫১ শতাংশ পরিবারের ৮০ ভাগ আয় কমে যায়। ফলে প্রভাব পড়ে বহুমুখী। ৮১ শতাংশ পরিবার চিকিৎসা করার সামর্থ্য হারায়, ৬১ শতাংশ পরিবারের সন্তানরা স্কুলে যাওয়ার সক্ষমতা হারায়, আর ৯০ শতাংশ পরিবারের দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়ে বলে তারা দৈনিক খাবারের পরিমাণ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়।
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের প্রবাসীরা মারা গেলে তাদের লাশগুলোর কি হবে? এটা নিয়ে রাষ্ট্রের চিন্তা করা উচিত। তারা যা রুজি করে প্রায় সবই দেশে পাঠিয়ে দেয়। এখানে মারা গেলে তাদের লাশ দেশে পাঠানোর জন্য তারা কোনো ডিপোজিট করে রাখতে পারে না। আমরা মুখে মুখে শুধু গালভরা বুলি দিয়ে তাদেরকে ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’ বলি। বাস্তবে তাদের জন্য যা করা উচিত আমরা তা করতে পারছি না। পশ্চিমের দেশগুলোতে যারা সিটিজেনশিপ পেয়েছেন, তারা মারা গেলে আদের লাশ আর দেশে যাচ্ছে না। কারণ তাদের পরিবার এখানে এবং আল্লাহ তায়ালার হুকুম হচ্ছে কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তার লাশ খুব দ্রুত দাফন করা উত্তম।
সেপ্টেম্বর ১, ২০২৪ তারিখে কয়কেজন প্রবাসী জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে ১১ দফা দাবি জানিয়েছেন।
১১ দফা দাবি গুলো হলো
১। ১৫ বছর প্রবাসে থেকে দেশে চলে এলে যুক্তিসংগত প্রবাসী অবসরভাতা দিতে হবে।
২। প্রবাসীরা প্রবাসে কিংবা ছুটিতে দেশে এসে কোনো কারণে মৃত্যুবরণ করলে বা কর্মক্ষেত্রে শারীরিক পঙ্গুত্ববরণ করলে এককালীন তার পরিবারকে ১০ লাখ টাকা প্রণোদনা বা ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিতে হবে।
৩। কোনো প্রবাসী প্রবাসে মারা গেলে ওই প্রবাসীর লাশ রাষ্ট্রীয় খরচে এবং ব্যবস্থাপনায় দেশে ফেরত আনতে হবে এবং স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দিতে হবে।
8। প্রত্যেক প্রবাসীকে প্রবাসী পরিবার নামে বিশেষ স্মার্ট কার্ড দিতে হবে। ওই স্মার্ট কার্ড দিয়ে বাংলাদেশের সরকারি, আধা-সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসহ প্রত্যেকটি সেক্টরে প্রতিটি কাজে যেমন- মেডিকেল ট্রিটমেন্ট ইউনিয়ন অফিস, থানা, সিটি করপোরেশন, ভূমি অফিস, পরিবহন সেক্টর থেকে শুরু করে সব নাগরিক সেবায় প্রবাসীর পরিবার যেন সুফল ভোগ করতে পারে।
৫। শুধুমাত্র পাসপোর্ট, ভিসা কপি অথবা আকামা কপি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রবাসীদের সহজ শর্তে প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত বা মালিকানাধীন অন্যান্য ব্যাংক থেকে বিনা সুদে বা সহজ শর্তে গৃহঋণ, ব্যবসায়িক ঋণসহ অন্যান্য ঋণ দিতে হবে এবং কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বিদেশ গমনে আগ্রহী ব্যক্তিকেও এসব ব্যাংক থেকে ঋণ দিতে হবে।
৬। কোনো কারণে বাংলাদেশে কোনো প্রবাসীর নামে কোনো ধরনের মামলা-মোকদ্দমা হলে তা দ্রুত নিষ্পত্তির বিধি-বিধান এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৯০-১২০ দিন সময় দেওয়া যেতে পারে।
৭। প্রবাসে কোনো প্রবাসীর কোনো রকম সমস্যা হলে বাংলাদেশ দূতাবাস সব ধরনের সহযোগিতার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। প্রবাসীদের জন্য কূটনৈতিক তৎপরতার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করতে হবে। বাধ্যতামূলক দায়িত্ব পালন বা পদক্ষেপ নেওয়ার প্রশাসনিক ও আইনি কাঠামো শক্তিশালী করতে হবে।
