• ১০ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ২৬শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ১৫ই মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি

গুম কমিশনের দ্বিতীয় প্রতিবেদন : ‘ওড়না কেড়ে নিয়ে হাত বেঁধে ঝুলিয়ে রাখতো, আর বলতো এখন পর্দা ছুটে গেছে’

Usbnews.
প্রকাশিত জুলাই ৫, ২০২৫
গুম কমিশনের দ্বিতীয় প্রতিবেদন : ‘ওড়না কেড়ে নিয়ে হাত বেঁধে ঝুলিয়ে রাখতো, আর বলতো এখন পর্দা ছুটে গেছে’
নিউজটি শেয়ার করুনঃ

একের পর এক ভয়াল অভিজ্ঞতা, শরীরে চিহ্ন, আর মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে ফিরে এসেছেন শত শত মানুষ। কেউ কেউ ফিরে আসেননি, হারিয়ে গেছেন চিরতরে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে এমন গুম, অপহরণ ও ভয়ংকর নির্যাতনের বিস্তৃত অভিযোগ এখন আর শুধু পরিবার-পরিজনের কান্নায় আটকে নেই; উঠে এসেছে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের চূড়ান্ত নথিতে।

‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ: এ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনসিস অব এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ২৫৩ জন গুম হওয়া ব্যক্তির অভিজ্ঞতা, যারা কেউ ৩৯ দিন, কেউ ৩৯১ দিন ধরে বন্দী ছিলেন গোপন ‘টর্চার সেলে’। কোথাও মানুষ ঝুলিয়ে রাখা হতো, কোথাও দেয়া হতো বৈদ্যুতিক শক, আর নারীদের ওপর চালানো হতো এমন নির্যাতন যা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।

এই প্রতিবেদনে যেমন আছে দেহের ওপর চরম নিষ্ঠুরতা, তেমনি আছে মনের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নিপীড়ন। আছে নিখোঁজ থাকা পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক ও সামাজিক ধ্বংসযাত্রার করুণ কাহিনি।ভুক্তভোগীদের বর্ণনায় গোপন বন্দিশালার ভয়াবহ নির্যাতনের কথা নিচে তুলে ধারা হলো।

‘গ্রিলের সঙ্গে হাতকড়া পরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখত, যাতে বসতে না পারি। পা ফুলে যেত, হাত রক্তাক্ত হতো। টেবিলের ওপর হাত রেখে আঙুলে প্লাস দিয়ে চেপে ধরত, আরেকজন সুচ ঢুকাত।’ এভাবেই নির্যাতনের বর্ণনা দিলেন ২০১৭ সালে অপহৃত হাবিব। মাত্র ২৭ বছর বয়সে ১১৩ দিন ‘গুম’ হয়ে ছিলেন তিনি। শুধু হাবিব নন, এমন শত শত ভয়াবহ বর্ণনায় ভরে উঠেছে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন। এই রিপোর্টে উঠে এসেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার হাতে আটক ও গুম হওয়া ব্যক্তিদের ওপর চালানো অমানবিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের চিত্র।

‘গুমের’ নামে ভয়াবহ নির্যাতন

রিপোর্ট বলছে, র‍্যাব-২ ও সিপিসি-৩ এর হেফাজতে ছিল ঘূর্ণায়মান চেয়ার, পুলি সিস্টেম, সাউন্ডপ্রুফ রুম। বন্দিদের ঝুলিয়ে, মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়ে, বৈদ্যুতিক শকে, ওয়াটারবোর্ডিংয়ের মতো পদ্ধতিতে দিনের পর দিন নির্যাতন চালানো হতো।

গুমের শিকার বেশিরভাগ ব্যক্তিকে জনসম্মুখে হাজির করার আগে নির্যাতনের চিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা চলত। কেউ কেউ স্পষ্ট নির্যাতনের দাগ নিয়েই হাজির হলেও, বিচার বিভাগ অনেক সময় তা উপেক্ষা করত।

