বিপ্লবের শহীদ ও পঙ্গুদের প্রতি কী চমৎকার প্রতিদান ! রক্তের দাগ এখনো শুকাতে পারল না, এখন ক্ষমতার জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। বিপ্লবের পর বৈপ্লবিক সরকার ছিল কাম্য। বিপ্লবের চোখে ধুলা দিয়ে স্বৈরাচারের দোসরদের নিরাপদে দেশ থেকে পাচারে সহায়তা করা ছিল বিপ্লবের প্রতি প্রথম বিশ্বাসঘাতকতা। দেশে যতদিন স্বৈরাচারের অনুগত দানব রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় থাকবে, ততদিন স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিরাপদ নয়। আজ যারা বলছেন, স্বৈরাচারী দলকে নিষিদ্ধ করা উচিত হবে না কিংবা দাসত্বের দলিল বাহাত্তরের সংবিধান সম্পূর্ণ বদলানো উচিত হবে না, তারা কেন একবার নিজেকে প্রশ্ন করেন না যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে গত ৮০ বছরে জার্মানি, ইতালি, জাপানের মতো খুনি স্বৈরাচারীরা নামে-বেনামে সেই সব দেশের গণতন্ত্রের সুযোগ কাজে লাগিয়ে আবার রাজনৈতিক মূলস্রোতে ফিরে আসতে পেরেছে কি? ছাত্ররা তো ঠিকই বলেছে, আগে সংস্কার, তারপর নির্বাচন এবং দেশের আমূল নতুন বিনির্মানের স্বার্থে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা জুলাই শাহাদতের দাবি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামো টেকসই না। একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ভিত্তিতে আমাদের ব্যুরোক্রেসি, জুডিশিয়ারি, পুলিশসহ প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে তৈরি করতে হবে। আমরা দেখলাম, সালে রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টগুলো তৈরি হলো, অনেক ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হলো, অনেক ব্যাংকের মালিকানা বদলে দেওয়া হলো, সরকারি বড় বড় প্রকল্পের ঠিকাদারি তুলে দেওয়া হলো তাদের হাতে; এমনকি অনেককে এমপি-মন্ত্রী বানানো হলো। মুলে রয়েছে ব্যক্তি রাজনৈতিক কাঠামোর ফ্যাসিজম। প্রশ্ন হচ্ছে আবার আগামীতে রাজনৈতিক অঙ্গনে তার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে না তো ?দেশের জনগণ যখন স্বৈরাচারী খুনি উৎপীড়কদের একবার পরিত্যাগ করে, তারা কখনোই ফিরে আসতে পারে না তবে তাদের সাথে রাজনৈতিক ভিত্তিতে তারা ভিন্ন লেবাসে আসতে পারে। কারণ তাদের প্রোডাক্ট অন্য রাজনীতিতে বপন করে রাখে।
২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের অর্থনীতির কবর রচনার লোকদের পরিচিতি এরইমধ্যে পুরোবিশ্ব জেগে গেছে। পরিবারতন্ত্র, দলকানা রাজনীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশেও ছিল, আছে। লুট-চুরির অর্থ বিদেশে পাচারের কায়কারবারও ছিলআছে। আমেরিকা, ব্রিটেন , জার্মানি, জাপান, কোরিয়া, চীন প্রভৃতি বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর উন্নয়নের প্রধান কারণ তাদের কারিগরি শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং সামাজিক ও চীনারা প্রায় দেড় দশক আগেও যেখানে প্রযুক্তি ও কারিগরিতে অনেক পিছিয়ে ছিল, সেখানে আজ তারা সমগ্র বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর কারিগরি শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার জন্য কারিগরি শিক্ষায় তাদের অনিচ্ছা প্রধান কারণ।
২০২৪ সালের অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছেন আপামর জনতা এবং রেমিটেন্স যোদ্ধারা।দালালতন্ত্র এবং সেবাদাস রাজনৈতিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক দাসত্বের অবসান তারাই ঘটাতে পেরেছিল। বিজ্ঞমহল উপলব্ধি করছেন ৫ আগস্টের পর থেকে বিপ্লবের সুফল হাইজ্যাকের নানা রকমফের। যে যেভাবে পারছেন করছেন অভ্যুত্থানের সুফল নিয়েছেন , নিচ্ছেন। সচিবালয় থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে অভ্যুত্থানের সুফল নিতে কেউ কম না। কিন্তু যারা লড়াই করেছেন , তাদের জন্য কতটা সুফল সেই প্রশ্ন কিন্তু প্রকাশ্য। স্থানীয় না জাতীয় নির্বাচন আগে, সংস্কার না বিচার; এসব নিয়ে আলোচনার , বক্তব্যের ছেলেখেলা হরহামেশা ।
