• ১৫ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ৩০শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ২৪শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা ও ছাত্ররাজনীতির প্রথম শহীদ নজির আহমদ

usbnews
প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৫
নিউজটি শেয়ার করুনঃ

the first martyr of dhaka university nazir ahmed

নজির আহমেদ চল্লিশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রনেতা ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার তিনি প্রথম শিকার। নজির আহমেদ ফেনী জেলার আলিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৭ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর ১৯৩৯ সালে ফেনী কলেজ থেকে আই এ পাস করেন। আই এ পাসের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে জানা যায় , শহীদ নজীর আহমদের জন্ম  ১৯১৮ সনের এপ্রিল । ফেনী জিলার দক্ষিণ আলিপুর গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান হইয়াও তিনি বাল্যকাল হইতেই নিষ্ঠা আর প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখেন।

তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৪২ সালে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে সম্মান পরীক্ষার উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৩ সালে তাহর এম. এ পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল, কিন্তু সাম্প্রদায়িক হিন্দু দাঙ্গাবাজদের হাতে নিহত হওয়ায় সেই পরীক্ষা আর দেয়া হয় নাই।

East Pakistan District Gazetteers Dacca: S. N. H. Rizvi, East Pakistan Govt Press, 1969 , Ahmad, Kamruddin (১৯৭৫)। A Socio Political History of Bengal and the Birth of Bangladesh (ইংরেজি ভাষায়)। Zahiruddin Mahmud Inside Library। পৃষ্ঠা ৫২–৫৩। রফিকুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশি বছর, পৃষ্ঠা: ১০৭ সহ অনেক সূত্র থেকেই জানা যায় বিষয়টি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্ররা ২ ফেব্রুয়ারি কে শহীদ নজির দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং ১৯৪৩ থেকে শহীদ নজির দিবস উদযাপন করা শুরু করে। এছাড়াও শহীদ নজিরের স্মৃতি রক্ষায় তার বন্ধুরা সিদ্দিকবাজারে ‘শহীদ নজির লাইব্রেরি’ নামে একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

  • ‘বন্দে মাতরম’ সংগীত নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু-মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে যে রাজনীতির সূচনা হয়েছিল, তিরিশের দশকে তা চল্লিশের দশকে আমদানি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্র রাজনীতির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গেই সহপাঠীদের হাতেই নিহত হলেন নজির আহমদ। ১৯৪২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসহ স্নাতক পাস করেন। তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্রনেতা এবং পাকিস্তান আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
  • ১৯৪৩ সালের জানুয়ারিতে মুসলিম ও হিন্দু ছাত্রীদের একটি যৌথ অনুষ্ঠানে ‘বন্দে মাতরম’ গাওয়া এবং পূজার্চনার বিরুদ্ধে মুসলিম শিক্ষার্থীদের আপত্তির জের ধরে ২ ফেব্রুয়ারি ক্লাস চলাকালীন সাম্প্রদায়িক হিন্দু ছাত্রদের হামলায় তিনি গুরুতর আহত হন। মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।

১৯৪৩ সালের জানুয়ারির শেষদিকে ছাত্রীদের একটি অনুষ্ঠানে ‘বন্দে মাতরম’ গাওয়া এবং পূজার্চনা বিধিকে কেন্দ্র করে হিন্দু এবং মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ও মুসলমান ছাত্ররা মোটাদাগে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

পূর্বের ঘটনার জের ধরে ক্লাস চলাকালীন হিন্দু ও মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে শুরু হলো সহিংসতা। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে দুই দল আবির্ভূত হয় সম্মুখ সমরে। দুই দলেরই বেশ কিছু ছাত্র আহত হয়। মুসলিম ছাত্রনেতা নজির আহমদ প্রতিপক্ষের হামলায়, ছুরিকাঘাতে আহত হন।

মৃত্যু
১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারির ২ তারিখ হিন্দু ও মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে সহিংসতা চলাকালীন সময়ে তিনি ছুরিকাঘাতে আহত হন। তার বন্ধুরা তাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করে কিন্তু বিরতিহীন রক্তক্ষরণের ফলে মাগরিবের সময় তিনি ইন্তেকাল করেন। বাংলা বিভাগের শিক্ষক কবি জসীম উদ্‌দীন সারাদিন তার শয্যাপাশে ছিলেন।

No photo description available.

