ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক রুডইয়ার্ড কিপলিঙের বিখ্যাত উপন্যাস ‘মোগলি’র কথা কে না জানে! কিপলিঙের উপন্যাসের সেই চরিত্রকে নিয়ে সিনেমা, কার্টুনও হয়েছে। বন্যপশুদের মাঝে এক মানবসন্তানের বেড়ে ওঠার কাহিনি। পশুদের মতোই আচার-আচরণ, ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুলের সেই মানবশিশুই কিপলিঙের উপন্যাসের দৌলতে যেন জীবন্ত চরিত্র হয়ে উঠেছে।
কিন্তু জানা আছে কি, বাস্তবেও ‘মোগলি’র খোঁজ মিলেছে একাধিক বার! ভারতেও এক ‘মোগলি’কে পাওয়া গিয়েছিল। তা-ও আবার উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার অনেক আগেই। তাঁর নাম ছিল দিনা সানিচর।
উত্তরপ্রদেশের বুলন্দশহরের জঙ্গলে দিনার খোঁজ মিলেছিল ১৮৭৩ সালে। একদল নেকড়ের সঙ্গে ওই জঙ্গলে দিনাকে দেখতে পেয়েছিলেন শিকারিরা। দিনার বয়স তখন মাত্র ছয়। তবে আধুনিক সমাজের সঙ্গে শেষজীবন অবধি তিনি ভাল ভাবে খাপ খাওয়াতে পারেননি। ১৮৯৫ সালে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় দিনার।
সম্প্রতি থাইল্যান্ডে আরও এক জনের খোঁজ মিলেছে। তার সঙ্গেও ‘মোগলি’র মিল খুঁজে পেয়েছেন অনেকে। আট বছর বয়সি ওই বালক মানুষ হয়েছে ছ’টি কুকুরের সঙ্গে।
জানা গিয়েছে, আট বছর বয়সি ওই বালককে তার পরিবার বছরের পর বছর ধরে পরিত্যক্ত করে রাখার কারণে সে ছ’টি কুকুরের সঙ্গে বড় হচ্ছিল। মানুষের মতো কথা বলার বদলে কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করে ডাকতেও শিখেছে ওই বালক।
স্থানীয় এক স্কুলের অধ্যক্ষ এবং এক জন শিশু অধিকার কর্মী ছেলেটির অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করার পর বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে।
চিনা সংবাদমাধ্যম ‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’-এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই বালক স্কুলে না গেলেও তার মা পুত্রের পড়াশোনার খরচ বাবদ ৪০০ ভাট (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় হাজার টাকা) সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি বাবদ নিতেন। তবে সেই টাকা পুত্রের পড়াশোনার জন্য কখনও খরচ করেননি তিনি।
প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, ওই বালকের ৪৬ বছর বয়সি মা নিয়মিত কাছাকাছি গ্রাম এবং মন্দিরগুলিতে খাবার ও অর্থের জন্য ভিক্ষা করতে যান। উত্তর তাইল্যান্ডের উত্তরাদিত প্রদেশের একটি ছোট কাঠের বাড়িতে একা ফেলে রেখে যেতেন সন্তানকে। সেই সময়ে তার সঙ্গী ছিল ছ’টি কুকুর।
স্কুলের অধ্যক্ষ তথা রাজনীতিবিদ পাভিনা হংসাকুল সম্প্রতি ওই বালকের সম্পর্কে জানতে পেরে প্রশাসনের দ্বারস্থ হন। সরকারের তরফে ওই বালকের সঙ্গে দেখা করতে যায় প্রতিনিধিদল। কাঠের বাড়িটি পরিদর্শন করেন দলের সদস্যেরা।
