• ১৫ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ৩০শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ২৪শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

গাজার ভয়াবহ যুদ্ধ তৃতীয় বছরে : মৃত্যু ক্ষুধা ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা ২২ লাখ ফিলিস্তিনি

Usbnews.
প্রকাশিত অক্টোবর ৮, ২০২৫
গাজার ভয়াবহ যুদ্ধ তৃতীয় বছরে : মৃত্যু ক্ষুধা ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা ২২ লাখ ফিলিস্তিনি
নিউজটি শেয়ার করুনঃ

গাজার ভয়াবহ যুদ্ধ তৃতীয় বছরে পা দিয়েছে। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধের পর এটি সবচেয়ে দীর্ঘ সংঘাত। এই যুদ্ধের মূল বোঝা বইছে সাধারণ মানুষ। ইসরায়েলের হামলায় এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৬৭ হাজার ছাড়িয়েছে, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক। পুরো পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এক আঘাতে—এমন পরিবারের সংখ্যাও অসংখ্য। কোথাও কোথাও শুধু একটি শিশু বেঁচে আছে। আহতের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার। যুদ্ধের শুরুতে গাজার জনসংখ্যা ছিল ২৩ লাখ। তাদের প্রায় ৭ শতাংশ এখন মৃত, প্রায় ১৫ শতাংশ আহত।

অনেক মৃতদেহ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে। কেউ কেউ অপুষ্টি, অনিরাময়যোগ্য রোগ বা আত্মহত্যায় মারা গেছেন। হাজারো মানুষ নিখোঁজ—কে কোথায় হারিয়ে গেছে, কেউ জানে না। অনেকে বিস্ফোরণে উড়ে গেছে, কেউ গোপন বন্দিশিবিরে আটক।

অবরোধ, দুর্ভিক্ষ ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ: পুরো সংঘাতকালেই গাজায় খাদ্য ও ওষুধের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে ইসরায়েল। ২০২৫ সালের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত সম্পূর্ণ অবরোধ জারি করা হয়। ইসরায়েলের যুক্তি হলো, হামাস সাহায্য সামগ্রী লুট করে সামরিক কাজে ব্যবহার করছে। আন্তর্জাতিক চাপের পর কিছুটা শিথিলতা আসে, কিন্তু আগস্টে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা গাজার কিছু অংশে আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করেন।

জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের স্বাধীন বিশেষজ্ঞরা সেপ্টেম্বরে বলেন, গাজার মৃত্যুহার ও ধ্বংসের মাত্রা গণহত্যার শর্ত পূরণ করে; কিন্তু ইসরায়েল তা অস্বীকার করে আসছে।

নরকের মতো বাস্তবতা: ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলা চালায়। তাতে মৃত্যু হয় প্রায় ১ হাজার ২০০ জনের। হামাস বন্দি করে আরও ২৫১ ইসরায়েলিকে। এর পরই শুরু হয় ইসরায়েলের ব্যাপক সামরিক অভিযান। গাজার প্রায় সব ফিলিস্তিনি বারবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সব শহর ধুলায় পরিণত হয়েছে। একজন চিকিৎসক বলেন, ‘যা দেখছি, তা যেন নরকের বাস্তব রূপ।’

মৃত্যু ও আহতের হিসাব: যুদ্ধে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ৬৭ হাজার ৭৪ জন। আহত হয়েছেন অন্তত এক লাখ ৬৮ হাজার ৭১৬ জন। নিহতদের প্রায় ২০ হাজার শিশু—অর্থাৎ গাজার শিশুসংখ্যার প্রায় দুই শতাংশ।

দ্য ল্যানসেট সাময়িকীর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রথম বছরেই গাজার গড় আয়ু অর্ধেকে নেমে গেছে।

ইসরায়েলি কর্মকর্তারা আগে এসব পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু ইসরায়েলি সেনাপ্রধান হারজি হালেভি পরে নিজেই স্বীকার করেন, ‘গাজায় নিহত ও আহতের সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়েছে, যার ৮০ শতাংশই বেসামরিক। আমরা শুরু থেকেই গ্লাভস খুলে ফেলেছিলাম।’