৮। অসুস্থতার কারণে কোন প্রবাসী দেশে এলে বাংলাদেশের সব সরকারি হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসা সেবা দিতে হবে।
৯। প্রতিটি প্রবাসী পরিবারের নিরাপত্তা দিতে হবে। প্রবাসী পরিবারের সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রবাসী পরিবারের সামাজিক অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে রাষ্ট্র বা সরকার উপযুক্ত নীতিমালা ও কর্মপন্থা তৈরি করে তা যথাযথ বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নেবেন।
১০। এয়ারপোর্টে কোনো ধরনের লাগেজের ক্ষতি হলে প্রতিটি খালি লাগেজের জন্য ২০ হাজার টাকা সাত দিনের মধ্যে দিতে হবে এবং লাগেজের ভেতরের কোনো মালামাল চুরি হলে প্রতি কেজির মূল্য গড়ে ২০ হাজার টাকা করে বিমান কর্তৃপক্ষকে সাত দিনের মধ্যে দিতে হবে। এয়ারপোর্টের ট্রলি এয়ারপোর্ট পার্কিং এরিয়ায় নেওয়ার সুবিধা করে দিতে হবে।
১১। অভিবাসনের ক্ষেত্রে এবং বিদেশযাত্রায় হয়রানি প্রতিরোধ করতে হবে এবং বিমানবন্দরে জটিলতা ইত্যাদি নিরসনে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রবাসীরা বাংলাদেশে আসা এবং বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিমানবন্দরে যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত জটিলতায় পড়েন, সেসবের স্থায়ী নিরসন করতে হবে এবং প্রবাসীদের বিদেশে গমনাগমন সহজ ও সুশৃঙ্খল করার কার্যকর বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্স নিয়ে যত উচ্ছ্বাস, বিদেশে যেনতেনভাবে শ্রমিক পাঠানোর ব্যাপারে যত তৎপরতা লক্ষ করা যায় – প্রবাসে তাদের কাজ ও জীবনের নিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তা নিয়ে কি সরকার কি অন্য কারো সে অনুপাতে কোনো উদ্বেগ বা তৎপরতা আছে বলে মনে হয় না।
যে পরিবারের সমৃদ্ধির জন্য বিদেশ বিভুঁইয়ে গিয়ে কাজ করা, ফিরে এসে সেই পরিবারে ঠাঁই না পাওয়া এবং দেশে পাঠানো টাকার কোনো খোঁজ না পাওয়ার দুঃখজনক ঘটনার কথা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা এনে যারা দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করেন, তাদের জীবন ও মর্যাদার কথা কি কেউ ভাববে না? যারা মৃত্যুবরণ করছেন তাদের পরিবারের দায়, বয়সের কারণে ফিরে আসা, দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে, নির্যাতিত হয়ে ফিরে আসাদের দায়িত্ব কি নেবে না সরকার? প্রবাসে তো সারাজীবন কেউ থাকবেন না। সুতরাং ফিরে আসা প্রবাসীদের দেশে পুনর্বাসন করার পরিকল্পনা থাকতে হবে। না হলে তাদের সঞ্চিত অর্থ এবং অর্জিত দক্ষতা কোনো ভালো কাজে লাগবে না। প্রবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণার নানা ঘটনার কথা জানা আছে কিন্তু প্রতিকারের পদক্ষেপ দেখা যায় না। কেন বাংলাদেশ থেকে প্রবাস গমন ব্যয় সব দেশের চাইতে বেশি, বিমান ভাড়া বেশি, পাসপোর্ট পেতে এত হয়রানি এবং অদৃশ্য খরচ বেশি? এক কাজের কথা বলে বিদেশে পাঠিয়ে অন্য কাজে নিয়োগ করার মতো প্রতারণা করার পর ট্রাভেল এজেন্সিগুলো পার পাচ্ছে কীভাবে? প্রবাসীদের সঙ্গে এই প্রতারণা করে দেশের যে ব্যবসায়ীরা তারা কি শাস্তির আওতায় আসবে না কখনো? স্বপ্ন দেখে বিদেশে যাওয়া, পরিবারকে স্বপ্ন দেখানো মানুষগুলোর স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার কষ্ট মোচনের দায়িত্ব কি রাষ্ট্র পালন করবে না?
লাশ বিনা পয়সায় স্বদেশে পাঠানোর কেন ব্যবস্থা করা যাবে না ?
