হেগে আইসিজে আদালতে গাজায় গণহত্যা মামলার শুনানি শুরু
হেগে আইসিজে আদালতে গাজায় গণহত্যা মামলার শুনানি শুরু
usbnews
প্রকাশিত জানুয়ারি ১১, ২০২৪
নিউজটি শেয়ার করুনঃ
ইউরোপ অঞ্চলের বিশেষ প্রতিনিধি : গাজা উপত্যকায় গণহত্যার অভিযোগে জাতিসংঘের আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যে মামলা করা হয়েছিল, তার শুনানি শুরু হচ্ছে আজ বৃহস্পতিবার থেকে। নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে অবস্থিত জাতিসংঘের এই অঙ্গপ্রতিষ্ঠানটি বিশ্ব আদালত নামেও পরিচিত।
মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য ইসরায়েলের প্রস্তুতির কাজ প্রায় শেষ এবং বৃহস্পতিবারের শুনানিতে মধ্যপ্রাচ্যের ইহুদিশাসিত এই ভূখণ্ডটির প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন বলে জানিয়েছেন ইসরায়েলি সরকারের অন্যতম মুখপাত্র ইলন লেভি।
বুধবার রাজধানী জেরুজালেমে এক সংবাদ সম্মেলনে লেভি বলেন, ‘হামাসকে রক্ষা করতে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজায় গণহত্যার যে অযৌক্তিক অভিযোগ প্রিটোরিয়া এনেছে, তা মোকাবিলা করতে আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) আদালতে ইসরায়েলের প্রতিনিধিদল উপস্থিত থাকবে।’
প্রসঙ্গত, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় অভিযানরত ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তুলে গত ৩০ ডিসেম্বর বিশ্ব আদালতে মামলাটি দায়ের করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।
মামলার আবেদনপত্রের সঙ্গে ৮৪ পৃষ্ঠার একটি নথি সংযুক্ত করে দক্ষিণ আফ্রিকা দাবি করেছিল, গাজায় অভিযানরত ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধের পাশাপাশি গণহত্যা এবং এ সম্পর্কিত অপরাধে সংশ্লিষ্টতারও প্রমাণ রয়েছে।
জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশনকে ভিত্তি করে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে— উল্লেখ করে আবেদনে আরও বলা হয়েছিল, ফিলিস্তিনি জাতির একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্য নিয়েই গাজা উপত্যকায় অভিযান চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী।
গত ৩০ ডিসেম্বর মামলার আবেদন জমা দেওয়ার দিন আইসিজেকে দ্রুত এ বিষয়ে শুনানির অনুরোধ করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। সেই অনুরোধে সাড়া দিয়ে ১১ জানুয়ারি শুনানি শুরুর দিন ধার্য করেন বিশ্ব আদালত।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ইরেজ সীমান্তে হামলা চালায় গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী হামাস। অতর্কিত সেই হামলার জবাবে সেদিন থেকেই ইসরায়েলে অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী। ১৬ অক্টোবর থেকে অভিযানে যোগ দেয় স্থল বাহিনীও।
গত তিন মাসের অভিযানে কার্যত ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজা উপত্যকা। ইতোমধ্যে সেখানে নিহতের সংখ্যা ২৩ হাজার ছাড়িয়ে গেছে এবং আহত ছাড়িয়েছে ৬০ হাজার। এছাড়া এখনও নিখোঁজ রয়েছেন অন্তত ৬ হাজার ফিলিস্তিনি।
অন্যদিকে হামাসের গত ৭ অক্টোবরের হামলায় নিহত হয়েছিলেন ১ হাজার ২০০ জন ইসরায়েলি ও অন্যান্য দেশের নাগরিক। সেই সঙ্গে ২৪০ জনকে জিম্মি হিসেবে ধরে নিয়ে গিয়েছিল হামাস। তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় অর্ধেককে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, হামাসকে সম্পূর্ণ নির্মূলের আগ পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান চলবে। এদিকে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অভিযোগ উঠেছে- গাজা উপত্যকা দখল এবং সেখানে বসবাসরত ফিলিস্তিনীদের উচ্ছেদ করতেই এ অভিযান চালাচ্ছে ইসরায়েল।