১৯৪৪ সালে সৈয়দ আলী আহসানের সম্পাদনায় ‘নজীর আহমদ’ নামে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
শহীদ নজিরের অন্তিমকালে তার শিয়রে থাকা কবি জসীম উদ্‌দীন একটি কবিতাও লিখেছিলেন।
ভাষাসৈনিক আবদুল গফুর বলেছিলেন , ‘১৯৪৫ থেকে ১৯৪৭—এ দু’বছরের কলেজ জীবনে এসব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনেও নিয়মিত অংশ নিয়েছি। এই উপলক্ষেই নাজিরা বাজারে “শহীদ নজির লাইব্রেরি”তে যেতাম পাকিস্তান আন্দোলনের পরিপোষক পুস্তক-পুস্তিকা ও সংবাদপত্র পাঠ ও আলোচনা সভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে।’
শহীদ নাজীর এবং ঢাবি’র প্রথম হত্যাকান্ড 
(পল্লীকবি জসীম উদ্দীন)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের চাকরী পাইয়া কাজে যোগ দিয়াই মুসলিম হলের নৈশ-বিদ্যালয়ের প্রতি আমার মন আকৃষ্ট হয়। গোটা দশ পনেরো ছেলে রাত্রে লেখাপড়া করিতে আসে। অধিকাংশ ছাত্রই মুসলিম হলের আশে-পাশের কুলী-মজুরদের ছেলেরা। কেহ অল্পবয়স্ক, কাহারও বয়স বেশী। মুসলিম হলের ছাত্ররা পালা করিয়া এক একজন এক একদিন তাহাদিগকে পড়াইতে আসে। একজন ছাত্র এইসব জনসেবার কাজের জন্য সম্পাদক নিযুক্ত হয়।
পরের বছর মুসলিম হলের এই নাইট স্কুলে যাইয়া দেখিলাম ছাত্র-সংখ্যা বাড়িয়া প্রায় পঞ্চাশ-ষাট এ দাঁড়াইয়াছে। অনুসন্ধান লইয়া জানিলাম নাজীর নামক একটি ছাত্রের চেষ্টায় নাইট স্কুলের এই উন্নতি হইয়াছে। আমি নাজীরের সঙ্গে পরিচিত হইবার জন্য সেদিনকার ছাত্র-শিক্ষকের কাছে আগ্রহ জানাইলাম। তাহাকে বারবার বলিয়া দিলাম নাজীর যেন অবশ্য আমার সঙ্গে দেখা করে; কিন্তু নাজীর আমার সহিত দেখা করিতে আসিল না। ছাত্রদের অনেক কাজে-কর্মে নাজীরের কথা শুনি। নাজীরের এই মত, সুতরাং এরূপ করা হইবে না, নাজীর এইরূপ বলিয়াছে সুতরাং ওখানে যাইতে হইবে ইত্যাদি।
একদিন আমার এক বন্ধুর বাড়িতে মুসলিম হলের তিন চারিটি পরিচিত ছাত্র আসিয়াছে। তাহাদের পরস্পরের নাম ধরিয়া আলাপ আলোচনায় কে নাজীর চিনিতে পারিলাম। রঙ কালো তামাটে, পাতলা গঠন কিন্তু শরীরের স্বাস্থ্য ভাল। মুখে হাসিটি লাগিয়াই আছে। এই নাজীর – ইউনিভারসিটিতে, মুসলিম হলে তাহাকে কতবার দেখিয়াছি। কিন্তু কোনদিনও তাহাকে একটা কেউকেটা বলিয়া মনে হয় নাই। নাজীরকে ডাকিয়া বলিলাম : ‘দেখ, মুসলিম হলের নাইট স্কুলে তোমার কাজ দেখিয়া আমার বড়ই আনন্দ হইয়াছে। আমি তোমাকে একটা পুরষ্কার দিতে চাই।’