প্রশাসনিক কর্তারা দেখেন, বাড়ির বাইরে ছয় কুকুরের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে বালক। আর জরাজীর্ণ ওই কাঠের বাড়ির ভিতরে রয়েছেন তার মা এবং ২৩ বছর বয়সি দাদা।
তাঁরা দেখেন, মহিলা এবং তাঁর বড় ছেলে মাদকাসক্ত। তাঁদের রক্তপরীক্ষা করার পরে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, ওই মহিলা এবং তাঁর বড় ছেলে দিনের পর দিন বালকটিকে একা ফেলে রেখেছিলেন। দেখাশোনাও করেননি।
সেই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে পাভিনা বলেন, ‘‘ওর সঙ্গে কথা বলতে গেলেও ও আমার সঙ্গে কথা বলেনি। শুধু ঘেউ ঘেউ করেছে। সেই দৃশ্য দেখে কষ্ট হয়েছে।’’
প্রশাসনিক কর্তারা তদন্ত চালিয়ে এ-ও দেখেছেন যে, ওই বালক জীবনে এক দিন মাত্র স্কুল গিয়েছিল, তা-ও খুব ছোটবেলায়। তার পর তাকে তার মা আর কখনও স্কুলে পাঠাননি। পাভিনার কথায়, ‘‘শিক্ষার জন্য সরকারের পাওয়া ভর্তুকি আত্মসাৎ করার লোভেই ওকে আর কখনও স্কুলে পাঠাননি ওর মা।’’
প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলেও ওই বালকের মায়ের কুকীর্তির কথা জানতে পেরেছেন প্রশাসনিক কর্তারা। প্রতিবেশীদের মতে, কুকুরগুলোর সঙ্গেই সারা দিন সময় কাটাত বালকটি। অন্য মানুষের সংস্পর্শে না আসার কারণে কুকুরগুলিকেই অনুকরণ করতে শুরু করে সে।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই বালকের মা এবং দাদাকে মাদকসেবনের অভিযোগে আটক করা হয়েছে এবং চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে। স্থানীয় একটি আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে বালকটিকে। বালকটির যাতে ঠিকঠাক যত্ন হয় এবং সে যাতে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিয়েছেন পাভিনা।
ভারতের অরণ্য থেকে কুড়িয়ে পাওয়া এই শিশুকে দেখে, কিপলিং লিখেছিলেন ‘মোগলি’
পৃথিবীর নানা দেশের পুরাণ, লোকগাথা ও সাহিত্যে ছড়িয়ে আছে বন্যপশু পালিত মানব শিশুদের কাহিনি। যারা মানব সমাজ থেকে পরিত্যক্ত হয়ে বা অন্য কোনওভাবে পৌঁছে গিয়েছিল দুর্গম অরণ্যে। বেঁচে গিয়েছিল অলৌকিকভাবে। কারণ অসহায় শিশুগুলিকে বুকে টেনে নিয়েছিল নেকড়ে, শিম্পাঞ্জি, বুনো কুকুর, হায়না, বানর, উটপাখি ও ভাল্লুকরূপী মায়েরা। যারা মানুষের মত দুধের শিশুকে মৃত্যুমুখে ছুঁড়ে ফেলে দিতে শেখেনি। অপত্য স্নেহে তারাই আগলে রেখেছিল পরিত্যক্ত মানব শিশুগুলিকে। নিজের দুধ খাইয়ে বড় করে তুলেছিল, নিজের শাবকদের সঙ্গে। শিখিয়েছিল অরণ্যের আইন কানুন। শিখিয়েছিল নির্মম অরণ্যে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ের প্রতিটি ধাপ।
মানব সন্তান হয়েও তাই এই শিশুদের আচার আচরণ হয়ে গিয়েছিল তাদের পালক পিতামাতা ও ভাই বোনেদের মতো। পশুদের মতোই এই শিশুরা চার হাতপায়ে হাঁটত। কেউ বানরের মত তরতর করে গাছে উঠে, এ ডাল ও ডাল ঘুরে ফল পেড়ে খেত। কেউ অক্লেশে সাঁতরে পার হয়ে যেত কুমীর গিজগিজ করা নদী। কেউ বা আবার পশুদের সঙ্গেই দল বেঁধে শিকার করত, শিকারের মাংস কাঁচা চিবিয়ে খেত। তেমনই ছিল মোগলি (mowgli)