নারীদের ‘বিশেষ শাস্তি’

গুম কমিশনের দেওয়া প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে ২৫ বছর বয়সী এক নারীকে পুলিশ অপহরণ করে। তিনি ২৪ দিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন। ওই ভুক্তভোগী গুম কমিশনকে বলেন, ‘অনেকটা ক্রুসিফাইড হওয়ার মতো করে হাত দুই দিকে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখে। ওরা আমাদের ওড়না নিয়ে নেয়, আমার গায়ে ওড়না ছিল না। আর যেহেতু জানালার দিকে মুখ করা ছিল, অহরহ পুরুষ মানুষরা এসে আমাদের দেখছিল। এটা বলার বাহিরে! মানে তারা একটা মজা পাচ্ছিল। বলাবলি করতেছিল যে, ‘এমন পর্দাই করছে, এখন সব পর্দা ছুটে গেছে।’ আমার পিরিয়ড হওয়ার ডেট ছিল অনেক লেটে। কিন্তু যেই টর্চার করে তাতে আমি এত পরিমাণ অসুস্থ হয়ে পড়ি যে, সঙ্গে সঙ্গে আমার পিরিয়ড আরম্ভ হয়ে যায়। তারপর উনাদেরকে বলি যে, ‘আমার তো প্যাড লাগবে’। এটা নিয়েও অনেক হাসাহাসি করে ওরা।’

শারীরিক নির্যাতনের ভয়াবহতা

ছাদের সঙ্গে ঝুলিয়ে বন্দিদের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হতো। সিটিটিসি কর্তৃক ২০২৩ সালে অপহৃত হন ৪৭ বছর বয়সী এক যুবক। ১৬ দিন গুম ছিলেন তিনি। তার বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্যাতনকারীরা বলছে, ‘এভাবে হবে না। এরে লটকা। টানাইতে হবে।’ তো একজন এএসআই (পুলিশে সহকারী উপ-পরিদর্শক) বলে, হবে। সে আমার দুই হাতে রশি লাগায়। এরপর ফ্যানের হুকের সঙ্গে রশি দিয়ে ঝুলিয়ে দেয়। শুধু পায়ের বুড়ো আঙুলটা লাগানো থাকে মেঝেতে, পুরা শরীরটা ঝুলানো।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, গুম হওয়া ব্যক্তিরা নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে যেতেন। বমি করে দিতেন। কেউ কেউ আবার চোখ বাঁধা অবস্থায় নিজের শরীরের মাংস পোড়ার গন্ধ পেতেন। নির্যাতনের ভয়াবহতা থেকে রেহাই পেতেন না গুমের শিকার নারীরাও। তাদের ঝুলিয়ে বিকৃত উল্লাস করে অট্ট হাসিতে ফেটে পড়তেন বাহিনীর সদস্যরা।

বাঁশ দিয়ে নির্যাতন (বাঁশডলা)

২০১৭ সালে র‌্যাব-১০ কর্তৃক ২৭ বছর বয়সী এক যুবককে অপহরণ করা হয়। তিনি ৩৯ দিন গুম ছিলেন। নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে ওই যুবক বলেন, “শোয়ানোর পর আমার এই দুই হাতের উপর দিয়া আর ঘাড়ের নিচ দিয়া একটা বাঁশ দিছে। পরে পায়ের নিচ দিয়া আর রানের নিচ দিয়া একটা দিল। আবার রানের উপর দিয়াও একটা দিছে। দেওয়ার পর ওইভাবে আমাকে কিছুক্ষণ রাখল। পরে বলে যে, ‘বড় স্যার আসতেছে না।’ কিছুক্ষণ পর সে আসে। আসার পর হঠাৎ করেই বলল, ‘এই উঠ’। বলার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো যে, আমি আর দুনিয়ার মধ্যে নাই। এমন যন্ত্রণা আমার দুই হাতের বাহুতে শুরু হইছে, আর দুই পায়ের মধ্যে শুরু হইছে…। মনে হইতেছে কেউ আমার এই দুই হাত আর পায়ের গোস্তগুলো ছিঁড়া ফেলতেছে…।’