নাজীর একটু লজ্জিত হাসিল। আমি বলিলাম: ‘আচ্ছা বাড়িতে তোমার অবস্থা কেমন?’ নাজীর বলিল : ‘স্যার। আমার অবস্থা মোটেই ভাল নয়। সবগুলি পাঠ্যবই এখনও কিনিতে পারি নাই।’ আমি বলিলাম : ‘আচ্ছা তবে চার-পাঁচ টাকার মধ্যে আমি তোমাকে একখানা পাঠ্য-বই কিনিয়া দিব। তুমি যে কোন মাসের প্রথম সপ্তাহে আমার সঙ্গে অবশ্য দেখা করিও।’ পাঠক মনে রাখিবেন সেটা ১৯৪২ সন। আমি মাত্র ১২৫ টাকা বেতন পাইতাম। নাজীর অল্প একটু হাসিল। ইহার পরে টাকা লইবার জন্য নাজীর আর কোনদিন আসে নাই। আমিও গরজ করিয়া তাহাকে কোন টাকা সাধি নাই। তাহার মত ব্যক্তিকে সাহায্য করিবার সেই ভাগ্য আমার হইল না। পরে খবর লইয়া জানিয়াছিলাম ব্যক্তিগতভাবে খুব অভাবও তাহার ছিল না। তাহার এক চাচা তাহার পড়াশুনার খরচ চালাইতেন। সেই টাকার অল্পই নাজীর নিজের জন্য ব্যয় করিত। অধিকাংশই গরীব বন্ধু-বান্ধবদের অভাব মিটাইবার কাজে লাগিত।
আমার নিজের দেশ ফরিদপুর। ঢাকা শহর হইতে তিন মাইল দূরে এক বাড়িতে আমাদের দেশের একটি ছাত্র অসুস্থ হইয়া পড়ে। সেখানে তাহার সেবা শুশ্রুষার বড়ই অভাব। নাজীরকে ডাকিয়া বলিলাম : ‘নাজীর বল ত কি করা যায়?’ নাজীর খানিক চুপ করিয়া থাকিয়া উত্তর করিল : ‘স্যার কোন চিন্তা নাই। মুসলিম হল হইতে দুইটি ছাত্র প্রতিদিন তাহাকে সেবা করিতে যাইবে।’ পরে জানিয়াছিলাম নাজীরের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালিত হইয়াছিল। নাজীর ভাল বক্তৃতা করিতে পারিত না। মুসলিম হলের ছাত্র সংসদের সভাপতি, সম্পাদক প্রভৃতি কোন পদই সে কোন দিন গ্রহণ করে নাই। কিন্তু এমন একটা কি যেন তাহার মধ্যে ছিল যে জন্য তাহার সমসাময়িক ছাত্রেরা চক্ষু মুদিয়া সে যখন যাহা বলিত তাহা পালন করিত।
ফেণীতে বোমা পড়িতেছে। আমরা ঢাকা বসিয়াই আতঙ্কে অস্থির। ষ্টেশনে নাজীরের সঙ্গে দেখা।
‘নাজীর কোথায় যাইতেছ?’ সহাস্যমুখে সালাম করিয়া নাজীর উত্তর করিল : ‘যাই স্যার, দেখিয়া আসি ওখানকার লোকজনেরা কেমন আছে।’
‘বল কি নাজীর? তোমার ভয় করে না? শুনিলাম ফেণীতে প্রতিদিনই বোমা পড়িতেছে।’
‘সেই জন্যই ত যাইতে হইবে স্যার। ভয় করিয়া কি করিব? মরিতে ত হইবেই। ফেণীর লোকগুলি কি অবস্থায় আছে একবার নিজের চোখে দেখিয়া আসি।’
গাড়ী ছাড়িয়া দিল। সহাস্য মুখে আবার সালাম করিয়া নাজীর গাড়িতে উঠিল। দূরে – বহুদূরে গাড়ী চলিয়া গেল, তবু ষ্টেশনে দাঁড়াইয়া রহিলাম। মানস-নয়নে দেখিতে পাইলাম – সুদূর ফেণীর শত শত অসহায় নরনারীর ক্রন্দন। আকাশ হইতে শত্রুর বোমা মৃত্যুর মত শেল বর্ষণ করিতেছে। দেশের অস্ত্রবিহীন শত সহস্র নর-নারী-বালক-বৃদ্ধ যে যেখানে পারিতেছে ছুটিয়া পালাইতেছে। আর ঢাকা হইতে সশব্দে রাশি রাশি ধুম্র উদগীরণ করিয়া গাড়ী চলিয়াছে। সেই গাড়ীর একটি কক্ষে নাজীর। সে আমাদেরই ছাত্র। কে বলে বাঙ্গালী মুসলিম জাগে নাই? নাজীরের মত এমনই হয়তো মুসলিম হলের সবগুলি ছাত্র। মানুষকে মানুষ ভালবাসে। সেই ভালবাসার টানই আজ নাজীরকে ফেণীতে আকর্ষণ করিয়াছে। সেই ভালবাসার আকর্ষণই বোধ হয় আজ তাহাকে এতটা নির্ভীক করিয়া তুলিয়াছে।