যে বন্য শিশুকে নিয়ে কালজয়ী উপাখ্যান লিখে গিয়েছিলেন, ব্রিটিশ সাহিত্যিক ও সাংবাদিক রুডইয়ার্ড কিপলিং (Rudyard Kipling)। তাঁর হাতেই সৃষ্টি হয়েছিল কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া চরিত্র ‘মোগলি (mowgli)।’ বন্য শিশু মোগলির চরিত্রটি কিপলিং গড়ে তুলেছিলেন বাস্তবের এক বন্য শিশুর কাহিনি শুনে। যাকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল উত্তরপ্রদেশের জঙ্গলে। কিপলিংয়ের জন্মের ঠিক দু’বছর পরে।
যেভাবে গল্পে আত্মপ্রকাশ করেছিল মোগলি
১৮৯৩ সালে লেখা ‘In the Rukh’ গল্পে প্রথম মোগলি (Mowgli) চরিত্রটি এনেছিলেন কিপলিং। তবে প্রথম গল্পেই বালক মোগলিকে হাজির করেননি তিনি। বালক মোগলির প্রবেশ ঘটেছিল জাঙ্গল বুক-এর( গল্পগুলিতে। প্রথম গল্পে ছিল না বালু, বাগিরা, শের খান, কা, মেশুয়া, নাথু ও অনান্য চেনা চরিত্রগুলিও। প্রথম গল্পটিতে মোগলি ছিল এক সুদর্শন বন্য যুবক। গভীর অরণ্যে থাকতো নেকড়ে মা ও চার নেকড়ে ভাইয়ের সঙ্গে। যেকোনও পশুকে বশ করার অলৌকিক ক্ষমতা ছিল তার।
The Real Mowgli
মোগলির স্রষ্টা রুডইয়ার্ড কিপলিং
মোগলির এই ক্ষমতা দেখে, ব্রিটিশ ফরেস্ট অফিসার গিসবোর্ন তাকে ফরেস্ট গার্ডের চাকরিতে নিয়োগ করেছিলেন। গিসবোর্ন সাহেবের আর্দালি আব্দুর গফফরের মেয়ের প্রেমে পড়েছিল মোগলি। গফফর বাধা দিলেও গিসবোর্ন সাহেবের হুকুমে গফফরের মেয়ের সঙ্গেই মোগলির বিয়ে হয়েছিল। একটি সন্তানও হয়েছিল তাদের। কিন্তু যাকে অবলম্বন করে মোগলি চরিত্রটি গড়েছিলেন কিপলিং, তার জীবনকাহিনিটি কিন্তু কিপলিংয়ের গল্পগুলির মত সুন্দর ও জমজমাট ছিল না। বরং ছিল সম্পুর্ণ আলাদা ও মর্মান্তিক।
টিলার ওপরে নেকড়ের গুহা
১৮৬৭ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, বুলন্দশহরের অরণ্যে শিকার করতে গিয়েছিলেন কয়েকজন স্থানীয় শিকারি। গভীর অরণ্যটিতে ছিল শজারু, হায়না, নেকড়ে, চিতাবাঘ, ভাল্লুক, বনবিড়াল, শিয়াল, নীলগাই ও অনান্য পশুপাখি। তির-ধনুক ও গাদা বন্দুক দিয়ে শিকার করতে করতে শিকারিদের দলটি ক্রমশ এগিয়ে চলেছিল জঙ্গলের গভীরতম অংশের দিকে। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর, সামনে এসেছিল একটি টিলা। শিকারিদের চোখে পড়েছিল টিলার ওপর থাকা একটি গুহা। অভিজ্ঞ শিকারিরা অনুমান করেছিলেন, গুহাটি সম্ভবত চিতাবাঘ বা নেকড়ের। শিকারের আশায় তাঁরা নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছিলেন গুহাটির দিকে।
দূর থেকে শিকারিরা দেখেছিলেন গুহাটির সামনে শুয়ে আছে কোনও প্রাণী। বন্দুকের পাল্লা থেকে প্রাণীটি দূরে থাকায়, আর একটু কাছে এগোতে চেয়েছিলেন শিকারিরা। কিন্তু শিকারিদের পায়ের শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল প্রাণীটির। বিদ্যুৎবেগে প্রাণীটি ঢুকে গিয়েছিল গুহার ভেতর। কী প্রাণী সেটাও বোঝার সময় পাননি শিকারিরা। এরপর শিকারিরা ঘিরে ফেলেছিলেন গুহাটিকে। তাঁদের কানে এসেছিল কোনও হিংস্র পশুর চাপা গর্জন।
