ইসরাইলি হামলার ১০০ দিনের মধ্যে গাজার ৭০ শতাংশ বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে। বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা আশঙ্কা করছে যে- যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও তাদের নিজ শহরে ফিরে যাওয়ার মতো আর কিছুই থাকবে না।
সোমবার কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিবারের সাথে দক্ষিণ গাজার একটি তাঁবুতে আশ্রয় নেয়া শাহিনাজ বকর নামে এক নারী প্রতিবেদকের কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আমরা যখন গাজা শহরে ফিরে যাব তখন আমরা কোথায় যাব? আমরা কোথায় থাকব?’
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, শাহিনাজ বকর বলেন, ‘আমাদের বাড়ি, বাজার, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিষ্ঠান সব ধ্বংস হয়ে গেছে। আমাদের যা আছে সব এখানে আছে, আমরা যদি গাজা শহরে ফিরে যাই, তাহলে তাঁবু ফেলেই বসবাস করতে হবে।’
তিনি হতাশাচিত্তে বলেন, ‘বাস্তুচ্যুত হওয়া কি আমাদের নিয়তি? ১৯৪৮ সালে বাস্তুচ্যুত হয়েছি, এখন আবার ২০২৪ সালে?’
এদিকে, গত ৭ অক্টোবর থেকে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় অব্যাহত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। এই ১০০ দিনে প্রায় ২৪ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে তারা।
গাজায় ইসরাইলি হামলার শততম দিবস উপলক্ষে প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি পর্যন্ত বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভকারীরা দ্রুত এ যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরাইলি হামলায় ২৩ হাজার ৯৬৮ জন নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই নারী ও শিশু।
শত দিন ধরে চলা ইসরাইলি আগ্রাসনে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে গাজার প্রায় ২০ লাখ মানুষ। ২৩ লাখ গাজাবাসীর প্রায় ৮৫ শতাংশই হারিয়েছে তাদের সর্বস্ব। ধ্বংস করা হয়েছে গাজার প্রায় ৩ লাখ ৫৯ হাজার ঘরবাড়ি।
ইসরাইল জানিয়েছে, তারা গাজার প্রায় ৩০ হাজার লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। ইসরাইলের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে তারা ২ হাজার ৩০০ ফিলিস্তিনিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। ইসরাইলি অভিযান অব্যাহত রয়েছে অধিকৃত পশ্চিমতীরেও।
ফিলিস্তিনি প্রিজনার্স সোসাইটির তথ্যমতে, গত ১০০ দিনে ইসরাইলি সেনাবাহিনী পশ্চিমতীর থেকে ৫ হাজার ৮৭৫ জন ফিলিস্তিনিকে গ্রেফতার করেছে। এর মধ্যে ৩৫৫টি শিশু ও ২০০ নারী রয়েছে।
আজ (রোববার) যুদ্ধের ১০০তম দিনেও গাজায় ব্যাপক হামলা চালিয়েছে দখলদার ইসরাইল। এই হামলায় গত ২৪ ঘণ্টায় ১২৫ জন ফিলিস্তিনি শহীদ ও ২৬৫ জন আহত হয়েছেন।
এ নিয়ে গাজায় গত ১০০ দিনে মোট ২৩ হাজার ৯৬৮ জন ফিলিস্তিনি শহীদ হলেন। মোট আহতের সংখ্যা ৬০ হাজার ৫৮২ জন। হতাহতদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
গত ৭ অক্টোবর দখলদার ইসরাইলের দখলদারি ও হত্যা-নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রশংসনীয় ও অভাবনীয় হামলা চালায় ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস। সেদিন থেকেই গাজার নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষদের ওপর সর্বাত্মক হামলা ও গণহত্যা শুরু করে বর্ণবাদী ইসরাইল। এর পর কেটে গেছে ১০০ দিন।
