• ১৯শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ৬ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ২০শে শাবান, ১৪৪৬ হিজরি

ছাত্র জনতার বিপ্লব : গৌরব গাঁথা , শহীদ ফারহান ফাইয়াজের বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন পুলিশের এক গুলীতেই শেষ

usbnews
প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২৫
ছাত্র জনতার বিপ্লব : গৌরব গাঁথা ,  শহীদ ফারহান ফাইয়াজের বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন পুলিশের এক গুলীতেই শেষ
নিউজটি শেয়ার করুনঃ

দৈনিক সংগ্রাম ,প্রকাশনার সময় : সোম, ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। এমন জীবন গড়ো, যাতে মৃত্যুর পর মানুষ তোমাকে মনে রাখে।’ নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের ইন্ট্রোতে রেসিডেনসিয়াল মডেলে কলেজের ছাত্র ফারহান ফাইয়াজ ইংরেজিতে এ কথা লিখেছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তার মনের ইচ্ছা পূরণ করেছেন। ফারহান কোটা সংস্কার আন্দোলনে রাজপথে নেমে আর ঘরে ফিরতে পারেনি। ১৮ জুলাই ২০২৪ রাজধানীর ধানমন্ডিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হামলায় ফারহান ফাইয়াজ নিহত হন। শহীদ ফারহান ফাইয়াজ ২০০৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বরপা, রুপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ফারহান ফাইয়াজ অত্যন্ত মেধাবী একজন ছাত্র। ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের একাদশ শ্রেনির শিক্ষার্থী ছিলেন। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ পুরো পরিবার। ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চেয়েছেন তারা। ছেলেকে হারিয়ে শোকে কাতর পুরো পরিবার। ১৮ জুলাই ২০২৪ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতেই রূপগঞ্জের বরপা এলাকায় জানাযা শেষে সামাজিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। এখন প্রতিদিনই ছেলের কবরের পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন শহীদ ফারহান ফাইয়াজের বাবা শহীদুল ইসলাম ভুঁইয়া। জানান, উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে চেয়েছিলো ফারহান। বিজ্ঞানী হবার স্বপ্ন ছিলো তার। তিনি বলেন, ছেলে হারিয়ে আমার কথা বলার কোনো অবস্থা নেই। আমি কাঁদলে আমার স্ত্রী আর মেয়ে আরো ভেঙে পড়ে, আমি কাঁদতেও পারি না। বাবার কাঁধে ছেলের লাশ, সন্তান হারানোর শোক, এটা পৃথিবীতে কেউ বুঝবে না। এর চেয়ে ভারী কোনো কিছু আর নেই। একমাত্র যিনি সন্তানকে চিরতরে হারিয়েছেন, তিনিই শুধু সন্তান হারানোর কষ্ট বুঝতে পারবেন। ছেলেকে হারানোর কঠিন সত্য মানতে পারছেন না ফারহানের মা ফারহানা রহমান দ্বিবা। ছোট বোন ফারিনও ভাইয়ের স্মৃতি মনে করে কেঁদে উঠছেন। ফারহানের মা বলেন, আমার ছেলের স্বপ্ন ছিল বিজ্ঞানী হওয়া এবং দেশের সেবা করা। পরিবারের ইচ্ছা ফারহানের নামে গড়ে তোলা হবে একটি দাতব্য সংস্থা সেখান থেকে শিক্ষার্থীদের অনুদান দেয়া হবে বিজ্ঞান গবেষণায়। মেধাবী শিক্ষার্থী ফারহানের এমন করুণ মৃত্যুর ঘটনার বিচার চেয়েছেন তার স্বজনরা।

