মুহাম্মদ ওয়াছিয়ার রহমান
৫ আগস্ট ২০২৪ শেখ হাসিনা সরকারের পতন হওয়ায় আগে ও পরে রাজনীতিতে সংস্কার নিয়ে নানা আলোচনায় রাজনৈতিক মাঠ গরম হয়ে উঠে। এ নিয়ে বর্তমান সরকার ও বড় রাজনৈতিক দলের সাথে বড় আকারে বিবাদ চলছে। ৮ আগস্ট ড. ইউনূস সরকার শপথের সময় দেশ বাঁচানোর প্রত্যাশা নিয়েই তাঁকে আলিঙ্গন করে দেশবাসী। তখন কোনো শর্ত ছিল না। আগে শপথ পড়েন, দেশ বাঁচান এটাই ছিল আকাংখ্যা। ড. ইউনূসের শপথের পর বড় একটি রাজনৈতিক দল অব্যাহতভাবে নির্বাচনের দাবি করে আসছে। যখন ভাঙ্গা দেশে সাবেক স্বৈরশাসকের ইশারায় সরকারের বিভিন্ন অঙ্গ নানা দাবী নিয়ে অব্যাহতভাবে চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। আজ আনসার, কাল অটো রিক্সাওয়ালা, পরশু বড় লোনের মূলা, তারপর শিক্ষক, কখনও হিন্দু সম্প্রদায়, গার্মেন্টস কর্মী ও সরকারি কর্মচারীসহ নানা অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইউনূসের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এ ধরনের চাপ যে কোনো রাজনৈতিক সরকারের পক্ষেও মোকাবেলা করা কঠিন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনও লিগাল ফ্রেম ওয়ার্কের মধ্যে সব দলের সম্মতিতে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯০ সালে রাজনৈতিক সংকটে জাতীয় পর্টি ছাড়া সব দলের সম্মতিতে সাবেক প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন উপ-রাষ্ট্রপতিসহ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের শর্ত অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করে তাকে আবার প্রধান বিচারপতির পদে ফিরিয়ে নেয়া হয়। এ দেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে তৃতীয়বার আওয়ামী লীগ ছাড়া সকল দলের সম্মতিতে প্রফেসর ড. ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রফেসর ইউনূসকে দায়িত্ব দেয়ার আগে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্ট থেকে সংবিধানের ১০৬ ধারা মোতাবেক মতামত নিয়ে নেন। ওই মতামতের ভিত্তিতে এ সরকার গঠিত হয়। এটা কোনোভাবেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয় এবং তার কোনো মেয়াদও উল্লেখ নেই। জাতি তাকে ওই সংকটকালে রাষ্ট্রের হাল ধরা, রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল অবস্থায় আনা, পাচার হাওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা, সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন আয়োজন করার মহান দায়িত্ব দেন। বিএনপির এক নেতা অভিযোগ করেছে প্রফেসর ইউনূস সরকার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন না দিয়ে সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন কিন্তু সংবিধানের কোন ধারা লঙ্ঘন করেছেন তা কিন্তু উল্লেখ করেননি বা এ সরকারের কোন মেয়াদ আছে কিনা তাও উল্লেখ করেননি।
রাজনীতিবিদদের বলবো একটু চোখ বন্ধ করে বুকে হাত দিয়ে চিন্তা করুন আবু সাঈদ, মুগ্ধ, রিয়া গোপ, ওয়াশিমরা কি নির্বাচনের জন্য জীবন দান করেছেন? তারা কিন্তু বৈষম্য নিরোধের লক্ষ্যে জীবন দিয়েছন। কিন্তু শেখ হাসিনাকে তাড়ানোর পর ইউনূসকে নিয়োগ করার জন্য বৈষম্য নিরোধ, পাচার অর্থ ফিরিয়ে আনা, গুম-খুনের বিচার, রাজনৈতিক সংস্কার ও নির্বাচন আয়োজন হলো জনআকাক্সক্ষা। এ সময় বিএনপি বলছে নির্বাচিত সরকার সংস্কার করবে। এ সরকারের কাজ কেবলমাত্র রুটিন মাফিক কাজ ও নির্বাচন। যে কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসলে তাদের সুবিধামত সংস্কার করে। জনআকাক্সক্ষা সেখানে গৌণ থাকে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিলের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক ক্ষমতায় থাকাকালে তখনকার আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ বিচারবিভাগ স্বাধীন হওয়ার কার্যক্রম শুরু করলে বিএনপির দাবি ছিল তারা ক্ষমতায় এসে বিচার বিভাগ স্বাধীন করার কার্যক্রম সম্পন্ন করবে। সে কথা বিএনপি রাখেনি। সুতরাং রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসলে কেবলমাত্র তাদের সুবিধামত সংস্কার করবে যেটা জনআকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটবে না। জনগণ প্রতারিত হবে। দেশ আবার কঠিন সংকটের মধ্যে পড়ে যাবে। গত ১৩ জুন লন্ডনে ইউনূস-তারেক বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ ইস্যুটা বেশী প্রধান্য পায়। তাতে মনে হচ্ছে নির্বাচনের তারিখ ও নির্বাচনই দেশের প্রধান সমস্যা। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪-তে যদি নির্বাচন সুষ্ঠুও হতো তবুও কি দেশ ভালভাবে চলতো?
