“তিনি ভেবেছিলেন, তিনি আশ্রয় পেয়েছেন। কিন্তু, এখন হয়তো তাকে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হতে হবে” —এমনই শিরোনামে ২০২০ সালের ২৪ জুলাই একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ‘পলিটিকো (POLITCO).’ প্রতিবেদনে লেখা ছিল, “বহু বছর আগে ঘটে যাওয়া এক অভ্যুত্থানের সাথে রাশেদ চৌধুরী জড়িত ছিলেন। তার নিজ দেশ তাকে ফিরিয়ে নিতে চায়।”
এই খবর প্রকাশিত হওয়ার পর, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদমাধ্যমগুলো যেন উন্মত্ত হয়ে ওঠে। খুব শীঘ্রই রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে এনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে—এমন খবর ছড়িয়ে পড়ে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি শেখ মুজিবুর রহমান, যাকে তারা “বঙ্গবন্ধু” আখ্যা দেয় এবং “জাতির পিতা” হিসেবে সমাদৃত করে, তার “স্বীকারোক্তিমূলক খুনি”। এই মহোৎসব পরিণত হয়েছিল প্রতিশোধপরায়ণ হাসিনাকে তুষ্ট করার এক প্রতিযোগিতায়, যিনি প্রায় সাড়ে চার দশক আগে তার পিতার বাকশাল একনায়কতন্ত্রের অবসানের জন্য দায়ী নেতাদের রক্তের পিপাসায় মরিয়া ছিলেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে রাশেদ চৌধুরীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে আনার কৃতিত্ব নিতে প্রতিদিন সাংবাদিকদের সামনে আসেন। তিনি ঘোষণা দেন যে, এটি মুজিববর্ষ উদযাপনে (২০২০-২০২১) এক নতুন মাত্রা যোগ করবে। তিনি আরো বলেন, “কয়েক মাসের মধ্যেই এই ফাঁসির দৃশ্য দেখা যাবে।” এমনকি ভারতীয় গণমাধ্যমেও খবরটি ছড়িয়ে পড়ে যে, এটি ঢাকাকে বেইজিংয়ের প্রভাব থেকে দূরে রাখার জন্য কোনো চুক্তির অংশ হতে পারে।
শেখ হাসিনা প্রশাসন রাশেদ চৌধুরীকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানোর জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিল: মৃত্যুকক্ষ (Death Cell) থেকে শুরু করে ফাঁসির দিন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। চৌধুরীর গ্রামে আওয়ামী লীগের সমর্থকরা প্রচার চালায় যে, “বঙ্গবন্ধুর খুনি” কে তাদের গ্রামে সমাধিস্থ হতে দেওয়া হবে না।
বাংলাদেশে সবকিছু শেখ হাসিনার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল ছিল তখন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইনের শাসন কার্যকর আছে এবং সেখানে আইনি প্রক্রিয়া সাধারণত তার নিজস্ব গতিতে চলে। মার্কিন এটর্নি জেনারেলের অফিসে চৌধুরীর মামলাটি জটিল ও সংবেদনশীল হিসেবে বিবেচিত হয়। ইতোমধ্যে, এই মামলার পর্যালোচনা (রিভিউ)র বিরুদ্ধে, তথা রাশেদ চৌধুরীর স্বপক্ষে, বহু বিশিষ্ট বিচারক, আইনি বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকার সংগঠন, এবং শীর্ষ পর্যায়ের অভিবাসন আইনজীবীরা তাদের কড়া প্রতিবেদন পেশ করেছেন এটর্নি জেনারেল (বিচারিক মন্ত্রণালয়) এর কাছে।
চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনার জন্য শেখ হাসিনা প্রশাসন একাধিকবার যুক্তরাষ্ট্রকে তাড়া দিয়েছিল। এবং তারা দাবি করে এটি যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের জন্য “গেম চেঞ্জার” হবে। দেশের অভ্যন্তরে, জনগণকে বোঝানো হয় যে, চৌধুরীর ফাঁসিই বাংলাদেশের ভবিষ্যতের সব সমস্যার সমাধান।
স্বনামধন্য ও নিয়মিত লেখক রাশেদ চৌধুরী, সম্প্রতি তার নতুন বই ‘A Soldier and the War Within: Post-Independence Bangladesh’ প্রকাশ করেছেন। বইটির ভূমিকায় তিনি লিখেছেন:
বহু প্রতীক্ষার পর আমার নতুন বই ‘A Soldier and the War Within: Post-Independence Bangladesh’ অবশেষে প্রকাশিত হয়েছে। বইটির প্রকাশ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিনের জটিলতা এবং শেষ মুহূর্তে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। ‘A Soldier and the War Within (SWW)’ আমার আগের বই ২০১৫ সালে প্রকাশিত, ‘A Soldier’s Debt (ASD)’ এর পরের খণ্ড। ASD যেখানে শেষ হয়েছিল, SWW সেখান থেকে শুরু, অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে স্বাধীনতার সময় থেকে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল নিষ্ঠুর এবং যন্ত্রণাময়। স্বাধীনতা অর্জনের পথে লাখো মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, আহত হয়েছে, এবং দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছে। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে শান্তি ও সমৃদ্ধির আশা করা হলেও বাস্তবে তা হয়নি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রচুর সহানুভূতি ও আর্থিক সহায়তা সত্ত্বেও নতুন নেতৃত্ব দেশকে একপ্রকার ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে যায় এবং ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ তে পরিণত করে। শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি তার সারাজীবন গণতন্ত্র ও বাঙালিদের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছেন, ক্ষমতায় এসে এক জঘন্য স্বৈরাচারে পরিণত হন। ৩০,০০০ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা করা হয়, ৬২,০০০ জনকে কারাগারে পাঠানো হয়, আর ব্যাপক দুর্নীতির ফলে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, যা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ১৫ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়।
‘Post-Independence Bangladesh’ কিছুটা লিপিবদ্ধ করিয়েছে কীভাবে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পদদলিত করা হয়েছিল এবং কীভাবে নির্মম একনায়কতন্ত্র দেশটিকে দুর্দশার অন্তহীন গহ্বরে ঠেলে দেয়। ১৯৭৫ সালের ঐতিহাসিক ১৫ই আগস্ট বিপ্লব জনগণের জন্য স্বস্তি বয়ে আনে। নতুন নেতৃত্বের অধীনে দেশ তার পরিচিতি পায় এবং সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যায়।
যেমন গাছ তেমন ফল । দুই দশক পরে শেখ হাসিনা তার বাবার রূপ নিয়ে ফিরে আসেন এবং দ্বিগুণ গতিতে মুজিবের পরম্পরা (Legacy) এগিয়ে নিয়ে যান । প্রতিশোধপরায়ণ হাসিনা দেশকে রক্ষাকারী নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেন এবং স্তম্ভিত জাতিকে নিঃশব্দে এসব দেখতে হয়।
অর্ধ শতাব্দী পর, দেশের ভুক্তভোগী মানুষ প্রার্থনা করেছে যেন ১৫ আগস্টের নেতারা যাদের তারা ভালোবেসে ‘সূর্য সন্তান’ ডাকে, তাঁরা আবার ফিরে আসে দেশকে উদ্ধার করতে। তাদের প্রার্থনা বৃথা যায়নি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, এক নতুন প্রজন্মের সূর্য সন্তানরা আবির্ভূত হয় এবং ফ্যাসিস্ট পিতার ফ্যাসিস্ট কন্যা শেখ হাসিনাকে উৎখাত করে।