এই সময়ে গাজার মোট ভবনের ৪৫ থেকে ৫৬ শতাংশ ধ্বংস অথবা বড় আকারে ক্ষতির শিকার হয়েছে। গাজার ৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে মাত্র ১৫টি আংশিকভাবে কার্যকর রয়েছে। বাকি ২১টির কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ আছে। ব্যাপক আকারে ক্ষুধা ও অনাহারে ভুগছেন পাঁচ লাখ ৭৬ হাজার ৬০০ ফিলিস্তিনি।
গাজার ৬৯ শতাংশেরও বেশি স্কুল ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৪২টি মসজিদ ও ৩টি গির্জা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১২১টি অ্যাম্বুলেন্স ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে ছয় লাখ ২৫ হাজার শিক্ষার্থী।
ইহুদিবাদীদের উদ্দেশে ফিলিস্তিনের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের সামরিক শাখা আল কাসসাম ব্রিগেডস-এর পক্ষ থেকে ভিডিওটি প্রকাশ করা হয়েছে।
এখানে বলা হচ্ছে, “যত দ্রুত পারো তোমাদের বন্দিদের ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করো। কারণ, নেতানিয়াহুর হাতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকলে কিন্তু তারা কেউ বেঁচে থাকবে না।”
এদিকে, গাজায় হামাসের হাতে আটক বন্দিদের মুক্ত করে আনার দাবিতে তেল আবিবের ‘পণবন্দি’ স্কয়ারের গতকাল অনুষ্ঠিত সমাবেশে ৩ লাখের বেশি লোক সমবেত হয়েছিল বলে জানিয়েছে টাইমস অব ইসরাইল। সমাবেশে জনতার সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের সঙ্গে সংহতি জানাতে বাধ্য হয়েছেন ইসরাইলি যুদ্ধিবিষয়ক মন্ত্রী বেনি গান্তজ।সূত্র : আল-জাজিরা
ইসরাইলি সেনারা জর্দান নদীর পশ্চিম তীর থেকে হামাসের নিহত উপ প্রধান সালেহ আল-আরুরির দুই বোনসহ বহু মানুষকে ধরে নিয়ে গেছে। দখলদার সেনারা আজ ভোরে রামাল্লাসহ পশ্চিম তীরের বিভিন্ন শহরে হানা দিয়ে এসব ফিলিস্তিনিকে ধরে নিয়ে যায়।
ফিলিস্তিনি বার্তা সংস্থা ওয়াফা জানিয়েছে, ইসরাইলি সেনারা মাজরা’ আল-গারবিয়া, আরুরা ও বিরজিত শহরের পাশাপাশি জালাজোন শরণার্থী শিবিরে হানা দেয়। আজ ভোররাতে দখলদার সেনারা সাঁজোয়া যান ও সামরিক জিপে করে এসব শহরে ঢুকে পড়ে।
ইহুদিবাদী সেনারা বেশ কিছু ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে ও সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় তারা প্রচুর সংখ্যক ফিলিস্তিনিকে আটক করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। আটকদের মধ্যে সালেহ আল-আরুরির বোন দালাল আল-আরুরি ও ফাতিমা আল-আরুরি রয়েছেন।
হামাসের উপ প্রধান সালেহ আল-আরুরিকে গত ২ জানুয়ারি লেবাননের রাজধানী বৈরুতের দাহিয়া এলাকায় ড্রোন হামলা চালিয়ে হত্যা করেছে। হামাসের পলিটব্যুরো সদস্য ইজ্জাত আর-রিশক ওই হত্যাকাণ্ডকে কাপুরুষোচিত গুপ্তহত্যা বলে অভিহিত করেন।
শহীদ আরুরি হামাসের সিনিয়র পলিটব্যুরো সদস্য হওয়া সত্ত্বেও সামরিক দিকটি বেশি দেখাশুনা করতেন। এর আগে তিনি পশ্চিম তীরের যোদ্ধাদেরকে সশস্ত্র সংগ্রামে নামতে উদ্বুদ্ধ করেন। গত ৭ অক্টোবর হামাস ইসরাইরের অভ্যন্তরে ঢুকে যে হামলা চালিয়েছিল তার অন্যতম প্রধান পরিকল্পনাকারী ছিলেন সালেহ আল-আরুরি।সূত্র : আল-জাজিরা