অভিনব পদ্ধতিতে নির্যাতন

২০১৭ সালে ২৩ বছর বয়সী এক যুবককে অপহরণ করে র‌্যাব। সেই ভুক্তভোগীকে বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার জেআইসি’তে আটক রাখা হয়। যেখানে টর্চারের কারণে তার নাভির দুই পাশে আঘাতের চিহ্ন সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, ‘আমার পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। মাথা নিচের দিক, পা ওপরে দিক। আমার শরীরে কোনো পোশাক রাখে নাই তখন। তারপর আমাকে দুজন একসঙ্গে এলোপাথাড়ি পিটাতে থাকে। খুব সম্ভব বেতের লাঠি দিয়ে। পরবর্তীতে আমাকে অসংখ্যবার টর্চার করেছে এবং মারতে মারতে আমার এমন হয়েছে যে, চোখের কাপড়ও খুলে গেছে। নাকে-মুখে চড়ানো, থাপড়ানো…। শুধু পেছনে মারছে। ওই সময়ে চামড়া ছিঁড়ে, মানে চামড়া ফেটে রক্ত ঝরেছে। তিনি ৭২ দিন গুম ছিলেন।

নতুন নতুন কৌশলে নির্যাতন করা হতো টর্চার সেলে। প্রায়ই নখ উপড়ে ফেলা হতো সেখানে। ২০১৭ সালে র‌্যাব-১১ কর্তৃক অপহৃত হন ৫৬ বছর বয়সী এক ভুক্তভোগী। তিনি বলেন, ‘পরে নাম জানতে পেরেছি। তখন জানতাম না। সে (আলেপ উদ্দিন) লাঠি দিয়ে খুব টর্চার করত। একদিন আমাকেও বেশ টর্চার করে। টর্চার করে আর বলে যে, ‘তাকে টাঙায় রাখ, ঝুলায় রাখ।’ সেলের গ্রিলের সঙ্গে আমাকে ঝুলায় রাখল। সঙ্গে হাতকড়া ছিল। তো এইভাবে অনেক ঘণ্টা রাখার পর আমি আর পারছিলাম না। ওইদিনের পরে যখন টর্চার করল, আঙুলের নখটা পুরা উঠে গেছিল।’

‘ঘুমাতে গেলে একজন আইসা বলতেছে যে, ‘এই ঘুমাইতেছেন ক্যান?’

থাকার স্থানের ভয়াবহ ও অমানবিক অবস্থার কথা তুলে ধরেন অপর এক ভুক্তভোগী। গুম হওয়া ব্যক্তি বলেন, ‘ঘুমাতে গেলে একজন আইসা বলতেছে যে, ‘এই ঘুমাইতেছেন ক্যান?’ মানে ঘুমাইতে দিত না। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে যাওয়ার পর বালিশ সরাই ফেলত। শীতের মধ্যে কম্বল-বালিশ সব সরাই ফেলত। এছাড়া চেয়ার ছাড়া (খালি পায়ের ওপর ভর দিয়ে) বসায় রাখত। আবার দেখা গেছে, হ্যান্ডকাপ পরায়ে বিছানার পাশে আটকে রাখত। এক হাতে মশা কামড়ালে মারা যেত না। খুব কষ্ট পাইতাম আর কী!’ তিনি ৩৯১ দিন গুম ছিলেন। তার বয়স ছিল ৪৬ বছর।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সেলগুলো ছিল ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ। সেখানে টয়লেট ব্যবহারের জন্য নিচু বিল্ট-ইন প্যান বসানো ছিল। তবে, মাঝে কোনো দেয়াল না থাকায় ভুক্তভোগীরা যখন শুয়ে থাকতেন, তখন তাদের শরীর প্রায়শই ওই প্যানের ওপরে পড়ে থাকত। ফলে তারা ময়লা, প্রস্রাব ও মলের অস্বাস্থ্যকর অবস্থার মধ্যে থাকতে বাধ্য হতেন। আরও ভয়াবহ ছিল, এসব সেলে স্থাপন করা ছিল সিসিটিভি ক্যামেরা। যার মাধ্যমে প্রতিটি কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করা হতো। অর্থাৎ ভুক্তভোগীদের সবচেয়ে ব্যক্তিগত মুহূর্তেও, যেমন- প্রাকৃতিক কাজের জন্য টয়লেট প্যান ব্যবহারের সময়ও চরম অপমান ও লজ্জার মধ্যে থাকতে হতো। অত্যন্ত ছোট ও সংকীর্ণ কক্ষগুলো বন্দিদের জন্য সর্বোচ্চ অস্বস্তি তৈরি করত।