লাশটাও দেশে যাওয়া নিয়ে বিড়ম্বনা রয়েছে। মাসের পর মাস পড়ে থাকে হিমাগারে। ব্যয়বহুল এ কাজ। দূতাবাস বা কনস্যুলেট অফিস যথাসাধ্য সাহায্য করে। লাশ প্রেরণের আনুষ্ঠানিকতা করে। সব লাশ দেশে পাঠানোর অর্থ তাদের নেই। একান্ত কোন উপায় খোঁজে না পেলে বাংলাদেশ কতৃপক্ষ থেকে অর্থ সহযোগিতা করা হয় সামান্যই।
বিমান বাংলাদেশ অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ রুটে ফ্লাইট চলাচল করে হাজার কোটি টাকা লোকসান দেয়। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ফ্লাইট পরিচালনায় আরো গতিশীল হলে প্রবাসী রেমিটেন্স যোদ্ধাদের উপকার হতো। সেই সাথে বাংলাদেশ ও লাভবান হতো। টিকেট জালিয়াতি ও ভাড়া যুক্তিসঙ্গত করা জরুরি।
এদিকে,রেমিটেন্স যোদ্ধা প্রবাসীদের লাশ আনতে বেশ বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। এ টেবিল থেকে ও টেবিলে ছুটে বেড়ানোর পর লাশ আসে। এর পরে রয়েছে নিজ অর্থে লাশ আনতে হয়।
রেমিটেন্স যোদ্ধা প্রবাসীরা বলছেন , দেশে প্রতিবছর প্রবাসীরা ১৬ বিলিয়ন ডলার পাঠান। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি অর্থ আসে প্রবাসী–আয় থেকে। প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতি গড়ছেন। সরকার, ব্যবসায়ী, নাগরিক সমাজ সবাই একসঙ্গে কাজ করলে এ খাতকে আরো এগিয়ে নেয়া যাবে। বিদেশ থেকে লাশ পাঠাতে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। ইউরোপে এ চিত্র বেশি।
একটু পেছনের ইতিহাস খুঁজলেই পাওয়া যায় বেদনাদায়ক লোমহর্ষক তথ্য
২০১৭ সালের একটি পরিসখ্যান থেকে জানা যায় , সেই সময়ের ১১ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ৩০ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশির লাশ দেশে ফেরত আনা হয়েছে। প্রতিবছরই যেনো পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। ১০ বছরে যার পরিমাণ বেড়েছে দিগুণেরও বেশি। এর মধ্যে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, হৃদরোগ, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, খুন, সড়ক দুর্ঘটনা কিংবা ক্যানসারে মৃত্যুজনিত মৃতদেহ রয়েছে।
![পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রবাসী মৃত্যুহার](http://www.rtvonline.com/assets/gallery/mithun.jpg)
মানবাধিকার সংস্থা ও এনজিও ভিত্তিক তথ্য থেকে জানা যায়
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৫ সালে আসে ১ হাজার ২শ’ ৪৮ জনের লাশ, ২০০৬ সালে ১ হাজার ৪শ’ ২ জন, ২০০৭ সালে ১ হাজার ৬শ’ ৭৩ জন, ২০০৮ সালে ২ হাজার ৯৮ জন, ২০০৯ সালে ২ হাজার ৩শ’ ১৫ জন, ২০১০ সালে ২ হাজার ৫শ’ ৬০ জন, ২০১১ সালে ২ হাজার ৫শ’ ৮৫ জন, ২০১২ সালে ২ হাজার ৮শ’ ৭৮ জন, ২০১৩ সালে ৩ হাজার ৭৬ জন, ২০১৪ সালে ৩ হাজার ৩শ’ ৩৫ জন, ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৩শ’ ৭ জন, ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৪শ’ ৮১ জন প্রবাসীর লাশ এসেছে।
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে যে তথ্য পাওয়া যায়
মৃতদেহ পরিবহন ও দাফন খরচ
দেশের ০৩টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক এর মাধ্যমে বিদেশ হতে আগত মৃতদেহ পরিবারের নিকট হস্তান্তর এবং তাৎক্ষণিকভাবে মৃতদেহ পরিবহন ও দাফনের খরচ বহনের জন্য ৩৫ হাজার টাকার চেক প্রদান করা হয়।
সেবার নাম |
সেবা প্রদান পদ্ধতি |
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং প্রাপ্তিস্থান |