এই অভিযোগকে আরও দৃঢ় করেছে নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার কয়েকজন ডানপন্থী সদস্যের মন্তব্য। সম্প্রতি ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোতরিচ এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইতামার বেন গিভির বলেছেন, গাজার ফিলিস্তিনিদের উচিত বসবাসের জন্য কোনো নিরাপদ দেশ বেছে নেওয়া। সূত্র : রয়টার্স
ইসরাইল তার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো হেগের জাতিসঙ্ঘ আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে (আইসিজে) আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াচ্ছে। গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গণহত্যা চালানোর অত্যন্ত ভয়াবহ অভিযোগ দায়ের করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। এই মামলা নিষ্পত্তি হতে অনেক সময় লাগবে। কিন্তু আদালত যদি ইসরাইলের বিরুদ্ধে একেবারে মোলায়েম সুরেও অন্তর্বর্তী কোনো রায় দেয়, তবে তা দেশটির আন্তর্জাতিক মর্যাদা এবং বৈশ্বিক সুনাম ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর তার কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিণাম হবে ভয়াবহ।
এমনকি ইসরাইলের বিরুদ্ধে একটি রুলিং হামাসের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধের মোড় পর্যন্ত ঘুরিয়ে দিতে পারে।
দক্ষিণ আফ্রিকার আবেদনে বলা হয়েছে, ইসরাইল বিপুলসংখ্যক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে; গাজার লোকজনকে খাদ্য, পানি ও চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা মনে করে, এগুলো হলো গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরাইলের পরিকল্পিত গণহত্যার চেষ্টা।
দক্ষিণ আফ্রিকা তার প্রমাণের পক্ষে কেবল বোমাবর্ষণই নয়, ইসরাইলি সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীর বক্তব্যও তুলে ধরেছে। এসব মন্তব্যে ইসরাইলি মন্ত্রীরা গাজার অধিবাসীদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, নির্মূল করা, নিশ্চিহ্ন করার কথা সদম্ভে বলেছিলেন। এগুলোও ইসরাইলের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে।
চূড়ান্ত রায় দিতে কয়েক বছর লাগতে পারে। কিন্তু অন্তর্বর্তী রায়ে অবিলম্বে পূর্ণ যুদ্ধবিরতির কথা বলা হতে পারে। আর তাই ইসরাইলের পরাজয়ের জন্য যথেষ্ট হতে পারে।
আইসিজের স্থায়ী বিচারপতির সংখ্যা ১৫। তবে মামলার দুই পক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইসরাইল একজন করে অস্থায়ী বিচারপতি পাঠাতে পারবে।
এই আদালতের বর্তমান সভাপতি হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের জুয়ান ডোনোহুই। অন্য বিচারপতিরা হচ্ছেন ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, স্লোভাকিয়া, জ্যামাইকা, জাপান, ব্রাজিল, রাশিয়া, চীন, মরক্কো, সোমালিয়া, লেবানন ও উগান্ডার।
গত ৭ই অক্টোবরের পর থেকে অন্তত ১৩০০ ফিলিস্তিনিকে “প্রশাসনিক আটক” করা হয়েছে, যেটি গত ত্রিশ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সব মিলিয়ে এই আইনের আওতায় দুই হাজার আটশরও বেশি ফিলিস্তিনি এখন ইসরায়েলের কারাগারে বন্দী রয়েছে।
গণহত্যা কী?