বাস্তব পরিস্থিত আরও ভয়াবহ’

গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন (দ্য কমিশন অব এনকোয়ারি অন এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স) গঠিত হয়। এরপর কমিশন বলপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান, শনাক্ত, কোন পরিস্থিতিতে গুম হয়েছিলেন-তা নির্ধারণে কাজ শুরু করে।

বন্দিশালার ভয়াবহতা উঠে এলো গুমের শিকার ব্যক্তিদের বর্ণনায়

গামছা দিয়ে মুখ ঢেকে দেওয়ার পর ঢালা হতো পানি। তখন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যেত। মনে হতো, ডুবে যাচ্ছেন। ভয়, আতঙ্ক আর শ্বাসরোধে কেউ কেউ অজ্ঞান হয়ে যেতেন। নির্যাতনের এ পদ্ধতির নাম ‘ওয়াটারবোর্ডিং’।

র‌্যাবের গোপন বন্দিশালায় গুমের শিকার ব্যক্তিদের ওপর এমন ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হতো বলে উঠে এসেছে তদন্ত কমিশনের গুম-সংক্রান্ত দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে।

গত ৪ জুন ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ : আ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনসিস অব এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে প্রায় ১ হাজার ৮৫০টি অভিযোগ বিশ্লেষণ করে ২৫৩ জন গুমের শিকার ব্যক্তির তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে কমিশন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর হাতে গুম হওয়া ব্যক্তিরা অস্বাস্থ্যকর সেলে বন্দি রাখা, উল্টো করে ঝুলিয়ে মারধর করা, নখ উপড়ে ফেলা, বৈদ্যুতিক শক, ঘূর্ণমান চেয়ারে বসানোসহ নানা পদ্ধতিতে করা ভয়াবহ নির্যাতনের কথা বলেছেন।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব গুম, অপহরণ বা আটকের কোনো লিখিত রেকর্ড রাখা হয়নি। ফলে নির্যাতনের দায় এড়ানো গেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এর আগে গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন তাদের প্রথম অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে বিরোধী মতের মানুষকে গুমের সঙ্গে কারা জড়িত, কীভাবে গুম করা হতো, কীভাবে নির্যাতন বা হত্যা করা হতো, তার নানা বর্ণনা উঠে আসে।

২০১৭ সালে র‌্যাব-১০-এর কাছে ৩৯ দিন বন্দি ছিলেন ২৭ বছর বয়সী এক তরুণ। প্রতিবেদনে তার জবানবন্দি তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘মুখে গামছা দিয়ে পানি মারা শুরু করে। জগ ভর্তি করে মুখের ওপর পানি দিয়েছে। এতে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। তারপর গামছা সরাইয়া দিয়ে বলে, “কী করছিস?” তখন আমি বলি, “স্যার কী কমু? আপনি আমারে বলেন, কেন ধইরা আনছেন?” তখন বলতেছে, “না ওরে হইতো না। আবার গামছা দে, পানি দে।” এইভাবে তিন-চারবার পানি দেওয়ার পর বলছে ওরে নিয়ে রাইখা আয়।’