May be an image of 1 person, hospital and text

সহপাঠী ওয়াসিফ মুনিমের বর্ণনায় শহীদ ফারহান ফাইয়াজের মৃত্যু: পুলিশের ছোড়া টিয়ার শেলের বিষাক্ত ধোঁয়ার ঝাঁজে আমার নাক ও চোখ প্রচণ্ড জ্বলছিল। এ যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে বড় রাস্তাসংলগ্ন ফুটপাতে আমি বসে পড়লাম। খানিক বাদেই শুনি তুই বুকে গুলী খেয়েছিস। কোনো ঝক্কি-ঝামেলার কথা না ভেবেই তোর কাছে ছুটে গেলাম। এরপর একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তোকে যখন সিটি হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন ছুটন্ত অ্যাম্বুলেন্সের সিটে শুয়ে থাকা তুই আমার চোখের দিকে তাকালি। আমি দেখলাম, তোর দুই চোখের অব্যক্ত চাহনি! পর পর দু’বার তোর এই চাহনির সময় মনে হচ্ছিল দু’চোখের মণি ঠিকরে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তোর চোখের ওই চাহনিতে ছিল পতিত স্বৈরাচারের সশস্ত্র গুন্ডা বাহিনীর প্রতি একরাশ ঘৃণা। হঠাৎ তোর চোখের দুই পাতা ওঠা-নামা করে বন্ধ হয়ে গেল চিরতরে! সে সময় আমার ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যায়। বিমূঢ় আমি কাঁদতে চেয়েও পারিনি। তোর চিরবিদায়ের পর, গত তিন সপ্তাহ ধরে ঘুমাতে পারছি না। কারণ, ঘুম ঘুম ভাব এলেই তোর চোখের অব্যক্ত ওই চাহনি স্বপ্নের মধ্যে ভেসে ওঠে, ঘুমাতে দেয় না। কান্নাজড়িত কণ্ঠে হৃদয় বিদারক এ কথাগুলো বলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে (পরবর্তীতে বৈষম্যবিরোধী) নিহত শহীদ ফারহান ফাইয়াজের সহপাঠী ওয়াসিফ মুনিম। আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় গুলীবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন ফারহান ফাইয়াজ।

১৮ জুলাই ২০২৪ শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতে সহপাঠীদের সঙ্গে রাস্তায় নামেন ফারহান ফাইয়াজ ও ওয়াসিফ মুনিম। তারা ধানমন্ডি এলাকায় পৌঁছলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে পড়েন। এ সময় ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র এইচএসসি পরীক্ষার্থী ফারহান ফাইয়াজ গুলীবিদ্ধ হন। সামান্য আহত হলেও বেঁচে যান ফারহান ফাইয়াজের সহপাঠী ওয়াসিফ মুনিম। ফারহান ফাইয়াজের মৃত্যুর পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যোগ হয় নতুন মাত্রা। ‘কোটা সংস্কার’ আন্দোলন ‘স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে’ রূপ নেয়।

ওয়াসিফ মুনিম তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে গুলীবিদ্ধ ফাইয়াজ সম্পর্কে লেখেন, তোকে প্রথমে আমি ইমার্জেন্সিতে নেই, পরে ডাক্তার জানান, তোকে আইসিইউতে নেওয়া লাগবে। এ সময়ই লিফটে তোর সঙ্গে আমার জীবনের শেষ দেখা, আমাকে আইসিইউতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আমার অবস্থা দেখে সবাই মিথ্যা আশ্বাস দিলো, তুই বেঁচে আছিস। হ্যাঁ রে, তুই তো বেঁচে রইলি কোটি মানুষের হৃদয়ে, আর রেখে গেলি তোর চোখের চাহনির স্মৃতি, যা আমাকে প্রতিদিন মারে। ওয়াসিফ মুনিম বলেন, আমাকে রাজপথে থাকার অনুপ্রেরণা দিয়ে গেলি। এরপর থেকে এক দিনের জন্যও আন্দোলনে যোগ দেওয়া মিস করিনি। হাতে ছররা গুলী খেয়েও না। তোর রক্তের সঙ্গে বেঈমানি হতে দেইনিরে ফারহান। তুই জিতে গেছিস রে, আজ তোর দেশ স্বাধীন।

নতুন প্রজন্মের কিংবদন্তী: বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই ২০২৪) বিকেল সাড়ে তিনটার পর রাজধানীর ধানমন্ডি ২৭ নম্বর এলাকায় কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের সাথে দফায় দফায় সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার বিপরীতে চলতে থাকে বৃষ্টির মতো পুলিশের রাবার বুলেট, গুলী ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ। এ সময় গুলীবিদ্ধ হয়ে আহত হন ফারহান ফাইয়াজ। পরে সেখান থেকে আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে মোহাম্মদপুর সিটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে তার মৃত্যু হয়। বুলেটে তার শরীর ঝাঁঝড়া হয়ে গিয়েছিল। তার শরীরে রাবার বুলেটের ক্ষত রয়েছে বলে জানা গেছে।