সেবা মূল্য এবং পরিশোধ পদ্ধতি |
বিস্তারিত জানতে |
মৃতদেহ পরিবহন ও দাফন খরচ বাবদ ৩৫ হাজার টাকার চেক প্রদান। |
বিদেশ হতে প্রবাসী কর্মীর মৃতদেহ মৃতের পরিবারের নিকট হস্তান্তরের সময় তাৎক্ষণিকভাবে ৩৫,০০/- হাজার টাকার চেক প্রদান করা হয়। |
মৃতের পাসপোর্টের কপি, স্থানীয় চেয়ারম্যান/ কমিশনার কর্তৃক প্রদত্ত ওয়ারিশ সনদ/ পরিবার সনদ, স্ত্রী/ পিতা/মাতার এনআইডির কপি, মৃতের মৃত্যু সনদ, এনওসি ও এয়ারওয়েজ বিলের মুলকপি এবং বিএমইটি’র বহির্গমন ছাড়পত্র/বোর্ডের নিবন্ধন (মেম্বারশীপ) সংক্রান্ত প্রমানক (যদি থাকে)। |
প্রযোজ্য নয়। |
কল করুন প্রবাসবন্ধু কল সেন্টারে:
১৬১৩৫ (দেশ থেকে, টোল ফ্রি )
+৮৮০৯৬১০১০২০৩০ (বিদেশ থেকে) |
বেসরকারি সংস্থা অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ) ২০২০ সালের একটি জরিপ থেকে দেখা যায়, ৯৫ শতাংশ অভিবাসী কর্মীর মৃত্যুর পর আর্থিক সংকটে পড়ে যায় তার পুরো পরিবার। তার মধ্যে ৫১ শতাংশ পরিবারের ৮০ ভাগ আয় কমে যায়। ফলে প্রভাব পড়ে বহুমুখী। ৮১ শতাংশ পরিবার চিকিৎসা করার সামর্থ্য হারায়, ৬১ শতাংশ পরিবারের সন্তানরা স্কুলে যাওয়ার সক্ষমতা হারায়, আর ৯০ শতাংশ পরিবারের দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়ে বলে তারা দৈনিক খাবারের পরিমাণ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়।
কাগজে উল্লেখিত সংজ্ঞা অনুযায়ী প্রবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণার নানা ঘটনার কথা জানা আছে কিন্তু প্রতিকারের পদক্ষেপ দেখা যায় না। কেন বাংলাদেশ থেকে প্রবাস গমন ব্যয় সব দেশের চাইতে বেশি, বিমান ভাড়া বেশি, পাসপোর্ট পেতে এত হয়রানি এবং অদৃশ্য খরচ বেশি?
মধ্যপ্রাচ্য মূলত মরু আবহাওয়ার দেশ। প্রচণ্ড গরমে প্রতিকূল পরিবেশে অদক্ষ এই বাংলাদেশিরা ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন কাজে যুক্ত থাকেন। একদিকে প্রতিকূল পরিবেশ, আরেক দিকে অমানুষিক পরিশ্রম, ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকা, দীর্ঘদিন স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা, ঋণ পরিশোধ এবং বিদেশে যাওয়ার খরচ তোলার চিন্তা, কতদিন থাকতে পারবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা এসব যে মানসিক চাপ সৃষ্টি করে তা স্ট্রোক বা হৃদরোগের কারণ হতে পারে। প্রবাসে নারী শ্রমিকদের জীবন আর এক বেদনার কাব্য গাথা যেন। দেশে কাজের সম্মান নেই, মজুরিও কম তাই ঝুঁকি আছে জেনেও মধ্যপ্রাচ্যে যেতে আগ্রহী নারী শ্রমিকরা। সাধারণত যেসব দেশে নারী কর্মীরা যায় এগুলোর মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, লেবানন, মালয়েশিয়া, জর্দান, ওমান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রুনাই, সাইপ্রাস, মৌরিতাস, হংকং, ইতালি, জাপান ইত্যাদি। দেশের তালিকাটা বড় হলেও কাজের বৈচিত্র্য তেমন নেই। স্বল্প শিক্ষিত এবং অদক্ষ নারী শ্রমিকদের প্রধান পেশা গৃহকর্ম এবং প্রধান গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্য। বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী নারীদের বড় অংশ গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরব যায়। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, গত ২০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ১১ লাখ ৬২ হাজার ৭৯১ জন নারী শ্রমিক বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন।
(লেখাটি অনেকের দেওয়া তথ্য থেকে সংগৃহীত)