বিশ্বখ্যাত হীরকখণ্ড ‘দরিয়া-ই-নূর’-এর প্রকৃত অবস্থান যাচাইয়ে বিশেষ কমিটি গঠন করেছে সরকার। দীর্ঘদিন ধরে সোনালী ব্যাংকের ভল্টে সংরক্ষিত বলে ধারণা করা এই হীরক নিয়ে বিতর্ক থাকায় বিষয়টি পুনঃতদন্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শিগগির এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচন করা হবে। এরই মধ্যে কমিটির সদস্যরা সোনালী ব্যাংকের ভল্ট পরিদর্শনও করেছেন।
মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, দরিয়া-ই-নূর তদন্তে গঠিত কমিটির সদস্য হিসেবে রয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব নাসিমুল গনি, ভূমি মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব এ এস এম সালেহ আহমেদ, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. লিয়াকত আলী মোল্লা, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মফিদুর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর জাকির হোসেন চৌধুরী, জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক তানজিম ইবনে ওয়াহাব, সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শওকত আলী খান এবং একজন রত্নবিশেষজ্ঞ।
সরকারি সূত্রে জানা যায়, মোগল সম্রাট শাহজাহানের সময় সংগৃহীত বিরল এই হীরক একসময় ভারতীয় উপমহাদেশের রাজকীয় সম্পদ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ইতিহাসবিদদের মতে, বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার রাজকোষেও এটি অলংকার হিসেবে সংরক্ষিত ছিল।
কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘দরিয়া-ই-নূর শুধু একটি রত্ন নয়, এটি আমাদের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতীক। এটি সোনালী ব্যাংকের ভল্টে আছে বলে জানা গেলেও এতদিন কেউ সিলগালা খুলে দেখেননি।
ভূমি সংস্কার বোর্ডের তালিকা অনুযায়ী, ঢাকার নবাব পরিবারের ১০৯ ধরনের রত্নের মধ্যে সবচেয়ে দামি বস্তুটি হলো ২৬ ক্যারেটের একটি টেবিল কাট হীরা, যা ইতিহাসে ‘দরিয়া-ই-নূর’ নামে পরিচিত। ১৯০৮ সালের পর থেকে এই হীরা ব্যাংকের ভল্টে সিলগালা অবস্থায় রয়েছে। তবে হীরাটি আদৌ ভল্টে আছে কি না, তা নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেননি হীরা আসলেই সেখানে আছে কি না। ভূমি সংস্কার বোর্ডও এ বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য দিতে পারেনি।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, দরিয়া-ই-নূর প্রথমে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের গোলকুন্ডা খনি থেকে পাওয়া যায়। পরে এটি মারাঠা রাজাদের, তারপর হায়দরাবাদের নবাবদের হাতে আসে। পরবর্তী সময়ে পারস্যের সম্রাট ও পাঞ্জাবের রাজা রণজিৎ সিংয়ের হাতে যায়। ১৮৪৯ সালে ব্রিটিশরা পাঞ্জাব দখল করলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হীরাটি দখল করে নেয়। পরে ১৮৫২ সালে কলকাতার হ্যামিল্টন অ্যান্ড কোম্পানির মাধ্যমে নিলামে বিক্রি হয় হীরাটি। সে সময় ঢাকার জমিদার নবাব খাজা আলীমুল্লাহ ৭৫ হাজার টাকায় এটি কিনে নেন। এরপর থেকে এটি ঢাকার নবাব পরিবারের কাছে সংরক্ষিত ছিল।
১৯০৮ সালে আর্থিক সংকটে পড়ে নবাব সলিমুল্লাহ ১৪ লাখ রুপি ঋণ নেন পূর্ববঙ্গ ও আসাম সরকারের কাছ থেকে। সে সময় দরিয়া-ই-নূরসহ নবাব পরিবারের সব রত্ন বন্ধক রাখা হয়। এরপর এসব রত্ন ইম্পেরিয়াল ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান হয়ে স্বাধীনতার পর সোনালী ব্যাংকের ভল্টে সংরক্ষিত রয়েছে।
ভূমি সংস্কার বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা কখনো হীরাটি নিজের চোখে দেখেননি। ১৯০৮ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত হীরার কোনো পরিদর্শন হয়নি, যদিও পরবর্তী কয়েক দশকে আটবার আনুষ্ঠানিক পরিদর্শনের কথা নথিতে উল্লেখ আছে—কিন্তু সেসবের প্রতিবেদন আজও অনুপস্থিত।
এদিকে, ইরানের তেহরানে সেন্ট্রাল ব্যাংক অব ইরানের ন্যাশনাল জুয়েলারি মিউজিয়ামে ‘দরিয়া-ই-নূর’ নামে একটি হীরা সংরক্ষিত আছে বলে জানা যায়। গোলাপি রঙের টেবিল কাট হীরাটি ১৮২ ক্যারেট ওজনের, যা অন্ধ্র প্রদেশের একই খনি থেকে পাওয়া। ঢাকার নবাব পরিবারের হীরাটির ওজন ২৬ ক্যারেট হওয়ায় বিশেষজ্ঞদের মতে, দুটি হীরা আলাদা হতে পারে।
ভূমি সংস্কার বোর্ড জানিয়েছে, হীরার রহস্য উন্মোচনে আগ্রহী বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। ভূমি উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারের নির্দেশে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠনের প্রস্তাব ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
ইতিহাস গবেষকরা মনে করেন, দরিয়া-ই-নূরের প্রকৃত অবস্থান ও সত্যতা যাচাইয়ের পর এটি জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা উচিত। সরকারি পর্যায়ে আশা করা হচ্ছে, শিগগির বিশেষ কমিটির আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মাধ্যমে বহু শতাব্দীর রহস্যে ঢাকা দরিয়া-ই-নূরের সত্যতা উন্মোচন করা সম্ভব হবে।