সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রাণস্পন্দন অনাস্থা ভোট। অনাস্থা ভোটহীন গণতন্ত্র প্রকৃত পক্ষে কোনো সংসদীয় গণতন্ত্র নয়। অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে গণ ক্ষমতার কার্যকারিতা এবং সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয় । অথচ বিগত ৫৩ বছরে বাংলাদেশের সংসদে অনাস্থা প্রস্তাবের কোনো ঘটনা ঘটেনি । দলের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দেয়া এমপির সহজাত ক্ষমতা। এটা কেড়ে নিলে ফ্যাসিবাদ বা মাফিয়া তন্ত্র অনিবার্য হয়ে যায়। খুব সুকৌশলে নানা অপযুক্তি দিয়ে অনাস্থা ভোটের বিপক্ষে বাঙালি জনমত তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৭(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যগণ যে কোনো সময় প্রধানমন্ত্রীকে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে। সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রী একজন এমপি মাত্র। এর বেশি কিছু নন। একজন এমপি কেবলমাত্র তখনই প্রধানমন্ত্রী হন যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপি তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চান। যদি না চান তাহলে প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাচ্যুত হবেন এটাই প্রকৃত সংসদীয় গণতন্ত্র। কিন্তু জ্ঞানপাপীরা কোনোদিন বিষয়গুলো জনগণের কাছে খোলাসা করে না। অর্থাৎ সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্র ক্ষমতা থাকবে এমপিদের হাতে। কারণ জনগণ তাদের নিজ নিজ রাষ্ট্র ক্ষমতা ভোটের মাধ্যমে সরাসরি অর্পণ করে এম পিকে। দল বা প্রতীক কে নয়। দল বা প্রতীক নানা কায়দা করে ক্ষমতাটা নিজের হাতে নিয়ে নেয়।
মনোনয়নের চূড়ান্ত ক্ষমতা দলের হাই কমান্ডের হাতে থাকা উচিৎ নয়। হাই কমাণ্ড মনোনয়ন নীতিমালা তৈরী করবে। সেই নীতিমালা মোতাবেক তৃণমূলের কর্মীরা তাদের নিজ নিজ প্রার্থী বাছাই করবে। হাই কমাণ্ড শুধু দেখবে নীতিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা। এটা করা হলে তো মনোনয়ন বাণিজ্য বলে কিছু থাকার কথা নয়। এমপিদের দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হবার ভয় থাকলে কোনো প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিবাদী হতে পারে না। যদি ভয় না থাকে তাহলে ফ্যাসিবাদী হবার সম্ভাবনা থাকে। এমপিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায় সংবিধানে ভোট রিকল করার বিধান সন্নিবেশিত করে। তাহলে এমপিদেরও ঘোড়ার মত আর বিক্রি হবার আশংকা থাকে না। এর ফলে জনগণের প্রদত্ত রাষ্ট্র ক্ষমতা জনগণের হাতেই আবার ফিরে আসে। সরকার বিপথগামী হতেই পারে। সরকার বিপথগামী হলে সরকারের যে কোনো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা এমপির মৌলিক অধিকার। দলত্যাগ করলে এমপির সদস্যপদ বাতিল হতে পারে। কিন্তু তাকে বরখাস্ত করলে বা বিপক্ষে ভোট দিলে তার সদস্যপদ বাতিল হওয়া উচিৎ নয়। কেননা যে কোনো প্রধানমন্ত্রী এ ক্ষমতার অপব্যবহার করে ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপি একজন এমপির বিরুদ্ধে অনাস্থা আনার মাধ্যমে অন্য আরেক জন এম পির প্রতি আস্থা আনতে পারে। এতে করে এমপিদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী হবার একটি সুস্থ প্রতিযোগিতা এবং জবাবদিহিতার পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। জনগণের উচিৎ প্রধানমন্ত্রী হবার যোগ্য মানুষটিকে এমপি নির্বাচিত করা। তাহলে বার বার দেশকে এক নেতা এক দেশ তত্ত্বের গ্যাঁড়াকলে পড়তে হয় না।
