বাংলাদেশ সরকারের ‘চিরদিন মনে রাখার মতো’ উজাড় করে দেয়া বন্ধুত্বের বিনিময়ে ভারত মেগা অর্জন হাতের মুঠোয় ভরে পেলো ট্রানজিট ও করিডোর। চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা পেয়ে খুশিতে ভাসছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং দেশটির কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের মন্ত্রী-নেতারা। বাংলাদেশ এই প্রথমবারের মতো ভারতীয়দের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে বলে জানান ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। এর ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অর্থনীতি বদলে যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। গত ৩০ জানুয়ারি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট মুম্বাই (আইআইএম) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রেল ও বাস যোগাযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম দেশটির ভেতর দিয়ে ভারতীয়দের যাওয়া ও বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। এর একটি বড় প্রভাবপড়বে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। কেননা এটা (বাংলাদেশের অনুমতি) না হলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষকে শিলিগুড়ি দিয়ে এসে তারপর ভারতের পূর্বাঞ্চলের বন্দরগুলোতে যেতে হতো। তারা এখন চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করতে পারবে’।
দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে জাতীয় সম্মিলিত ফোরাম জেএসএফ বাংলাদেশ , বর্তমান সরকার ভারতের চাহিদা অনুযায়ী তিতাস নদী বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশের বুকের উপর দিয়ে ভারী যানবাহন আগরলতায় পাঠানো ব্যবস্থা করে। দেশের শিল্প-বাণিজ্য-অর্থনীতির আয়তন ও পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে। নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে আমদানি ও রফতানি পণ্যসামগ্রীর চাপ সামাল দিতে গিয়ে এমনিতেই চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের অনেক সময় হিমশিম অবস্থায় পড়তে হয়। অবকাঠামো সুবিধাও সীমিত। তাছাড়া বাংলাদেশের নরম মাটি ভূ-প্রকৃতিতে গড়া রাস্তাঘাট ভারী ট্রাকলরি চলাচলের অত্যধিক চাপ বহনে অক্ষম। দেশ বিরোধী এসব কর্মকান্ড মুক্তিযোদ্ধের চেতনার দোহাই দিয়ে দমন নিপীড়ন করে বেপরোয়া চালিয়ে যাচ্ছে।
নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে আমদানি ও রফতানি পণ্যসামগ্রীর চাপ সামাল দিতে গিয়ে এমনিতেই চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের অনেক সময় হিমশিম অবস্থায় পড়তে হয়। অবকাঠামো সুবিধাও সীমিত। তাছাড়া বাংলাদেশের নরম মাটি ভূ-প্রকৃতিতে গড়া রাস্তাঘাট ভারী ট্রাকলরি চলাচলের অত্যধিক চাপ বহনে অক্ষম। বন্ধুত্ব হতে হবে পারস্পরিক চাওয়া-পাওয়া, দেয়া-নেয়ায় সমতার ভিত্তিতে। বন্ধুত্ব মানে মিলবো আর মিলাবো। কিন্তু আমি নিজে খেতে পারলে এরপর অবশিষ্ট কিছু থাকলে বন্ধুকে দেব। কিন্তু নিজে না খেয়ে বন্ধুকে দিতে পারি কীভাবে? প্রতিবেশী দুই দেশের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মিলাতে হবে।