এ নির্যাতন পদ্ধতিই ছিল নিয়মিত চর্চা। শুধু এই তরুণ নন, এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন আরও অনেকে।

গুমের শিকার ভুক্তভোগীরা আরও জানান, অস্বাস্থ্যকর সেলে দিনের পর দিন বন্দি রাখা হতো তাদের। ছোট ও অন্ধকার কক্ষে থাকা-খাওয়ার জায়গা ও টয়লেট একসঙ্গেই ছিল। এমন অমানবিক পরিবেশের মধ্যে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে চলত নিরবচ্ছিন্ন নজরদারি। টয়লেট ব্যবহার করার সময়ও যা বন্ধ হতো না, যা ভুক্তভোগীর জন্য চরম অপমান ও লজ্জার।

নির্যাতনের জন্য ঘূর্ণমান যন্ত্রপাতি সম্পর্কে একাধিক বিবরণ পাওয়া গেছে। সাক্ষ্য-বিশ্লেষণ করে দুটি ভিন্ন ধরনের যন্ত্র সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে কমিশন। এর একটি ঘূর্ণমান চেয়ার, যা র‌্যাবের টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন সেলে (টিএফআই) ব্যবহার করা হতো।

ভুক্তভোগীরা বলেন, ঘূর্ণমান চেয়ারে বসিয়ে দ্রুতগতিতে ঘোরানো হতো। কেউ বমি করে ফেলতেন, কেউ প্রস্রাব-পায়খানা করে দিতেন, কেউবা অজ্ঞান হয়ে যেতেন।

প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) নিয়ন্ত্রিত জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে (জেআইসি) আরও ভয়াবহ ‘ঘূর্ণমান যন্ত্র’ ব্যবহার হতো। এটি চেয়ার নয়; বরং পুরো শরীর ঘোরানোর যন্ত্র।

এ ছাড়া র‌্যাবের বন্দিশালায় আগে চোখ বেঁধে মারধর করা হতো। মারধর ও জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে প্রস্রাব করতে বলা হতো। প্রস্রাব করার সময় দেওয়া হতো বৈদ্যুতিক শক।

সেখান থেকে ফিরে আসা একজন বলেন, ‘প্রস্রাব করার সঙ্গে সঙ্গে মনে হতো আমি পাঁচ ফিট ওপরে উঠে গেছি। মনে হতো শরীরের বড় কোনো স্থানে শক দেওয়া হয়েছে।’

২০১৫ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার হাতে ৩৯১ দিন বন্দি ছিলেন ৪৬ বছর বয়সী এক ব্যক্তি। তিনি তার ওপর চালানো নির্যাতনের বর্ণনায় বলেছেন, ‘ঘুমাতে দিত না। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে যাওয়ার পর বালিশ সরাই (সরিয়ে) ফেলত। শীতের মধ্যে কম্বল-বালিশ সব সরাই ফেলত। চেয়ার ছাড়া খালি পায়ের ওপর ভর দিয়ে বসিয়ে রাখত। আবার অনেক সময় হ্যান্ডকাপ পরিয়ে বিছানার সঙ্গে আটকে রাখত। মশা কামড়ালেও মারতে পারতাম না। এভাবে শাস্তি দিত।’

গুম কমিশনের সদস্য মানবাধিকারকর্মী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘গুম হওয়া ব্যক্তিদের নির্যাতন সম্পর্কে আমাদের যতটুকু ধারণা ছিল, বাস্তব পরিস্থিত আরও ভয়াবহ ছিল। ভুক্তভোগীদের বর্ণনা না শুনলে সেটি কল্পনাও করা যাবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘নির্যাতনের এমন কোনো পদ্ধতি ছিল না, যেটা প্রয়োগ করা হয়নি। মৃতপ্রায় অবস্থা হওয়ার আগ পর্যন্ত নির্যাতন চালানো হতো।’