সরকারের স্থিতিশীলতার নামে একজন প্রধানমন্ত্রীকে সিংহাসনে চিরস্থায়ী করা পার্লামেন্টের কাজ নয়। প্রধানমন্ত্রী অনিয়ম করলে বা আস্থা হারালে তাকে সরিয়ে ভাল প্রধানমন্ত্রী আনাই পার্লামেন্টের এক নম্বর কাজ এবং এটাই পার্লামেন্টের কাছে তথা জনগণের কাছে প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা। আমাদের দেশের দলীয় বুদ্ধিজীবীগণের কাছে অনাস্থা ভোট খুব নিন্দনীয় একটি কাজ। সংসদে ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদের কাজ হল অনাস্থা ভোট চিরতরে বন্ধ করা। ইংল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে অনাস্থা ভোটের ঘটনা অনেক ঘটেছে। অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে অহরহ সেটা ঘটছে। অথচ বাংলাদেশে এ জাতীয় ঘটনা একবারও কেনো ঘটলো না তা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা দরকার। সাংবিধানিক আদালতের রায়ে থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলেন। বাংলাদেশে আপীল বিভাগ সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে সাংবিধানিক আদালতের দায়িত্ব পালন করে। বাংলাদেশের আপীল বিভাগ অদ্যাবধি এ জাতীয় কোনো রায় দিতে পারেনি কেনো ? কারণ বাংলাদেশে আমরা অর্থ লোভমুক্ত এবং ক্ষমতা লিপ্সাহীন দেশ চালানোর যোগ্য হাজার হাজার রাজনীতিবিদ তৈরী করতে পারছি না। কিভাবে নানা অপকৌশলের মাধ্যমে ক্ষমতা নিজের হাতে ধরে রাখা যায় সেটা বাঙালি নেতার কাছ থেকে সারা বিশ্বকে শিখতে হবে। ভোটাররা কাকে ভোট দেয়? ব্যক্তিকে না প্রতীককে ? জনগণ বাছাই করে কাকে? ব্যক্তিকে না প্রতীককে? প্রতীক সর্বস্ব একদিনের গণতন্ত্রে সকল ভোট দলীয় প্রধান ৫ বছরের জন্য পেয়েছে বলে গণ্য করা হয়। এ কারণে দলীয় প্রধান তাঁর হুকুম না মানলে যে কোনো এমপিকে যখন তখন সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ মোতাবেক বরখাস্ত করতে পারে। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ সরাসরি ভোট দিয়ে তাদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে। তাঁর সংসদ সদস্য পদ বাতিল করার একমাত্র এখতিয়ার থাকা উচিৎ জনগণের। প্রধানমন্ত্রীর তা থাকা উচিৎ নয়। প্রধানমন্ত্রীকে জনগণের ভোট নাকচ করার ক্ষমতা ন্যস্ত করলে গণতন্ত্রের কোনো অস্তিত্ব থাকে না এবং জনগণেরও কোনো ক্ষমতা থাকে না। জনগণ তাদের প্রদত্ত ভোট যে কোনো সময় রিকল করতে পারে।
সংবিধানে এ মর্মে সুস্পষ্ট বিধান থাকা উচিৎ। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ শুধু গণতন্ত্র এবং মৌলিক অধিকার পরিপন্থী নয়। সংবিধান পরিপন্থীও বটে। এই অনুচ্ছেদের জন্য এমপিরা সংসদে তাঁদের মৌলিক অধিকার অনুশীলন করতে পারছে না। অনুচ্ছেদ ৫৭(২) অনুশীলন তো অনেক দূরের কথা। এজন্য আমরা জাতীয় সংসদে অনাস্থা ভোটের কোনো ঘটনা ঘটতে দেখছি না। আবার সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ মোতাবেক রাষ্ট্রের সকল গুরত্বপূর্ন ব্যক্তিদের নিয়োগকর্তা প্রধানমন্ত্রী। এ ক্ষমতাবলে প্রধানমন্ত্রীর হাতে আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগ , গণমাধ্যম এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলে আসে। এ দুটি অনুচ্ছেদ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে সাংবিধানিক ঈশ্বর বানায়। এ দুটি অনুচ্ছেদ বহাল থাকলে এক নেতা এক দেশ তত্ত্ব থেকে বাংলাদেশ কোনোদিন বের হতে পারবে না।
এজন্য মাফিয়াতন্ত্র এবং ফ্যাসিবাদের জন্য ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে সাংবিধানিক দুর্বলতায় মূখ্য। অনেকে বলে থাকেন সংবিধান কী দোষ করলো। সংবিধান কেনো বদলাতে হবে। ব্যক্তি খারাপ হলে সংবিধান কী করবে। কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থে জ্ঞানপাপীরা জনমনে এসব ফ্যালাসি দিয়ে বিভ্রান্তি তৈরী করে। অথবা তারা এ দুটি অনুচ্ছেদের হাকীকত উপলব্ধি করতে পারে না। যাতে সংবিধানের ঘাটতি শুধরাতে কেউ আগ্রহী না হয়। বাংলাদেশের সকল চাঁদাবাজি, সকল সন্ত্রাস এবং সকল দুর্নীতির বীজ লুকিয়ে আছে এই দু অনুচ্ছেদের ভিতরে। এই দুই অনুচ্ছেদ দেশে এমন মানুষ সৃষ্টি করেছে যারা জনগণের বুকে গুলি চালায়, ব্যাংক ও শেয়ার মার্কেট লুট করে এবং বিদেশে টাকা পাচার করে। কাজেই এই আইনের শাসনে কোনো আইনকে এমনটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। সংবিধান এবং আইন ঠিক থাকলে দেশের এ বেহাল দশা হতো না। এ সব আইন সংস্কার না করে মূল্যবোধের অবক্ষয় বলে হাজার চিৎকার করলেও দেশের কোনো পরিবর্তন হবে না।
