পাঠ্যবই নিয়ে বড় সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। ২৩৫০ কোটি টাকার পাঠ্যবই মুদ্রণে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও কেলেঙ্কারীর অভিযোগ উঠেছে। আর এ কারণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা আগামী তিন মাসেও পাঠ্যবই পাবে না। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তফা জব্বারের ভাই আনন্দ প্রিন্টার্সের মালিক রাব্বানী জব্বারের নেতৃত্বাধীন মুদ্রণ শিল্প সমিতির অধিকাংশ নেতা বিগত ফ্যাসিবাদ চেতনার ও আওয়ামী লীগের সমর্থক। বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির গত নির্বাচনে রাব্বানী জব্বার ও কাউসার-উজ-জামান রুবেলের নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক পরিষদ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। তারাই এখন এ সবকিছুর নাটেরগুরু। বিগত ১৫ বছরে মুদ্রণ শিল্পের পেশাদার প্রকৃত ব্যবসায়ীদের জোরপূর্বক হটিয়ে ও ব্ল্যাকলিস্ট করিয়ে তারা যথেচ্ছভাবে নিম্নমানের পাঠ্যবই ছাপিয়ে এনসিটিবির সহযোগিতায় হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ওই চক্রটি। এমন কী প্রতি বছর এনসিটিবির বিভিন্ন পদ নিলামে উঠেছে কোটি কোটি টাকায়। এবারও চক্রটি এনসিটিবির শীর্ষ কর্তাদের কোটি কোটি টাকা অফার করেও উদ্দেশ্য পূরণে সফল হয়নি। এরপর থেকেই পাঠ্যবই মুদ্রণে টালবাহানা চলছে।
এনসিটিবির সূত্র জানায়, বিগত ১৫ বছরে নিম্নমানের পাঠ্যবই ছাপিয়ে সরকারের হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে মুদ্রণ শিল্পের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম ও নিম্নমানের বইছাপানোর সাথে জড়িত ছাপাখানার মধ্যে রয়েছে-অগ্রনি প্রিন্টিং প্রেস, কর্ণফুলি আর্ট প্রেস, আনন্দ প্রিন্টার্স লি., কচুয়া প্রেস এন্ড পাবলিকেশন, সরকার প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং অন্যতম।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনসিটিবির শীর্ষ পর্যায়ের দুজন কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, অতীতে কী হয়েছে তা আমরা জানি না, তবে এবার আমাদেরও বিভিন্নভাবে ঢাকায় ফ্ল্যাট ও কোটি টাকার অফার করা হয়েছে। কিন্তু তাদের এ ধরনের অনৈতিক অফারে আমরা নতি শিকার করিনি, পাঠ্যবইয়ের মানের ক্ষেত্রেও কোনো ধরনের ছাড় দেয়নি বলেই তারা এ ধরনের টালবাহানা শুরু করেছে।
ষড়যন্ত্র ও কেলেঙ্কারীর অভিযোগ অস্বীকার করে মুদ্রণ শিল্প সমিতির লোকেরা বলছেন, সময় কম, বাজারে কাগজ ও আর্ট পেপারের সংকট রয়েছে। এ কারণে তারা সময়মত পাঠ্যবই ছাপাতে পারছেন না। তবে এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলছেন, বাজারে কাগজ ও আর্ট পেপারের কোনো সংকট নেই, এটা তাদের টালবাহানা এবং সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে তাদের গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাউসার-উজ-জামান রুবেল বলেন, অভিযোগগুলো সঠিক নয়। জুলাই থেকে যেখানে প্রতি বছর কাজ শুরু হয়, সেখানে এবার অনেক পরে শুরু হয়েছে। এরপর আবার বাজারে কাগজ ও আর্ট পেপারের সংকট রয়েছে। আমরা রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা কাজ করছি। পাঠ্যবই নিয়ে আমাদেরও দায়বদ্ধতা রয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন ফেব্রুয়ারির মধ্যে ছাপার কাজ শেষ হয়ে যাবে। তবে তিনি এনসিটিবি শীর্ষ কর্তাদের ঘুষ অফার এবং সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন দাবি করেন।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. একেএম রিয়াজুল হাসান বলেন, এবার পাঠ্যবইয়ের মান বজায় রাখতে এনসিটিবি কঠোর অবস্থানে থাকার কারণে তারা বিভিন্ন অজুহাতে বই ছাপাতে দেরি করছে। এক পর্যায়ে তাদের যাতে ছাড় দিয়ে এনসিটিবি নিম্নমানের বই গ্রহণ করে এজন্য তারা শুরু থেকেই টালবাহানা করে আসছে। সরকারের বিরুদ্ধে তাদের গভীর ষড়যন্ত্রের বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও গোয়েন্দা তথ্যেও আমরা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া গেছে। বিষয়টি সরকারের খতিয়ে দেখা উচিত।
চেয়ারম্যান বলেন, ৯৯টি প্রেসের একদিনে ১ কোটি ৪২ লাখ পাঠ্যবই ছাপানোর সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তারা পাঠ্যবই না ছাপিয়ে কোনো প্রেস নোট-গাইড বই ছাপাচ্ছে এমন তথ্যও আমাদের কাছে রয়েছে। অতীতেও তারা এ ধরনের টালবাহানা করে একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে নিউজপ্রিন্ট কাগজ দিয়ে পাঠ্যবই ছাপিয়ে সরবরাহ করে সবাই মিলেমিশে সরকারের কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছে। কিন্তু এবার তা হতে দেওয়া হবে না।
কোনো কোনো ছাপাখানার মালিক কর্তৃক ঘুষ অফারের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, বড় পদে থেকে সবকিছুই সবসময় বলা যায় না। একেবারে ভিত্তিহীন নয়। তবে পাঠ্যবইয়ের মানের বিষয়ে এবার কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান আরও বলেন, মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতারা আন্তরিক হলে চলতি মাসেই সব পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানো সম্ভব। অন্যথা, তিন মাসেও সম্ভব না।
এবার চার কোটির মতো শিক্ষার্থীর জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ৪১ কোটি বই ছাপানো হচ্ছে। ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪১ কোটি পাঠ্যবইয়ের বিপরীতে ২৫ শতাংশও বই ছাপা হয়নি। এনসিটিবির মতে, বুধবার পর্যন্ত প্রাথমিকে ৯ কোটি ৬৪ লাখ বইয়ের মধ্যে ৫ কোটি লাখ ৭৫ হাজার ৬৯৭টি এবং মাধ্যমিকে ৩১ কোটি বইয়ের মধ্যে ৫ কোটি ৯৫ লাখ ৫৭ হাজার ৬৮৬টি বই ছাপা হয়েছে।
এদিকে বিনামূল্যের পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে না পৌঁছলেও রাজধানীর বিভিন্ন লাইব্রেরিতে মিলছে প্রথম থেকে দশম শ্রেণির সব পাঠ্যবই। আর সন্তান পিছিয়ে যাবে, এ দুশ্চিন্তায় অভিভাবকরাও এসব বই লাইব্রেরি থেকে কিনছেন বেশি টাকা দিয়ে।
বিনামূল্যে বিতরণের এসব পাঠ্যবই বাজারে বিক্রির সত্যতা পেয়েছে এনসিটিবিও। কিন্তু জনবল সংকটের কারণে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে দাবি করেছেন বোর্ডের কর্মকর্তারা। তবে এনসিটিবির চেয়ারম্যান বলছেন, খোলা বাজারে বই বিক্রি বন্ধে এনসিটিবির মনিটরিং টিম কাজ করছে।
দৈনিক আমারদেশ