আরও পড়ুন: নির্জন দ্বীপে আঠারো বছর একা কাটিয়েছিল এই নারী, তবুও তাকে বাঁচতে দেয়নি সভ্যতা
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন শিকারিরা
গুহার সামনে শুকনো ঘাস জ্বালিয়ে তৈরি করা হয়েছিল ধোঁয়া। আগুনের হল্কা ও ধোঁয়া প্রবেশ করেছিল ছোট গুহাটিতে। গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছিল কয়েকটি নেকড়ে শাবক। মা নেকড়ে্কে মারার জন্য শিকারিরা গুহামুখের দিকে বন্দুক তাক করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের চোখ কপালে তুলে দিয়ে নেকড়ে বাঘের মতোই গর্জন করতে করতে গুহার বাইরে বেরিয়ে এসেছিল, সম্পূর্ণ উলঙ্গ এক শিশু। বয়স খুব বেশি হলে পাঁচ কি ছয়।
শিকারিরা শিশুটিকে ধরার চেষ্টা শুরু করেছিলেন। সেই সুযোগে পালিয়েছিল নেকড়ে শাবকেরা। কিন্তু শিশুটি কিছুতেই ধরা দেবে না। পশুর মতো আঁচড়াতে কামড়াতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু একসময় শিকারিরা ধরে ফেলেছিলেন শিশুটিকে। দড়ি দিয়ে শিশুটিকে বেঁধে, শিকারিরা নেমে এসেছিলেন টিলার ওপর থেকে। ধরে ছিলেন ফেরার পথ।
শিকারিদের সবার মনেই ঘোরাফেরা করছিল দু’টি প্রশ্ন। নেকড়ের গুহায় মানব শিশুটি এল কীভাবে এবং বাবা মা ছাড়া এই শিশুটি বিপদসংকুল অরণ্যে একা কীভাবে বেঁচে ছিল? হাজার জিজ্ঞেস করেও শিকারিরা কোনও উত্তর পাননি শিশুটির কাছ থেকে। শিশুটি কথা বলছিল না। শিকারিদের ইশারাও বুঝতে পারছিল না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল শিকারিদের দিকে। মাঝে মাঝেই তার গলা থেকে বেরিয়ে আসছিল রক্তজল করে দেওয়া চাপা গর্জন।
নেকড়ে-বালক দিনা শনিচর
জঙ্গল থেকে উদ্ধার করার পর, শিশুটিকে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আগ্রার সিকান্দ্রায় থাকা একটি অনাথ আশ্রমে। শিশুটিকে যে দিন অনাথ আশ্রমে দিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেদিন ছিল শনিবার। আদিবাসী রীতিতে বার দিয়ে নাম রাখার প্রথা বহু প্রাচীন।
যেমন সোমবার হলে নবজাতকের নাম রাখা হয় সোমবারি, মঙ্গলবার হলে মঙ্গলু, বুধবার হলে বুধুয়া। সেই প্রথা মেনেই পরিচয়হীন শিশুটির নাম মিশনারিরা রেখেছিলেন দিনা শনিচর (Dina Shanichar)।
গাছে চড়ছে বাস্তবের মোগলি দিনা শনিচর
অনাথ আশ্রমে আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মিশনারিরা লক্ষ্য করেছিলেন, শিশুটির আচার আচরণের সঙ্গে নেকড়ের অদ্ভুত মিল। হাতের তালু ও পায়ের তলা পশুদের মতোই শক্ত। শিশুটি দিনের বেলায় ঘুমাতো ও সারা রাত জেগে থাকত। অদ্ভুত সব আওয়াজ করত মুখ দিয়ে। যে ঘরে রাখা হয়েছিল শিশুটিকে, সেখানে সে খাঁচাবন্দী বাঘের মতোই চার হাত পায়ে পায়েচারি করত সারা রাত। কারণ সে দুই পায়ে ভর দিয়ে চলতে শেখেনি। তবে মাঝে মাঝে জানলার কাছে গিয়ে, হাত দিয়ে দেওয়াল ধরে, পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে, জানলার বাইরেটা দেখার চেষ্টা করতো। ঘরটির পিছনেই ছিল বাগান। সেখানে ছিল বড় বড় গাছ। দিনাকে তখন ভীষণ উত্তেজিত দেখাত।