নিছক পেশাস্বার্থ আদায়ের জন্য বাংলাদেশে কোনো পেশাজীবী সংগঠন গড়ে ওঠেনি। এগুলোকে ভ্রাতৃপ্রতিম বা সহযোগী সংগঠন বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এগুলো একেকটি রাজনৈতিক দলের অংগ সংগঠন। এই অংগ সংগঠন গুলোর মাধ্যমে পেশাজীবীদের অনেকটা জোর পূর্বক দলীয়করণ করা হচ্ছে। পেশাজীবীদের এহেন দলীয়করণ পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশে নেই। এটাকে গণতন্ত্রের বাংলাদেশ মডেল বলা যেতে পারে। এর ফলে শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনের নেতারা শ্রমিকদের দাবি দাওয়া আদায় না করে রাজনীতির নামে ধান্দাবাজি করে শত শত কোটি টাকার মালিক হচ্ছে। ছাত্র শিক্ষকদের নিজস্ব হাজার হাজার সমস্যা আছে । কিন্তু সেগুলোর সমাধানে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করে তারাও রাজনীতির নামে ধান্দাবাজিতে লিপ্ত। আমাদের সংবিধানে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান থাকলেও নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সমাজ তথা সিভিল সমাজের সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। সাংবিধানিক ভিত্তি থাকলে বিগত সরকার এত সহজে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করতে পারতো না । সংবিধানে সিভিল সমাজের অন্তত একটা পরিচ্ছেদ থাকা দরকার। তা না থাকার ফলে বাংলাদেশের কোনো পেশার লোকের পক্ষে নির্দলীয় বা নিরপেক্ষ থাকা সম্ভব হচ্ছে না। সিভিল সমাজের কোনো আইনী ভিত্তি না থাকলে এদেশে সিভিল সমাজ কোনোদিনই শক্তিশালী হতে পারবে না। নিরপেক্ষতার কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি না থাকার দরুন পেশাজীবীগণ সিভিল সমাজের অন্তর্ভূক্ত হতে পারছে না। এ কারণে এ দেশে শক্তিশালী সিভিল সমাজের বিকাশ ঘটছে না। জন্ম লগ্ন থেকে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ সক্রিয় নয়–নিষ্ক্রিয়। বিদ্যমান দুর্বল সিভিল সমাজ ভঙ্গুর গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় উল্লেখযোগ্য কোনো অবদান রাখতে পারছে না।
ছাত্র সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করতে গিয়ে তারা নিজেদের ন্যায্য দাবি গুলো আদায় করতে পারছে না। বর্তমানে দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষিত বেকার উৎপাদন করছে। কর্মসংস্থানের দায়িত্ব কেউ নিতে নারাজ। অথচ অভিভাবক সম্প্রদায় কর্মসংস্থানের প্রত্যাশায় নিজ নিজ সন্তানদের পিছনে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করছে । ছাত্ররাও কঠোর পরিশ্রম করছে। কিন্তু তা কোনো কাজে লাগছে না। দুর্বল বেসরকারী খাত এবং ছাত্রজীবনের পর জ্ঞান চর্চা অব্যাহত না রাখার জন্য ছাত্র শিক্ষকদের অর্জিত জ্ঞানের প্রায়োগিক ও আর্থিক কোনো মূল্য নেই। ছাত্র এবং শিক্ষক সমাজ ঐক্যবদ্ধ থাকলে সরকারের কাছ থেকে যে কোনো ন্যায্য দাবি আদায় করা সম্ভব। কতিপয় ছাত্র ও শিক্ষকের ধান্দাবাজির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি। এই নোংরা ও নষ্ট রাজনীতি থেকে কখনো গণতান্ত্রিক নেতা তৈরী হওয়া সম্ভব নয়। বরং ছাত্রস্বার্থ ভিত্তিক স্বাধীন ছাত্র রাজনীতি থেকে ভাল নেতা তৈরীর সম্ভাবনা আছে।যার ভুরি ভুরি নজির পৃথিবীতে আছে।