• ২৬শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ২৮শে শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

গণহত্যার মামলা ভুল প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে ইসরায়েল : দক্ষিণ আফ্রিকা

usbnews
প্রকাশিত জানুয়ারি ১৩, ২০২৪
গণহত্যার মামলা ভুল প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে ইসরায়েল : দক্ষিণ আফ্রিকা
নিউজটি শেয়ার করুনঃ

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গাজায় গণহত্যার মামলা ভুল প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে ইসরায়েল। শুক্রবার (১২ জানুয়ারি) নেদারল্যান্ডসের হেগে আদালতে গাজায় গণহত্যা মামলার শুনানির শেষদিন এমন দাবি করেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিচারমন্ত্রী রোনাল্ড লামোলা।

ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে হামাস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযানের সময় গাজা উপত্যকায় গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরাইল, এমন অভিযোগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মামলা করেছে সাউথ আফ্রিকা। দেশটির দাবি, গাজায় ১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশন লঙ্ঘন করছে ইসরায়েল।

শতাব্দীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মামলার মধ্যে এটি নিঃসন্দেহে একটি। এই মামলাকে কেন্দ্র করে ইসরায়েল এবং দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিনিধিত্বকারী আইনজীবীরা আদালতে মুখোমুখি । আর গোটা বিশ্ব তাকিয়ে থাকবে তাদের দিকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত ইউরোপে নাৎসিরা ৬০ লক্ষ ইহুদিদের হত্যা করেন। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়াতে ১৯৪৮ সালে জেনোসাইড কনভেনশন স্বাক্ষর করেন বিশ্বনেতারা।

প্রসঙ্গত, ইসরায়েল, দক্ষিণ আফ্রিকা, মিয়ানমার, রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হল অনুমোদনকারী ১৫৩টি দেশের মধ্যে কয়েকটি।

দক্ষিণ আফ্রিকার দায়ের করা ৮৪ পৃষ্ঠার ওই নথিতে বলে হয়েছে ইসরায়েলের কার্যকলাপ কিন্তু ‘চরিত্রগত ভাবে গণহত্যাই’ কারণ তারা গাজায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের একটি বড় অংশকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল।

সাউথ আফ্রিকার প্রতিনিধিরা বলেছেন, গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর সংঘটিত কিছু কাজ জাতিসংঘের গণহত্যা কনভেনশনের বিরুদ্ধে গেছে এবং সেই কাজগুলোকে ৭ অক্টোবরের হামলার উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া হিসাবে বিবেচনা করা যায় না।

সাউথ আফ্রিকার বিচারমন্ত্রী রোনাল্ড লামোলা বলেছেন, “কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সশস্ত্র আক্রমণ যতই গুরুতর হোক না কেন…এই কনভেনশন (গণহত্যা কনভেনশন) লঙ্ঘনের যুক্তি হিসাবে সেটা দাঁড় করানো যেতে পারে না।”

হামলায় গাজা উপত্যকা কার্যত ধ্বংস হয়ে গেছে। মাটির সাথে মিশে গেছে বেশিরভাগ ঘরবাড়ি, স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল ভবন। গাজায় ইসরাইলের এই হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞকে এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মহল গণহত্যা বলে অভিহিত করেছে। ফিলিস্তিনে জাতিসংঘের স্পেশাল র‍্যাপোর্টিয়ার ফ্রান্সেসকা আলবানিজ বলেছেন, গাজায় ইসরাইলের হত্যাযজ্ঞ স্রেব্রেনিকা ও রুয়ান্ডার মতো বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের গণহত্যা থেকে খুব বেশি ভিন্ন নয়।

সাউথ আফ্রিকার প্রতিনিধিরা দাবি করেছেন, ইসরায়েল যে পরিমাণ বোমাবর্ষণ করেছে তা অভূতপূর্ব এবং গাজা উপত্যকাকে ইসরায়েল কার্যত বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছে৷

যুক্তি হিসাবে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের ‘গণহত্যামূলক’ কার্যকলাপের মধ্যে রয়েছে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা, গুরুতর মানসিক এবং শারীরিক ক্ষতি করা এবং ইচ্ছাকৃতভাবে এমন পরিস্থিতি তৈরি করা যাতে ‘সমগ্রভাবে ওই গোষ্ঠীর শারীরিক ক্ষতি হয়’। শুধু তাই নয়, ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের বক্তব্যে কিন্তু তাদের গণহত্যার উদ্দেশ্য প্রকাশ পেয়েছে বলেও উল্লেখ রয়েছে ওই নথিতে।