১৯৭১ সালের পরে ফরমায়েশি ইতিহাস লেখকদের লেখনীতেই হারিয়ে যায় ৭১ সালের তৃণমূল আমজনতার ত্যাগ ও লড়াইয়ের কথাগুলো। ধীরে ধীরে হয়ে যায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও দলকেন্দ্রিক চেতনা যুদ্ধ। স্বাধীনতা যোদ্ধারা শ্রমিকের জীবনযাপন সহ অমানবিক শ্রমের মাধ্যমে জীবিকার চেষ্টা করে বাঁচার লড়াই করেন। আন্যদিকে আরাম আয়েসে থাকা লোকগুলো ওপর থেকে এসেই হয়ে গেলেন স্বাধীনতার মূল দাবিদার ও সুফলভোগকারী । অসহায়ের মতো হা করে দেখতে হলো করুন পরিণতি রণাঙ্গণের তৃণমূল আমজনতার সম্মনিত যোদ্ধারা। ২০২৪ যেন সেই পরিণতি না ভোগ করে তার জন্য ছাত্রদের মূল দায়িত্ব নিতেই হবে।
বাংলাদেশের তরুণদের এই সংস্কার-আকাক্সক্ষা দাবি (দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র) প্রবীণদের কাছ থেকেই আসবে, এটিই প্রত্যাশিত ছিল। তারা যে আজকের বিজয়কে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলছে, এর যথেষ্ট যুক্তিসিদ্ধ কারণ এবং পটভূমি রয়েছে। বিপ্লবের পর প্রবীণদের উপর ভরসা করে তারা একের পর এক হতাশ হয়েছে। অথবা জেনে বুঝে সেই পতিত স্বৈরাচারের পক্ষাবলম্বন।সংস্কারের ন্যায্যতার ব্যাপারে মৌখিক সমর্থন সবাই দিচ্ছে।
জনগণের প্রদেয় ভ্যাট, ট্যাক্সের সঞ্চিত অর্থ, উন্নয়ন প্রকল্পের টাকার অংশবিশেষ, চাতুর্যের মাধ্যমে দেশের কতিপয় বাণিজ্যিক ব্যাংককে জনগণের গচ্ছিত অর্থ, বিদ্যুৎ খাত থেকে পুকুর চুরির অর্থ, শেয়ার বাজারের জনগণের অর্থ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মাধ্যমে হরিলুটের মহাউৎসব চলছিল দেশটিতে।
জুলাই বিপ্লবের মাত্র সাত মাসের ব্যবধানে দেশে বড় পরিবর্তন সূচিত করেছে ? পোশাক শ্রমিক ও উৎপাদনমুখী কলকারখানা এলাকায় সুস্থ্য পরিবেশ বজায় রাখার জন্য বাজেটে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকতে হবে। সারা দেশে টিসিবির পণ্য সেবা বাড়ানোর বাজেট চাই। বিধবা ও বয়স্কভাতা দ্বিগুণ করার বাজেট থাকা উচিত।স্বল্পদামে পণ্যকেনার জন্য ট্রাকের পিছনে প্রতিদিন হড়োহুড়ি ও হাতাহাতি দেখতে কার ভাল লাগে? সারা দেশে টিসিবির পণ্য সেবা বাড়ানোর বাজেট চাই। বিধবা ও বয়স্কভাতা দ্বিগুণ করার বাজেট থাকা উচিত।
২৪ এর অভ্যুত্থানে কিচ্ছা বানাচ্ছেন। পারলে বাহাত্তর সালের মতো মুক্তিযুদ্ধের জাল সনদ তৈরির প্রজেক্টও নিচ্ছেন। ছাত্রদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে বিভিন্ন বিবৃতি ও বক্তৃতা চলছে। ছাত্ররাও ছেড়ে কথা বলছে না।
লুন্ঠনকৃত অর্থের কিয়দংশ দিয়ে ক্রয় করা হয়েছে দেশের লোভী, দেশপ্রেমহীন অযোগ্য প্রসাশনিক ব্যবস্থা, নখদন্তহীন বিচার বিভাগ, কতিপয় নীতিহীন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাগণের মধ্যে কয়েকজন এবং দলীয় সংগঠনের নেতা, পাতি নেতা এবং দেশের বৃহৎ বেকার যুবকগণের মধ্যে হতে কিছু সংখ্যক দেশের প্রতি মায়ামমতাহীন অসচেতন যুবকদের বাহুবল।
কোন কিছু ভ্রুক্ষেপ না করে, এ অকরুণ ধুরন্ধর ফ্যাসিস্ট দেশটিকে নষ্ট করে দিয়ে নিজ স্বার্থকে পরিপূর্ণ করেছেন, ফলে জাতির নিকট তিনি ঘৃণিত হয়ে ওঠেন এবং এমনিভাবে জাতির স্কন্ধে চেপে বসা এ জগদ্দল পাথরকে সরাতে দেশের মানুষকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করে একটু একটু করে অগ্রগামী হতে হয়েছে। এক পর্যায়ে হাজার হাজার ছাত্র জনতার জীবন, রক্ত, অন্ধত্ব ও পঙ্গুত্বের বিনিময়ে দানবীয় ফ্যাসিস্টদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত এবং তাকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল।
শিক্ষাব্যবস্থার যুগোপযোগী সংস্কার, সমস্যা সমাধান করা, উন্নয়ন ও বাস্তবতা যাদের চিন্তা করার কথা , তাদের সন্তান বিদেশের মাঠিতে পাঠিয়ে দিয়ে দেশের গরিব , মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে দেশে প্রেমের বানোয়াট কাহিনী শুনিয়ে ঘুম পাড়ানির অপচেষ্টা চলছে সেই ১৯৭২ থেকেই।