ঘরবাড়ি ও বাস্তুচ্যুতি: ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ঘরবাড়ি। অর্থাৎ ৯২ শতাংশ। বাস্তুচ্যুত হয়েছে ২১ লাখ মানুষ, যা মোট জনসংখ্যার ৯৫ শতাংশ। ইসরায়েলের বোমাবর্ষণে প্রায় ৬ কোটি টন ধ্বংসাবশেষ জমেছে। সেখানে রয়েছে বিষাক্ত ধাতু ও অ্যাসবেস্টসের মতো উপাদান। অধিক ঘনবসতি হওয়ায় এই বিষে প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষভাবে আক্রান্ত হচ্ছে গাজাবাসী।

ইউনিসেফের জেমস এল্ডার বলেন, ‘অনেকে জীবনের সবকিছু হারিয়েছে। এই বাস্তুচ্যুতি ভয়াবহ মানসিক ক্ষত রেখে যাচ্ছে।’

দক্ষিণ গাজার আল-মাওয়াসিতে এখন লাখো মানুষ ত্রিপল ও তাঁবুর শহরে বাস করছে—পানির সংকটে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। অনেকে দিনে এক বেলা খাবারও পায় না।

শিক্ষা ধ্বংসের মুখে: ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত ৫১৮টি স্কুল, যা মোট সংখ্যার ৯০ শতাংশ। শিক্ষাবিচ্ছিন্ন রয়েছে ৭ লাখ ৪৫ হাজার শিক্ষার্থী।

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় দুই শিক্ষাবর্ষ ধরে গাজার শিশুরা স্কুলে ফিরতে পারেনি। অনেক স্কুল আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, তবু সেগুলোও বোমার লক্ষ্য হয়েছে।

হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা: ৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে শুধু ১৪টি আংশিকভাবে চালু আছে। শিফা ও আহলি হাসপাতালে ধারণক্ষমতার চেয়ে তিন গুণের বেশি রোগী রয়েছেন। ওষুধের অভাব, যন্ত্রপাতির অচলাবস্থা ও অবিরাম হামলার কারণে চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, অক্টোবর ২০২৩ থেকে জুন ২০২৫ পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় স্বাস্থ্য খাতে ৭৩৫টি আক্রমণ হয়েছে, যেখানে নিহত হয়েছেন ৯১৭ জন।

ক্ষুধা, অভাব ও মৃত্যুর মিছিল: পুষ্টিহীনতায় মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৪০০ জনের। এর মধ্যে শিশু ১০১ জন। জাতিসংঘের তথ্যমতে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে হাজারো শিশু এখন অপুষ্টির ঝুঁকিতে। অনেক গর্ভবতী মা দিনে একবারের বেশি খাবার পাচ্ছেন না।

ইসরায়েলের অবরোধ কৃষিজ উৎপাদন ধ্বংস করে দিয়েছে। বাজারে যেসব খাবার পাওয়া যায়, তার দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।

ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ: গাজায় এখন মাত্র দেড় শতাংশ জমি চাষযোগ্য আছে। ২০২৩ সালের পর থেকে এলাকার ৯৭ শতাংশ গাছপালা, ৯৫ শতাংশ ঝোপঝাড় এবং ৮২ শতাংশ বার্ষিক ফসল ধ্বংস হয়েছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘যদি এভাবে চলতে থাকে, গাজায় এমন এক পরিবেশগত বিপর্যয় তৈরি হবে, যা প্রজন্মের পর প্রজন্মের স্বাস্থ্যে ও জীবনে প্রভাব ফেলবে।’

গাজার আকাশে এখনো বারুদ, রাস্তায় ভাঙা ইট-পাথর, ধুলো, আর মানুষের মুখে চিরক্লান্তির ছাপ। এই যুদ্ধ শুধু গাজাকে নয়, মানবতার বিবেককেও গভীরভাবে ক্ষতবিক্ষত করেছে।