ইউএন জেনোসাইড কনভেনশন (১৯৪৮) অনুযায়ী, ‘গণহত্যা’ হল একটি জাতীয়, জাতিগত, বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে করা একটি কাজ। এর মধ্যে রয়েছে,
কোনও একটি গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা করা
গোষ্ঠীর সদস্যদের গুরুতর শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি করা
ইচ্ছাকৃতভাবে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করা যাতে শারীরিক ক্ষতি হয়
জন্ম প্রতিরোধ করতে ব্যবস্থা নেওয়া
গোষ্ঠীর বাচ্চাদের জোর করে অন্য গোষ্ঠীতে স্থানান্তর করা
আন্তর্জাতিক অপরাধগুলির মধ্যে গণহত্যা প্রমাণ করা কিন্তু সবচেয়ে কঠিন।
কেন ইসরাইলকে আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে গেল দক্ষিণ আফ্রিকা
অধিকৃত পশ্চিম তীরের ইহুদি বসতিগুলো আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ।কিন্তু এসব উপেক্ষা করে পশ্চিম তীরে নতুন নতুন ইহুদি বসতি নির্মাণ চলছেই।
গাজা যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা নেয়া দরকার কি না সে সিদ্ধান্ত নিতে জাতিসঙ্ঘ আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালত (আইসিজে) আজ বৃহস্পতিবার থেকে শুনানি করবে। ফিলিস্তিনি জনগণের সাথে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের দীর্ঘস্থায়ী সংহতির পেছনে রয়েছে ইতিহাস।
দ্য হেইগের আন্তর্জাতিক আদালত বা আইসিজে-তে দক্ষিণ আফ্রিকা ইসরাইলের বিরুদ্ধে গাজায় গণহত্যা চালানোর অভিযোগ এনেছে। বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার আদালত উভয় পক্ষের যুক্তি শুনবে এবং এরপরে ইসরাইলের গাজায় বোমাবর্ষণ বন্ধ করার অন্তর্বর্তী আদেশ জারি করবে কি না তা সিদ্ধান্ত নেবে।
দক্ষিণ আফ্রিকার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সহযোগিতা বিভাগের মুখপাত্র ক্লেসন মনিয়েল্লা বলেছেন, ‘গাজায় চলমান গণহত্যার প্রেক্ষাপটে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হওয়ার সাথে সাথে ১৯৪৮ সালের ‘গণহত্যা প্রতিরোধ ও শান্তি সংক্রান্ত কনভেশনের’-আওতায় যে কার্যক্রমগুলোকে অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে সেগুলোও গাজায় সংঘটিত হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।’
দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ইসরাইল উভয়েই এই কনভেনশানের স্বাক্ষরকারী। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরাইলকে গণহত্যার জন্য দায়ী প্রমাণ করতে পুরো মামলাটির কার্যক্রম কয়েক বছর চলতে পারে, তবে এই সপ্তাহের শুনানিটি হচ্ছে ইসরাইলের বিরুদ্ধে দ্রুত নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য জরুরি একটি পদক্ষেপ।
ব্রিস্টলের ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি অফ ইংল্যান্ডের দক্ষিণ আফ্রিকার আইনের অধ্যাপক গেরহার্ড কেম্প বলেছেন, ফিলিস্তিনি ইস্যুর প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকার সমর্থন দীর্ঘস্থায়ী।
কেম্প বলেন, ‘এর একটি ঐতিহাসিক কারণও রয়েছে; ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনের কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার শাসক দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সাথে ফিলিস্তিনি জনগণের দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক আছে। তাই ইসরাইলকে আইসিজে-র সামনে আনার ক্ষেত্রে দক্ষিণ আফ্রিকার নেতৃত্ব দেয়ার ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে।’
আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস বা এএনসি নিজেরাই একসময় একটি নিষিদ্ধ ঘোষিত মুক্তি আন্দোলন ছিল। এএনসি দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিল। তাই তারা ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার মধ্যে নিজেদের প্রতিচিত্র দেখে।
দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন সাবেক ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ফিলিস্তিনিরা মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতা সম্পূর্ণ হবে না।
জেনোসাইড কনভেনশন বিরোধী মামলাগুলির শুনানি হয় আইসিজে-তে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত ইউরোপে নাৎসিরা ৬০ লক্ষ ইহুদিদের হত্যা করেন। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়াতে ১৯৪৮ সালে জেনোসাইড কনভেনশন স্বাক্ষর করেন বিশ্বনেতারা।
প্রসঙ্গত, ইসরায়েল, দক্ষিণ আফ্রিকা, মিয়ানমার, রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হল অনুমোদনকারী ১৫৩টি দেশের মধ্যে কয়েকটি।