শুক্রবার পাল্টা বক্তব্য ও যুক্তি উপস্থাপন করেন ইসরায়েলি আইনজীবীরা। শুনানি শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেওয়া রোনাল্ড লামোলা বলেন, ফিলিস্তিন ও গাজার বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্য থেকে কিছু ব্যক্তি যাই করুক না কেন ও ইসরায়েলি নাগরিকদের উপর যত বড় হুমকিই থাক না কেন, গত বছরের ৭ অক্টোবরের পর থেকে ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় যে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।

তিনি আরও বলেন, গোটা গাজায় গণহত্যার লক্ষ্যে আক্রমণ চালানো হয়েছে। কতিপয় ব্যক্তিদের জন্য গাজার সব বাসিন্দাদের নিধন করার পরিকল্পনা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। আমরা অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী যে আমাদের হাতে যেসব সত্য সত্য-প্রমাণ রয়েছে, সেগুলোর মাধ্যমে ইসরায়েল যে গণহত্যার অপরাধ করেছে তা প্রমাণ সম্ভব হবে।

জাতিসংঘের শীর্ষ আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মামলাটি করে দক্ষিণ আফ্রিকা। গত বৃহস্পতিবার (১১ জানুয়ারি) মামলার শুনানি শুরু হয়। শুনানিতে দক্ষিণ আফ্রিকার আইনজীবীরা বলেন, গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান একটি রাষ্ট্র-পরিচালিত গণহত্যার অভিযান। ইসরায়েলের এই অভিযানের লক্ষ্য ফিলিস্তিনি জনগণকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা।

পাল্টা বক্তব্য ও যুক্তি উপস্থাপনকালে গাজায় গণহত্যার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে ইসরায়েল। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাজায় সামরিক অভিযান বন্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার অনুরোধ খারিজ করার জন্য বিচারকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইসরায়েল। তাদের দাবি, অভিযান বন্ধ হলে গাজাবাসী নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়বে।

এছাড়া গণহত্যা কনভেনশনের অধীনে গাজা উপত্যকায় সামরিক অভিযান বন্ধের আদেশ দেওয়ার এখতিয়ার আইসিজের নেই বলেও মন্তব্য করেন ইসরায়েলি আইনজীবীরা। ইসরায়েলের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেওয়া আইনজীবী টাল বেকার বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যেসব ব্যাখ্যা তুলে ধরছে, তা অতিমাত্রায় বিকৃত। যদি কোনো গণহত্যা ঘটে থাকে, তাহলে তা ইসরায়েলের বিরুদ্ধেই হয়েছে। হামাস ইসরায়েলে গণহত্যা চালাতে চায়।

সাউথ আফ্রিকার বিচারমন্ত্রী রোনাল্ড লামোলা বলেছেন, “কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সশস্ত্র আক্রমণ যতই গুরুতর হোক না কেন…এই কনভেনশন (গণহত্যা কনভেনশন) লঙ্ঘনের যুক্তি হিসাবে সেটা দাঁড় করানো যেতে পারে না।”

এই ইসরায়েলি আইনজীবীর দাবি, ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে নয়, বরং হামাসের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা যুদ্ধ করছে ইসরায়েল। হামাসের কারণেই ফিলিস্তিনের বেসামরিক নাগরিকদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। আর গণহত্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো কোনো জনগোষ্ঠীকে আংশিক বা পুরোপুরি ধ্বংস করা, যা ইসরায়েল করেনি।

আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় ‘জাতি, বর্ণ বা নৃগোষ্ঠী বা ধর্মীয় কোনো সম্প্রদায়কে আংশিক বা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে পরিচালিত একটি বা একাধিক কর্মকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে’। এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে: কোনো গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা বা শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি, কোনো গোষ্ঠীকে পুরোপুরি বা আংশিক ধ্বংস করা, কোনো জাতি বা গোষ্ঠীর মধ্যে নতুন জন্ম প্রতিরোধের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া ও জোর করে এক গ্রুপের শিশুদের অন্য গ্রুপে স্থানান্তর করা।