তারপর নাজীর বহুদিন আমার বাসায় আসিয়াছে। ‘পাকিস্তান’ কাগজের জন্য লেখা চাহিয়া আমাকে ব্যস্ত-সমস্ত করিয়া তুলিয়াছে। ‘পাকিস্তান’ ছাড়া কোন কাগজেই বোধ হয় আমি এরূপ ভাবে নিয়মিত লেখা দেই নাই। তাহা সম্ভব হইয়াছে নাজীরের তাগিদের গুণে। আজ পুরাতন কাগজপত্র ঘাটিতে ঘাটিতে এক টুকরা কাগজ চোখে পড়িল। নাজীর আমাকে বাসায় পায় নাই। ছোট একটি চিঠি রাখিয়া গিয়াছে। ‘পাকিস্তানের ঈদ সংখ্যা বাহির হইবে। স্যার! আপনার লেখা চাই-ই চাই।’ আজ নাজীর নাই। ‘পাকিস্তানের’ আরো অনেক বিশেষ সংখ্যা বাহির হইবে, কিন্তু সৌম্যমূরতী নাজীর আর লেখা চাহিয়া তাগিদ দিতে আসিবে না। নাজীরের সেই একটুকরো ছোট চিঠি খানি চিরদিন আমার বাক্সে থাকিবে।
কার্জন হলে বন্দে মাতরম গান লইয়া হিন্দু মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে যে আকস্মিক গন্ডগোল হয় তাহার খবর সকলেই জানেন।
সেদিন ছিল নিখিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজের সমাবর্তন উৎসব। এই অনুষ্ঠানে ড: হাসান (ভাইস চ্যান্সেলার) সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। সভার প্রারম্ভে মুসলমান ছাত্রদের সঙ্গে পরামর্শ না করিয়াই কতিপয় হিন্দু ছাত্র বন্দেমাতরম গানটি গাহিতে আরম্ভ করে। ইহাতে মুসলমান ছাত্রেরা প্রতিবাদ জানায়। কিন্তু হিন্দু ছাত্রেরা তাহাতে কর্ণপাত করে না। সঙ্গে সঙ্গে এদলে ওদলে চেয়ার ছুড়াছুড়ি আরম্ভ হয়। তখন যদি ড: হাসান সভা ভঙ্গ করিয়া দিতেন সমস্ত ল্যাঠা চুকিয়া যাইত। কিন্তু তিনি সবেমাত্র ভাইস চ্যান্সলার নিযুক্ত হইয়াছেন। তাহার সভাপতিত্বে সভা ভাঙ্গিয়া গেলে তাহার বদনাম হইবে তাই তিনি বারবার মুসলিম ছাত্রদিগকে অনুরোধ করিতে লাগিলেন, তোমরা চুপ কর। তাহারা চুপ করিলে হিন্দু ছাত্রেরা আবার বন্দেমতরম গানটি গাহিতে আরম্ভ করিল। ইহার পরে চেয়ার ছুড়াছুড়ি হইতে দুইদলে মারামারি আরম্ভ হইল। দুই তিন জন ছাত্র আহত হইল।
তখন ভাইস চ্যান্সেলার সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল অধ্যাপক তাহাদের প্রিয়তম ছাত্রদিগকে এই আত্মঘাতী দাঙ্গার মধ্যে ফেলিয়া যার যার মত পালাইয়া গেলেন। ইহার পরে মুসলিম ছাত্রেরা কার্জন হল হইতে বাহিরে আসিয়া হিন্দু ছাত্রদের প্রতি ইট পাটকেল ছুঁড়িতে আরম্ভ করিল। হিন্দু ছাত্রেরাও অনুরূপ মুসলিম ছাত্রদের প্রতি ইট পাটকেল ছুঁড়িতে লাগিল।