বিএনপিতে নানা মত-পথের লোকদের সমাগম বিদ্যমান। নানা মতের লোকদের উপস্থিতি বিএনপির বন্ধন। এটা একটা বহুমাত্রিক বড় দল। এজন্য মাঝে মাঝে নানা মতের মধ্যে হালকা আদর্শিক সংঘাত দেখা যায়। বিএনপির বড় কৃতিত্ব হলো নানা মতকে হজম করতে পারা। যেটা তারা করে যাচ্ছে সফলভাবে। জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার কিংবন্তি নেতৃত্ব এই ধারাকে সফলভাবে এগিয়ে নিতে সফল হয়েছে। বিশেষ করে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার বিশাল ব্যক্তিত্ব বিএনপির বিরাট পুঁজি ও অহংকার। বর্তমান সরকার নিয়ে বিএনপির বর্তমান অবস্থানের সাথে বিএনপির সকল নেতা-কর্মী একমত এটা মনে করার কোনে যৌক্তিক কারণ নেই। সুযোগ সন্ধানী লোকদের উপস্থিতি বেশী থাকায় বিএনপিকে নানা সমালোচনার মোকাবেলা করতে হয় এবং করতে হবে। বর্তমান বিএনপি নেতৃত্ব তার কর্মীদের আদর্শিকভাবে গড়ে তুলতে না পারার দায় অবশ্যই নিতে হবে এবং জনগণ থেকে তারা দূরে সরে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জামায়াত ও সিপিবি সফল। এ ধরনের কোনো বিড়ম্বনা তাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে না। ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন হওয়ায় তাদের কর্মীরা একটা ফরমেটের মধ্যে আবদ্ধ থাকায় ভিন্ন পথে চলার সুযোগ থাকে না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বর্তমান সংকটের সমাধান অত্যন্ত কঠিন। আপাতত সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হওয়া শুধু কঠিনই নয় অসম্ভবও বটে। অতীতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটে নিজেরা বা তৃতীয়পক্ষ যেগুলো সমাধান করতে পারেনি। এমন কি বিদেশী দূত স্যার নিনিয়ন ও তারনকো মিশন ফেল করেছে। সুতরাং বর্তমান সংকট কাটিয়ে উঠতে তৃতীয় পক্ষের কোনো মধ্যস্থতা সফল হবে বলে মনে হয় না। শেষমেশ জনগণের কাছেই ফিরে আসতে হবে। গণভোটই হলো চূড়ান্ত সমাধান। জনগণ যেহেতু দেশের মালিক সুতরাং তাদের কাছে ছেড়ে দিন তারাই চূড়ান্ত রায় দিক। Tourism packages
তবে ড. ইউনূসের জন্য বিরাট খবর হলো দেশের জনগণের কাছে ও বহির্বিশ্বে তাঁর ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। ড. ইউনূস ছাড়া অন্য কেউ হলে তাকে অনেক ঝামেলা মোকাবেলা করতে হতো। অন্য কেউ এ সমস্যা মোকাবেলা করতে পারতো না। জাতিকে চরম মূল্য দিতে হতো। শেখ হাসিনার পতনের পর জনআকাক্সক্ষা হলো সংস্কার, পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনা, বিচার ও নির্বাচন। এটা ছাড়া জনগণ অন্য কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না। বর্তমান সমস্যার সমাধানে যদি সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো সমঝোতায় না আসে এবং তখন নির্বাচন দিলে শহীদ পরিবার বা অন্য কেউ যদি আদালতে যায় তখন নির্বাচন করা কি সম্ভব হবে? জনআকাক্সক্ষাকে গৌণ করে নির্বাচন দিলে জনগণও তা সহজে মেনে নিবে না। তাছাড়া যাদের ভয়ে সরকারি কর্মচারীরা তটস্থ, সংস্কার ছাড়া তারাই ক্ষমতায় গেলে দেশের অবস্থা কি হবে তা সহজে অনুমেয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক।