জুলাই বিপ্লবের সময় ঢাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত যশোরের শহীদ ইমতিয়াজ আহমেদ জাবির (২০) পরিবারে ঈদ নিয়ে বাড়তি কোনো উত্তেজনা নেই। ঈদের কথা মনে পড়লেই মা মোসাম্মদ শিরিনার চোখ জলে ভরে ওঠে। তিনি বলেন, ‘আমার একমাত্র ছেলে ছাড়া এটাই প্রথম ঈদ। আরও ঈদ আসবে আর যাবে। ঈদের আনন্দ আর ফিরে আসবে না।’ বাবা নওশের আলী বাজারে, মাঠে, ঘাটে সময় কাটিয়ে নিজের কষ্ট ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তার একমাত্র বোন, এইচএসসি পরীক্ষার্থী জেরিন বলেন, ‘আমার ভাই ঢাকার সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ত। প্রাইভেট পড়াতেনও। বাড়ি ফিরে আমার জন্য নানা জিনিসপত্র কিনত।
নিজের জন্য কিছু কিনত না।’ যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার হাজিরবাগ ইউনিয়নের দেউলি গ্রামের মেধাবী ও সরল যুবক ইমতিয়াজ আহমেদ জাবির (২০) এর বাড়তি কোনো চাহিদা ছিল না। বাবা নওশের মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে বলতেন, ‘তোমার কিছুই হবে না।’ জাবির বলতেন, ‘একদিন আমি এমন কাজ করব, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না; কিন্তু আমি গর্বিত হব।’
ছেলের পুরনো কথাগুলো স্মরণ করে জাবিরের বাবা নওশের আলী বলেন, ‘আজ মানুষ আমাদের শহীদের মা, শহীদের বাবা, শহীদের পরিবার বলে।’ তিনি বলেন, ‘জাবির এসএসসি, এইচএসসিতে ভালো ফলাফল করেছে। সে সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএতে ভর্তি হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ জোগাড় করা খুব কঠিন ছিল। সে তখন প্রথম বর্ষে। সে ঢাকার রামপুরা-বনশ্রী এলাকার একটি মেসে থাকত।’
মা শিরিনা বলেন, ‘আমার ছেলের স্বপ্ন ছিল বৃত্তি নিয়ে আমেরিকা যাবে। সে তার ছোট বোনকে ভালো শিক্ষা দেবে। সে তার বাবা, মা এবং বোনের জন্য চিন্তা করত। সে ঈদুল আযহার জন্য বাড়ি এসেছিল। এক সপ্তাহ পর সে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। আমি তাকে রান্না করা মাংস, ভাজা গরুর মাংসের অন্ত্র, রুটি, দুধ এবং ডিম দিয়েছিলাম।’
তিনি আর কখনও বাড়িতে আসেননি। মৃত্যুর পর পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মীরা তাকে তার মৃতদেহ তার বাড়ির উঠোনে নিয়ে যেতে দেয়নি। ২৬ জুলাই রাত ১১টায় লাশ এলাকায় পৌঁছানোর পরপরই পারিবারিক কবরস্থানের পাশে একটি দ্রুত জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তাকে তাৎক্ষণিকভাবে দাফন করা হয়।’
বাবা নওশের বলেন, ‘১৮ জুলাই জাবির মহাখালীতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি কাঁদানে গ্যাস এবং রাবার বুলেটের আঘাতে আহত হন। তিনি বাড়িতে কাউকে কিছু বলেননি। ঢাকায় আন্দোলনের খবর শুনে তিনি ভয় পেয়ে যান। আমি ফোনে তাকে বলতাম বাড়ি থেকে বের না হতে। জাবির বলত, ঘরে কে আছে? সবাই বাইরে। আমি কীভাবে একজন স্বার্থপর ব্যক্তির মতো ঘরে থাকতে পারি? পরের দিন, ১৯ জুলাই, তিনি রামপুরায় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। দুপুর আড়াইটার দিকে পুলিশ সেখানে গুলি চালায়।
জাবিরের সামনে পুলিশের গুলিতে দুই বিক্ষোভকারী মারা যান। তাদের উদ্ধার করতে গিয়ে জাবিরের উরুতে গুলি লাগে। ১৯ জুলাই বিকেলে কেউ ফোন করে জানায় যে জাবিরকে মুগদা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার জরুরি রক্তের প্রয়োজন। এক ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরাও ঢাকায় পৌঁছে তাকে ন্যাশনাল হার্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি করি। কোনও বেসরকারি হাসপাতাল তার চিকিৎসা করছে না। গুলি লেগে তার কিডনির শিরা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। চিকিৎসকরা তার পা কেটে ফেলার পরামর্শ দেন।
২২ জুলাই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেদিন চিকিৎসকরা বলেছিলেন যে তার পা কেটে ফেলার কোনও প্রয়োজন নেই। বৃহস্পতিবার জাবিরকে ডায়ালাইসিসের জন্য নেওয়া হয়। কিন্তু আধ ঘন্টা পর ডায়ালাইসিস বন্ধ হয়ে যায়। তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ২৬ জুলাই শুক্রবার বিকেল ৪টায় জাবির শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।