তখন আমার মনে হইল যেমন করিয়াই হোক, ছাত্রদের মধ্যে এই দাঙ্গা থামাইতে হইবে। ইহাদের পিতামাতা আমাদের উপরে নির্ভর করিয়াই নিজেদের ছেলেমেয়েদিগকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাইয়াছেন। আজ তাহারা এখানে উপস্থিত থাকিলে কিছুতেই আপন সন্তান সন্ততিদিগকে এই রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার মধ্যে ফেলিয়া যাইতে পারিতেন না। দুই সম্প্রদায়ের ছাত্রদিগকে এরূপ দাঙ্গার মধ্যে ফেলিয়া গেলে আমার ভিতরকার মানবতা অপমানিত হইবে। প্রয়োজন হইলে জীবন দিয়াও আমি এই দাঙ্গা থামাইব। একবার আমি হিন্দু ছাত্রদের মধ্যে যাইয়া তাহাদিগকে নিরস্ত্র করি অমনি মুসলিম ছাত্ররা ইট পাটকেল ছুড়িতে আরম্ভ করে। আবার মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে যাইয়া তাহাদিগকে থামাই। হিন্দু ছাত্রেরা আক্রমণ আরম্ভ করে। সেদিন যেন কোন অদৃশ্য শক্তি আমার ভিতরে আছর করিয়াছিল। একবার আমি হিন্দু ছাত্রদের মধ্যে যাইয়া তাহাদিগকে থামাইতে চেষ্টা করিতেছি এমন সময় একটি হিন্দু ছাত্র, ‘শালা জসীম উদ্দীনকে মার’ বলিয়া আমার দিকে আগাইয়া আসিল। আমি তার সামনে যাইয়া বুক পাতিয়া দাঁড়াইলাম : ‘আমাকে মারিয়া যদি তোমরা এই দাঙ্গা হইতে নিরস্ত হও তবে আমাকে মার।’ ছাত্রটি কেমন যেন নিজ্জুম হইয়া গেল। আর একবার মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে এরূপ ভাবে আবেদন করিতে গেলে আমাদের ছাত্র বদরুদ্দীন আহম্মদ অধুনা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি আমাকে গাল দিয়া বলিল : ‘জসীম উদ্দীন আসিয়াছে হিন্দুদের গোলাম হইয়া আমাদের কাছে শান্তির কথা বলিতে।’ সুন্দর ইংরেজী উচ্চরসের জন্য এবং অপূর্ব ব্যক্তিত্বের জন্য মনে মনে এই ছাত্রটিকে আমি খুবই শ্রদ্ধা করিতাম। পরদিন সে রবাহুত ভাবে নিজেই আসিয়া তাহার ইত্যকার ব্যবহারের জন্য আমার কাছে দু:খ প্রকাশ করিয়া গিয়াছিল।
প্রায় ঘন্টা দুই এইভাবে দাঙ্গা চলিতে লাগিল। আমি কিছুতেই ছাত্রদিগকে থামাইতে পারিতেছিলাম না। নাজীর সেখানে উপস্থিত ছিল না। সন্ধ্যা বেলায় সে কোথা হইতে আসিয়া মুসলিম ছাত্রদের আপন আপন ছাত্রাবাসে ডাকিয়া লইযা গেল। সাপুড়িযার মন্ত্রে যেন তাহারা উদ্যত ফনা নত করিয়া চলিয়া গেল। এই গন্ডগোলে একজন মুসলিম ছাত্র একটু বেশী প্রহৃত হয়। খবর পাওয়া গেল সেই ছাত্রটি ঢাকা হলের (হিন্দু ছাত্রাবাসের) ভিতরে আছে। নাজীর একাকি ঢাকা-হলের ভিতরে যাইয়া সেই আহত ছাত্রটিকে হাসপাতালে পাঠাইবার ব্যবস্থা করিল। নাজীরকে হিন্দু-মুসলিম সকল দলই ভালবাসিত। এই মাত্র যাহারা এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে ভীষণ দাঙ্গায় মাতিয়াছিল তাহারা নাজীরকে এতটুকুও অসম্মান করিল না।