রোববার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানিয়েছেন, একশ দিন হয়ে গেল, এখনো হামাসের হাতে বন্দি অন্তত ১৩০ জন। এর মধ্যে ছয়জন মার্কিন আছেন। তিনি এবং তার দল প্রতিনিয়ত এই বন্দিদের কীভাবে মুক্ত করা যায়, তার পরিকল্পনা চালিয়ে যাচ্ছেন। নিয়মিত বৈঠক করছেন। ওই বন্দিদের মুক্ত করা তার কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বাইডেন জানিয়েছেন, গত এই একশ দিন ধরে লাগাতার বন্দিদের মুক্ত করার জন্য নানা কাজ করা হয়েছে। দ্রুত যাতে তাদের মুক্ত করা যায়, তার ব্যবস্থা হচ্ছে। একইসঙ্গে ওই বন্দিদের স্বাস্থ্যের খবর রাখা হচ্ছে সর্বদা। উল্লেখ্য, গত ৭ অক্টোবর হামাস ইসরাইল থেকে শতাধিক ব্যক্তিকে পণবন্দি করে। হামাসের গুলিতে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। তার পরেই ইসরাইল হামাসের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে।
ক্ষুধার্ত মানুষ এবং মৃতদেহ রাস্তায় পড়ে আছে: এভাবেই উত্তর গাজার পরিস্থিতির ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছেন ছিটমহলে ত্রাণ কার্যক্রমের দায়িত্বে থাকা জাতিসংঘের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা।
‘সাম্প্রতিক দিনগুলিতে যে সহকর্মীরা উত্তরে গিয়েছেন তারা সম্পূর্ণ ভয়ঙ্কর দৃশ্য বর্ণনা করেছেন: রাস্তায় পড়ে রয়েছে লাশগুলো। অনাহারের স্পষ্ট লক্ষণ সহ লোকেরা বেঁচে থাকার জন্য যা কিছু পেতে পারে তার সন্ধানে ট্রাক থামিয়ে ভিড় করে,’ মার্টিন গ্রিফিথস, জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি-জেনারেল ফর হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্স এবং জরুরী ত্রাণ সমন্বয়কারী, শুক্রবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের বলেছেন।
‘এমনকি যদি মানুষ বাড়ি ফিরতে সক্ষমও হয়, তবে অনেকের কাছে আর যাওয়ার জন্য বাড়ি নেই,’ তিনি বলেছিলেন, আশ্রয়কেন্দ্রগুলো ইতিমধ্যেই তাদের ধারণ ক্ষমতায় চেয়ে অনেক বেশি লোককে আবাসন দিচ্ছে।
খাদ্য ও পানি ফুরিয়ে যাওয়ার ফলে দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি দিন দিন বেড়েই চলেছে, তিনি বলেন, যখন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ‘ধ্বংস অবস্থায়’। মহিলারা নিরাপদে সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম এবং শিশুরা টিকা নিতে পারছে না, সংক্রামক রোগের ঘটনা বাড়ছে এবং লোকেরা হাসপাতালের উঠানে আশ্রয় চাইছে, তিনি বলেছিলেন।
বৃহস্পতিবার, জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয়ের কার্যালয় বলেছে যে, ইসরাইল উত্তর গাজায় প্রবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু ইসরাইল জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থার বিরুদ্ধে যথেষ্ট কাজ না করার এবং অগ্রগতি ‘থমকে যাওয়ার’ অভিযোগ করেছে।
একটি কঠোর সমালোচনায়, গ্রিফিথস বলেছিলেন যে, তার দলের মানবিক কনভয়গুলোকে উত্তরে পাঠানোর প্রচেষ্টা ইসরাইলের ‘বিলম্ব, অস্বীকার এবং অসম্ভব শর্ত আরোপের জন্য বিঘ্নিত হয়েছে,’ যখন ‘মানবতাবাদী বিজ্ঞপ্তি ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধার অভাব সাহায্যের প্রতিটি প্রচেষ্টাকে বাধা দেয়।’
ছিটমহলের অন্যান্য অংশে মানবিক সহায়তা প্রদানের প্রচেষ্টাও খারাপভাবে প্রভাবিত হয়েছে। ‘খান ইউনিস এবং মধ্যবর্তী এলাকায় আমাদের প্রবেশাধিকার অনেকাংশে অনুপস্থিত,’ তিনি বলেছিলেন। সূত্র: সিএনএন।
(সকল ছবি সংগৃহীত)