বাংলাদেশের একটি বিশাল পরিমাণ যুব জনশক্তি রয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই উচ্চশিক্ষিত অর্থাৎ গ্র্যাজুয়েশন সার্টিফিকেটধারী। দুঃখজনকভাবে, গত ১০-১৫ বছরে শাসনামলে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে ফেলা হয়েছে, যার আশু সমাধান নেই। বিশালসংখ্যক শিক্ষিত যুবক সার্টিফিকেটধারী হয়েছে কিন্তু তাদের কোনো দক্ষতা নেই। তাদের মধ্যে দক্ষতা তৈরির কোনো ব্যবস্থা আমরা করিনি। এটা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।আমাদের যে এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত বেকার তৈরি হচ্ছে, সেখানে ছেলেমেয়েদের কোনো দোষ নেই। আমরা তাদের স্কিলভিত্তিক শিক্ষা দিতে পারিনি, এটা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি। বিরাট সংখ্যক মাদরাসা শিক্ষার্থী প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে চান্স পায়। অথচ কতিপয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক মনোভাব এবং প্রশাসনিক বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে এসব শিক্ষার্থী পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েট শেষ করে চাকরির পেছনে ছোটা যেন স্বাভাবিক চিত্রে পরিণত হয়েছে। ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থায় স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা মাদরাসাসমূহে উদ্যোক্তা সৃষ্টির কোনো ব্যবস্থা নেই এবং শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বই মুখস্থ করে তা পরীক্ষার হলে খাতায় লিখে দিয়ে আসলেই একে শিক্ষার সফলতা বলে মনে করেন, অথচ শিক্ষার্থীর প্রকৃত শিক্ষালাভের প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। এজন্য আমাদের দেশে শার্ট -প্যান্ট-টাই পরা স্যুটেড-বুটেড গ্র্যাজুয়েট বেকার তৈরি হচ্ছে।শিক্ষক নিয়োগের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি, টাকা প্রদান ও অস্বচ্ছতার আশ্রয় নেয়া হয়, যার প্রথম শিকার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা, এরপর শিক্ষার্থীরা। শিক্ষাবোর্ডগুলোর প্রতিটি কাজেই রয়েছে দুর্নীতির ছড়াছড়ি। শিক্ষক নিয়োগের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি, টাকা প্রদান ও অস্বচ্ছতার আশ্রয় নেয়া হয়, যার প্রথম শিকার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা, এরপর শিক্ষার্থীরা। শিক্ষাবোর্ডগুলোর প্রতিটি কাজেই রয়েছে দুর্নীতির ছড়াছড়ি।
তাই বেকারদের চাকরি ও কর্মসংস্থানের জন্য বড় বাজেট চাই। শিক্ষিত বেকারদের মুখের দিকে তাকানো যায় না। তারা নিজেদের জন্য, পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য বোঝা হয়ে না থেকে গঠনমূলক কাজে অংশ নেবার দ্রুত সুযোগ লাভ করুক এজন্য সর্বাগ্রে তাদের কর্মসংস্থানের সুস্পষ্ট নীতিমালা হাতে নিতে হবে।
কিছু সংখ্যক ব্যক্তি ২০১৩ সালে যান চলাচল বন্ধ করে রাষ্ট্রের মধ্যে আরেক রাষ্ট্র পরিচালনের ‘শাহবাগ’ গণ-ঘৃণায় পচে গেলেও এটি রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গার নাম।সংবাদের কাভারেজ আপনাকে তাদের পরিষ্কার করে চিনিয়ে দেবে। উল্টোদিকে শাহবাগের বিরুদ্ধে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর যে প্রতিবাদ ক্ষোভ সেগুলো প্রকাশ করতে অনেকের ইজ্জতে লাগেঅর্থাৎ সহজে বলা যায় সরম লাগে। বিষয়গুলো ও জ্ঞাত থাকা অতীব জরুরি। এইতো মাত্র কিছুদিন আগে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে কথিত জোটের ব্যানারে ডজনখানেক লোক সমাবেশ করেছে। ওদের কিন্তু জাতীয় প্রয়োজনে পাওয়া যায় না। তাদের সাথে সাদা অথবা গেরুয়া দরবেশি পোশাকের লোকদের ও আঁতাতের বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যাবে না।
বৈধভাবে বৈদেশিক শ্রমবাজারে আমাদের প্রবেশ যাতে সহজ হয়, সেজন্য কূটনৈতিক তৎপরতাসহ নানা উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা গ্রহণ করা উচিত। একই সঙ্গে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার ব্যাপারেও মনোযোগ দিতে হবে। আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত বৈধভাবে সুযোগ সৃষ্টি করা। পাশাপাশি অবৈধ অভিবাসনের ঝুঁকি ও ভয়াবহতা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করাসহ এটি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
লেখক – এমজেড ফয়সাল , সম্পাদক , ইউএসবি নিউজ