পরদিন খবরের কাগজগুলিতে ছাপা হইল ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু-মুসলমান ছাত্রদের দাঙ্গার সময় ইহার সুযোগ্য ভাইস চ্যান্সেলার ডা: হাসান প্রাণপন চেষ্টা করিয়া ছাত্রদের দাঙ্গা থামান।’ আমার কথা কেহই উল্লেখ করিল না। এমন কি আমার সহকারী শিক্ষকেরাও কেহ আমার এই কার্যের জন্য উচ্চবাচ্য করিলেন না। করিবেনই বা কি করিয়া? তাহারা যে অসহায় ছাত্রদিগকে দাঙ্গার মধ্যে ফেলিয়া পলায়ন করিয়াছিলেন।
শহীদ নাজীরের মৃত্যুর পর আমি এই স্মৃতি কথাটি লিখিয়াছিলাম। কেন জানি না, এই স্মৃতিকথা প্রকাশের ভার যাহাদের উপর পড়িয়াছিল তাহারা উপরের এই অংশটুকু বাদ দিয়াছিলেন। সেবার কক্সবাজারের এক সভায় বক্তৃতা করিতে যাইয়া আমাদের প্রিয় ছাত্র, পরে পাকিস্তান গবর্ণমেন্টের মন্ত্রী আসরাফউদ্দীন সাহেব তাহার ভাষণে কার্জন হলের দাঙ্গায় আমার কার্যাবলীর ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছিলেন। মনে বিশ্বাস জন্মিল, কোন ভাল কাজ করিলে তাহা প্রচারের অপেক্ষা রাখেনা। একজন না একজন তাহা মনে করিয়া রাখে। ঢাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যখন নতুন অধ্যাপক হইয়া প্রবেশ করিলাম তখন হিন্দু ছাত্রেরা কত ভাবেই না আমার ক্লাশে উৎপাত করিয়া আমাকে চাকুরী ছাড়া করিতে চেষ্টা করিত। কিন্তু তাহারা আমার কাজের সত্যকার পুরুষ্কার দিল এই কার্জন হলের দাঙ্গার দিনে। এই দাঙ্গায় হিন্দু-মুসলমান প্রায় ত্রিশজন ছাত্র যখম হইয়াছিল। আমি যে একজন মুসলমান, দুই দলের মধ্যেই ঘোরাফেরা করিয়া দাঙ্গা থামাইতে চেষ্টা করিতেছিলাম্, আমার গায়ে কিন্তু একটি কাঁটার আচড়ও লাগে নাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা জীবনে এটি আমার শ্রেষ্ঠ পুরুষ্কার।
প্রথম দিনের দাঙ্গায় হিন্দু মুসলমান কয়েকজন ছাত্র সামান্য আহত হয়। নাজীর সারারাত্র জাগিয়া তাহাদের শুশ্রুষা করে। দ্বিতীয় দিনের দাঙ্গার পূর্বদিন সন্ধ্যাবেলায় দেওয়ান বাজারের মোড়ে নাজীরের সঙ্গে দেখা হইল। নাজীর কেবল হাসপাতালের নার্স, ডাক্তার ও কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করিতেছিল : ‘স্যার, দেখুন ওরা কত বড় জনসেবার ভার লইয়াছে কিন্তু প্রায় সকলেই হৃদয়হীন। সকালে রোগীদের ঠান্ডা দুধ দিয়াছে। আমি নিজে নার্সকে বকিয়া হিন্দু মুসলমান সকল আহত ছাত্রের জন্যই দুধ আবার গরম করাইয়া দিয়াছি।’ বুঝিলাম হাসপাতালের প্রতি অভিযোগে কিছু বাড়াবাড়ি আছে কিন্তু নাজীর তাহাদের সমালোচনা করিতেছে নিজের উন্নত হৃদয়ের মাপকাঠি দিয়া। এত অভিযোগ যাহাদের বিরুদ্ধে, হায়রে ! তাহাদেরই আশ্রয়ে পরদিনই নাজীরকে শেষ নি:শ্বাস লইতে হইল।