চার হাত পায়ে হেঁটে খাবার খেতে আসছে দিনা শনিচর
শুরু হয়েছিল সভ্য করার চেষ্টা
দিনাকে পোশাক পরানোর চেষ্টা শুরু করেছিলেন মিশনারিরা। কিন্তু পোশাক পরাবার পরের মুহূর্তেই দাঁত দিয়ে পোশাক ছিঁড়ে দিয়ে আবার নগ্ন হয়ে যেতো দিনা। খাবার খেতে দিলে আগে সে শুঁকে দেখত, পছন্দ না হলে খাবারটিকে ছুঁত না। কাঁচা মাংস খেতে দিলে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে খেতে শুরু করত। ঘরের কোনে গিয়ে হাড় চিবাতো হিংস্র পশুদের মতই। বেশিরভাগ সময়েই একলা থাকতে পছন্দ করত দিনা। এসব আচরণের জন্যই দিনা শনিচরকে নেকড়ে-বালক বা আক্ষরিক অর্থে ‘নেকড়ের বাচ্চা’ বলে ডাকতে শুরু করেছিলেন মিশনারিরা।
খাবার খাচ্ছে দিনা শনিচর
মিশনারিদের মাধ্যমে দিনা শনিচরের কাহিনি ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে। পশ্চিমের খবরের কাগজগুলিও গুরুত্ব দিয়ে ছাপতে শুরু করেছিল দিনার কথা। এক মানুষরূপী নেকড়ে বালকের, পশু থেকে মানুষ হওয়ার মুখরোচক কাহিনি। ধীরে ধীরে দিনা মানিয়ে নিয়েছিল মানববেষ্টিত পরিবেশে। দুই পায়ে হাঁটতে শিখেছিল, পোশাক পরে থাকতে শিখেছিল, মানুষের ভাষা বুঝতে শিখেছিল। কিন্তু তাকে কথা বলাতে পারেননি মিশনারিরা।
জামা কাপড় পরতে শিখেছিল দিনা শনিচর
এগিয়ে আসছিল মুক্তির প্রহর
নেকড়ে-বালক দিনার আচরণের বিবর্তন দেখার জন্য, দল বেঁধে অনাথ আশ্রমটিতে আসতেন সাহেব-মেমেরা। বিপুল অর্থ জমা পড়তো অনাথ আশ্রমের তহবিলে। এভাবেই অনাথ আশ্রমে দিনা শনিচর কাটিয়েছিল প্রায় তিন দশক। পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চির মতো উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিল দিনা। কিন্তু মুক্তির প্রহর এগিয়ে আসছিল তার অজান্তেই। মিশনারিদের আশ্রয়ে আঠাশ বছর থেকেও দিনা আক্রান্ত হয়েছিল যক্ষ্ণায়। কেন তার যক্ষ্ণা হয়েছিল, সে প্রশ্নের উত্তর দেননি মিশনারিরা। ১৮৯৫ সালে, মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়েসে, বন্দিদশা থেকে চিরতরে মুক্তি পেয়েছিল দিনা শনিচর।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিলেন, অনাথ আশ্রমের চৌহদ্দিতে কুকুর, বিড়াল বা পাখি ঢুকলে, উত্তেজিত দিনা দৌড়ে যেত প্রাণীগুলির দিকে। যেন ওরাই তার আপনজন। পশুপাখিগুলি ভয় পেয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর, দুই হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে বসে থাকত দিনা। হয়ত তার বুক ফেটে যেত জঙ্গল ফিরে না পাওয়ার দুঃখে। তবুও তার চোখে দেখা যেতো না এক ফোঁটা জল। কারণ বাস্তবের মোগলি দিনা শনিচরকে, তার নেকড়ে মা মানুষের মত কাঁদতে শেখায়নি।