কলেজের শিক্ষক তারেক আহমেদ ফেসবুকে লিখেছেন, ১৮ জুলাই ২০২৪ বৃহস্পতিবার দুপুরে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে ফারহান সানগ্লাস চোখে ছিল। তখনো ছেলেটা তাজা। সেখান থেকে চলে আসার ঘণ্টা দু-এক পরে ছেলেটার লাশ দেখতে হলো। আরেক পোস্টে লিখেছেন, হাসপাতালে লাশটা যখন দেখলাম, পা আর চলছিল না। ফারহানের খুব ইচ্ছা ছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে চায়, এমনটাও বলত কখনো কখনো। মাঝেমধ্যেই পড়াশোনা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করত আমার সঙ্গে। মানুষ হিসেবে ছিল খুব নম্র, ভদ্র। সিনিয়রদের শ্রদ্ধা, জুনিয়রদের স্নেহ করত। জুনিয়রদের কাছে ওর বেশ জনপ্রিয়তা ছিল। শুধু আমাদের কলেজেই নয়, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও নামডাক ছিল। কয়েক দিন আগে টেন মিনিট স্কুলের এক প্রতিযোগিতায় সে আমাদের কলেজের প্রতিনিধিত্ব করেছিল।

শহীদ ফারহান ফাইয়াজের বাবা শহীদুল ইসলাম ভুঁইয়া বলেন, আমার ছেলের পুরো নাম মোহাম্মদ ফারহানুল ইসলাম ভুঁইয়া। ডাক নাম রাতুল। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়ে সরকারি বাহিনীর এলোপাতাড়ি গুলীবর্ষণে শহীদ হওয়ার পর ফারহান ফাইয়াজ নামে পরিচিতি পেয়েছে। ছোটবেলা থেকে ফারহান শান্ত ও নিরিবিলি পরিবেশে থাকতে পছন্দ করতো। যেখানে ঝগড়াঝাঁটি ও ঝামেলা থাকতো, সেই জায়গা এড়িয়ে চলতো। যে ছেলে সামান্য কষ্ট সহ্য করতে পারতো না, রোদ-বৃষ্টি হলে ছাতা ব্যবহার করতো, কখনো উবার কল করা না হলে লোকাল বাসে চড়ে কলেজে যাওয়ার যন্ত্রণা সহ্য করতে কষ্ট পেতো, সেই ছেলে কীভাবে এত বড় আন্দোলনে যাবে? আমি চিন্তাই করতে পারি নাই!

শহীদুল ইসলাম বলেন, ফারহান শিশু বয়সেই তার প্রখর মেধা আর বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটিয়েছিল। অল্প পড়াতেই সব তার আয়ত্তে এসে যেত। সে তার কলেজের পাঠ্যবই পড়ার পাশাপাশি অন্য সবার চেয়ে প্রতিযোগিতায় নিজেকে একটু এগিয়ে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বইগুলোও পড়তো। তার পড়ার টেবিলে পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন লেখকদের বই সাজানো রয়েছে। ফারহানকে নিয়ে আমরা আশাবাদী ছিলাম।

এ সময় তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘ফারহান পিৎজা, পাস্তা আর বার্গার খেতে খুব পছন্দ করতো। মৃত্যুর আগের রাতে ১৭ জুলাই অনলাইনে পিৎজা অর্ডার করেছিল। আমি দরজা খুলে সেটা গ্রহণ করি এবং ওর হাতে দেই। খাবার খেয়ে রাত ১০টা বা সাড়ে দশটা নাগাদ শুতে চলে যায়। আর কথা হয়নি, বাবাটার সঙ্গে আবার। অনেক ব্যথা অনেক কষ্ট আমাদের। দেশের জন্য আমাদের একমাত্র ছেলে শহীদ হয়েছে। তার ত্যাগের বিনিময়ে এই বাংলাদেশটা নতুন করে স্বাধীন হয়েছে। এটা একদিকে আমাদের জন্য যেমন সান্ত্বনার, তেমনি বেদনারও।