আমি নাজীরকে জিজ্ঞাসা করিলাম : ‘নাজীর্, আর ত কোন গন্ডগোল হইবে না?’ ‘না স্যার, আর কোন গন্ডগোল হইবে না। তবে দু’একটি খারাপ ‘এলিমেন্ট’ আছে বটে তাহাদিগকে থামাইয়া রাখিব।’ পরে নাজীর আমাকে বলিল : ‘স্যার, এখন আমি বড়ই ব্যস্ত রাত্রে একবার হাসপাতালে আসিবেন। আলাপ করা যাইবে।’ নাজীর চলিয়া গেল। তখন পশ্চিম আকাশে রক্তের লোহিত সাগরে দিবসের শান্ত বেলা সাঁতার ধরিয়াছে। ইহাই নাজীরের সঙ্গে আমার শেষ দেখা। প্রথম দিনের দাঙ্গার পরে ভাইস চ্যান্সেলার সাহেব যদি কিছুদিনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ দিয়া দিতেন তবে হয়ত কিছুই হইত না। কিন্তু তিনি সবেমাত্র উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হইয়াছেন। ছুটি দিলে বাহিরে জানাজানি হইয়া তাহার অক্ষমতা প্রমাণিত হইতে পারে। এইজন্য প্রথম দাঙ্গার পর দিনই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় খুলিবার হুকুম দিলেন।
পরের দিন হিন্দু মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে আবার দাঙ্গা লাগিল। দাঙ্গা শেষ হইলে খবর পাইলাম নাজীর সামান্য রকম আহত হইয়াছে। ইতিমধ্যে হাসপাতাল হইতে একজন আসিয়া বলিল : নাজীরের অবস্থা গুরুতর। তাহার শরীরে রক্ত দিবার জন্য কয়েকজন সবল যুবক চাই। এই খবর যে যে ছাত্র শুনিল তাহারা সকলেই নাজীরের দেহে রক্ত দিবার জন্য প্রস্তুত হইল।
ছয়-সাত জন ছাত্রকে সঙ্গে লইয়া হাসপাতালে আসিলাম। কাহাকেও হাসপাতালের ভিতরে প্রবেশ করিতে দেওয়া হইতেছে না। আমরা খবর পাঠাইলে হাসপাতালের অধ্যক্ষ অসিলেন। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম : ‘আহত ছাত্রেরা কেমন আছে?’ তিনি উত্তর করিলেন : ‘সকলেরই আঘাত সামান্য। একমাত্র নাজীরের অবস্থাই গুরুতর।’ একজন জিজ্ঞাসা করিলেন : ‘আপনি কি বলিতে চাহেন তাহার অবস্থা আশাহীন?’ ডাক্তার বলিলেন : ‘I am sorry that his condition is very serious’. ছাত্রদের মধ্যে যাহারা রক্ত দিবার জন্য আসিয়াছে, তাহাদিগকে পরিচিত করাইয়া দিলাম। সাহেব বলিলেন : ‘আপনাদিগকে ধন্যবাদ, এখন আর রক্ত দিবার প্রয়োজন নাই। দরকার হইলে আপনাদিগকে খবর পাঠাইব।’ তখন দেখিলাম যুদ্ধের জন্য সংগৃহীত ব্লাড ব্যাঙ্কের গাড়ী হাসপাতালের দরজায় দাঁড়াইয়া। বোধ হয় সেখান হইতেই নাজীরের জন্য রক্ত লওয়া হইয়াছিল।
অশ্রু-সজল নয়নে খোদার কাছে মোনাজাত করিতে করিতে আমরা হাসপাতাল হইতে ফিরিয়া আসিলাম। সঙ্গের শিক্ষক বন্ধুরা স্থির করিলেন মুসলিম হলে ও ফজলুল হক হলে নাজীরের আরোগ্য কামনা করিয়া দোয়া দরূদ পড়ার ব্যবস্থা করা হইবে। যে এ খবর শুনিল সেই সজল নয়নে আসিয়া মসজিদে জড় হইল। না ডাকিতে দুইটি মসজিদ ভরিয়া গেল।