দক্ষিণ আফ্রিকা চায় আইসিজে ইসরায়েলকে অবিলম্বে গাজায় সামরিক অভিযান স্থগিত করার নির্দেশ দিক। কিন্তু এটা অনেকটাই অনিশ্চিত। কারণ এমন কোনো নির্দেশ যে ইসরায়েল খুব সহজে মেনে নেবে তেমনটা মনে হয় না এবং তাদের বাধ্যও করা যাবে না।

আদালতের নির্দেশ সংশ্লিষ্ট দুই পক্ষের জন্য মান্য করার তাত্ত্বিক বাধ্যবাধকতা আছে, কিন্তু বাস্তবে এটির প্রয়োগে বাধ্য করা যায় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০২২ সালে আইসিজে রাশিয়াকে অবিলম্বে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান স্থগিত করতে বলেছিল। কিন্তু সেই নির্দেশ উপেক্ষিতই থেকে গেছে।

জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যা প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল।

৭ অক্টোবরের হামলায় ১১শ জনেরও বেশি ইসরায়েলি মারা যান, যাদের বেশিরভাগ ছিলেন বেসামরিক নাগরিক। এর প্রতিক্রিয়ায় গাজায় ইসরায়েলের হামলায় এখন পর্যন্ত ২৩ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানিয়েছে হামাস নিয়ন্ত্রিক গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় সামরিক ও বেসামরিক মৃ্ত্যুর আলাদা হিসাব প্রকাশ করে না। তবে আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থাগুলো গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেয়া এই সংখ্যাকে নির্ভরযোগ্য হিসাবে বিবেচনা করে।

আইসিজেতে দক্ষিণ আফ্রিকা যে প্রমাণপত্র জমা দিয়েছে তাতে দাবি করা হয়েছে যে ইসরায়েলের যে কার্যক্রম তার সঙ্গে গণহত্যার বৈশিষ্ট্যের মিল আছে কারণ তারা ফিলিস্তিনিদের জাতীয়, জাতিগত এবং নৃগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য অংশকে ধ্বংস করতে চেয়েছে।

ইসরায়েল গাজায় যা করেছে এবং যা করতে চেয়েছে- উভয় ক্ষেত্রেই এ বক্তব্য তুলে ধরেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। অর্থাৎ ইসরায়েল এখন যা করছে যেমন বিমান হামলা এবং যা করতে পারেনি তাহলো বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

এই মামলায় গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ্যে ইসরায়েল যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে সেটিকে তুলে ধরা হয়েছে ‘গণহত্যার অভিপ্রায়’ এর প্রমাণ হিসেবে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর করা কিছু মন্তব্যও আছে।

ইসরায়েল অনেকটা ক্ষুব্ধ হয়েই দক্ষিণ আফ্রিকার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, “নো, দক্ষিণ আফ্রিকা, গণহত্যার অপরাধ আমরা করিনি, এটি করেছে হামাস। তারা পারলে আমাদের সবাইকে হত্যা করতো। বিপরীতে আইডিএফ (ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স) যতটা সম্ভব নৈতিকভাবে কাজ করার চেষ্টা করেছে।”

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলেছে বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে তারা অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে।

এদিকে  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) একটি বৈঠক করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, গাজায় লাফিয়ে বাড়ছে অঙ্গহানির ঘটনা। বোমা-গুলিতে আহত ব্যক্তিরা হাসপাতালে এলে অনেকেরই অঙ্গ কেটে বাদ দিতে হচ্ছে। যদিও ভালোভাবে চিকিৎসা দেওয়া গেলে অনেকেরই অঙ্গ কেটে বাদ দিতে হতো না বলে মনে করছে ডাব্লিউএইচও।

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ) জানিয়েছে, গত ৭ অক্টোবরের পর থেকে কমপক্ষে ৩২ ফিলিস্তিনি সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। এর মধ্যে মাত্র একজনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তিনি হলেন দিয়া আল-কাহলাইত। বাকি ৩১ ফিলিস্তিনি সাংবাদিক এখনো বন্দী রয়েছেন। এদের বেশির ভাগের বিরুদ্ধেই কোনো অভিযোগ আনতে পারেনি ইসরায়েলি বাহিনী। অথচ বিনা অভিযোগেই দিনের পর দিন তাদের আটকে রাখা হচ্ছে।