সন্ধ্যার কিছু আগে একজন ডাক্তার বন্ধু খবর লইয়া আসিলেন আমাদের নাজীর আর ইহজগতে নাই। এই খবর দাবানলের মত সমস্ত ঢাকা শহরে ছড়াইয়া পড়িল। পথে চলিতে চলিতে পা ভাঙ্গিয়া আসে। চোখের পানি কিছুতেই সম্বরণ করিতে পারি না। পরিচিত সকলেরই আমার অবস্থা।
হাসপাতালে ছুটিয়া আসিলাম। শহরে সান্ধ্য আইন জারী হইয়াছে। মৃতদেহ আজ দেওয়া হইবে না। কালও মৃতদেহ অমাদের হাতে দেওয়া হইবে কিনা তাহা সন্দেহের বিষয়। নাজীরের সহপাঠিও সহকর্মীরা ঘন ঘন চোখের পানি মুছিতেছে। গৃহে ফিরিয়া আসিলাম। সারা রাত ঘুম আসিল না।
নাজীর আমার আত্মীয় নয়, পরিজন নয়। দেশের একজন নামকরা নেতাও নয়, যাহার জন্য ঘটা করিয়া সভা ডাকিয়া করুণ রসের বক্তৃতা করা যায়। আত্মীয় স্বজনের বিয়োগ হইলেও বন্ধুবান্ধব সান্তনা দিতে আসে। গৃহে আনন্দ উৎসব থামিয়া যায়। কিন্তু এ বেদনা যে কি করিয়া সহ্য করা যায় তাহার সন্ধান কে দিবে। গৃহে সকলের স্নানাহার, বিশ্রাম, নিদ্রা সবই সমানে চলিতেছে। কিন্তু সকলের সঙ্গে চলিতে যাইয়া কেবল ঘন ঘন তাল কাটিতেছে। কবিতার খাতা লইয়া লিখিতে চেষ্টা করিলাম। চোখের পানিতে কবিতার লাইনগুলি ভিজিয়া গেল।
পরের দিন সকালবেলা ইউনিভার্সিটিতে আসিয়া খবর পাইলাম আজিমপুর গোরস্থানে নাজীরের মৃতদেহ আনা হইতেছে। অল্প সময়ের মধ্যেই দাফল কার্য শেষ হইবে। তাড়াতাড়ি আজিমপুর গোরস্থানে চলিয়া আসিলাম।
মুসলিম হলের ফজলুল হক হলের যে যে ছাত্র খবর পাইয়াছে তাহারা সকলেই আসিয়াছে। ঢাকার মুসলিম জনসাধারণকে খবর দেওয়া হয় নাই। ধীরে ধীরে নাজীরের মৃতদেহ গোছলখানার ধারে লইয়া যাওয়া হইল। তাহাকে গোছল করাইয়া কাফনে সজ্জিত করা হইল। কেহ একটি ফুল লইয়া আসে নাই, একটি লোবান জ্বালাইয়া আনে নাই। এসব চিন্তা করিবার মনের অবস্থাও ছিল না কাহারও। সকলেরই চোখে অজস্র অশ্রুধারা। সকলের সামনে আনিয়া মৃতদেহের মুখমন্ডল উন্মোচন করা হইল। মাথায় একটা আঘাতের চিহ্ন। মুখের চেহারার একটুকুও পরিবর্তন হয় নাই। সেই চির পরিচিত স্বাভাবিক হাসিটি যেন লাগিয়াই আছে। যেন এই মাত্র সে ঘুমাইয়াছে। ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া বাঙ্গালী মুসলমানের উজ্জল ভবিষ্যতের কোন স্বপ্ন দেখিয়া মৃদু মৃদু হাসিতেছে।
তোমরা তাহাকে কেহ ডাক দিও না। তাহার এই সুন্দর স্ব্প্নভরা ঘুম ভাঙ্গিয়া দিও না। যদি তাহাকে ভালবাস, তার জন্য যদি কাহারও অন্তর কাঁদে তবে যে কাজ সে আরম্ভ করিয়া শেষ করিয়া যাইতে পারে নাই, সেই কাজে আপনাকে নিয়োজিত কর। যাহারা নিপীড়িত, পদদলিত, বন্ধুবিহীন, মহাবুভুক্ষায় কঙ্কালসার তাহাদের জন্য কিছু করিতে চেষ্টা কর। নাজীরের মত নির্ভীক হইবার শিক্ষা গ্রহণ কর ॥”
– জসীম উদ্‌দীন (পল্লীকবি) / স্মৃতির পট ॥ [ পলাশ প্রকাশনী – নভেম্বর, ১৯৬৮ । পৃ: ১৮৪-১৯২ ]