‘চিকেন নেক’ খোলেনি ভারত কেন সেটার জবাব দাবি করে জাতীয় সম্মিলিত ফোরাম বলেছে , শুধুই ভারতমুখী একতরফা ট্রানজিট-করিডোরের কারণে বঞ্চনা-বৈষম্যের মধ্যে পড়ে গেছে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান- এই তিন নিকট প্রতিবেশী দেশ। বাংলাদেশ আখাউড়া-আগরতলায় সংযোগ তথা করিডোর রুট সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু বাংলাবান্ধা হয়ে ফুলবাড়ী-শিলিগুড়ি চারটি আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যিক যোগাযোগের সেই ‘চিকেন নেক’ করিডোর আজও খোলেনি ভারত। এতে করে মাঝখানে ভারতের সীমানার মধ্যে থাকা স্বল্প দূরত্ব পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের পারস্পরিক বাণিজ্য, পণ্যসামগ্রী আমদানি-রফতানিতে প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ বাধা-বিপত্তি রয়েই গেছে।
জাতীয় সম্মিলিত ফোরাম (জেএসএফ বাংলাদেশ) বিবৃতিতে বলেছে , দুই দেশের মধ্যে স্বল্প দূরত্বের ভৌগোলিক অবস্থানগত ‘চিকেন নেক’ রেলপথে সংযুক্তির জন্য উদারভাবে ছেড়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। কার্যত সুবিধা হলো ভারতের। দীর্ঘ ঘুরপথে আগরতলা-কলকাতার দূরত্ব ১৬শ’ ৫০ কিলোমিটার। আখাউড়া-আগরতলা নয়া রেলপথে সেই দূরত্ব এখন মাত্র ৫৫০ কি.মি.। দূরত্ব কমলো ১১শ’ কি.মি.। সময় বাঁচবে ২৬ ঘণ্টা। চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর এবং ঢাকার কমলাপুর আইসিডি থেকে কন্টেইনারসহ ট্রানজিট পণ্য সরাসরি পরিবহন হবে। কলকাতা থেকে রাজধানী ঢাকা হয়ে সরাসরি আখাউড়া-আগরতলা রেলপথে ভারতীয়দের এখন সময় যাবে ৩৬ ঘণ্টার পরিবর্তে মাত্র ১০ ঘণ্টা।
নেপাল, ভুটানের অনেক ধরনের ভোগ্যপণ্য প্রতিযোগিতামূলক কম দামে বাংলাদেশে আমদানি করা যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে ভারত থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। বাণিজ্যিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছে তিনটি দেশ বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটান।
অথচ বাংলাবান্ধা থেকে ‘চিকেন নেক’ সেই ফুলবাড়ী-শিলিগুড়ি করিডোরের দূরত্ব মাত্র ২২ কিলোমিটার। প্রস্থ ২১ থেকে স্থানভেদে ৪০ কি.মি.। বাংলাদেশে উৎপাদিত উৎকৃষ্টমানের নিত্য ব্যবহার্য ও ভোগ্যপণ্য, শিল্প কাঁচামাল, শিল্পে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী, আইটি পণ্য, সেবাখাত, খাদ্যপণ্য ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য, সৌখিন পণ্য, আসবাবপত্র, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স পণ্য, ওষুধ ও পেটেন্ট, বস্ত্র-সম্ভার ইত্যাদি মিলিয়ে বাংলাদেশের শতাধিক ধরনের পণ্যের চাহিদা এবং বাজার সম্ভাবনাময় প্রতিবেশী অপর দুই দেশ নেপাল ও ভুটান। উত্তর-পূর্ব ভারতেও সেই বিপুল বাজার সম্ভাবনার পথ আটকে আছে ভারতের শুল্ক-অশুল্ক নানাবিধ বাধা-বিপত্তির কারণে।
ভারতের ট্রানজিট পণ্যসামগ্রীর বাড়তি বোঝা বহন করতে গিয়ে চিড়েচ্যাপটা হবে বন্দর। বেসামাল আকার ধারণ করবে বন্দরের পরিবহণ কার্যক্রম। স্থবির শ্লথ হয়ে পড়বে বন্দরের অপারেশনাল কর্মকাণ্ডের স্বাভাবিক গতি। যার খেসারত দিতে হবে দেশের রুগ্ন, দুর্বল ও ভগ্ন হয়ে পড়া সামগ্রিক অর্থনীতিকে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, আমদানি-রফতানিতে ব্যয় বৃদ্ধি, ব্যবসায় পরিচালনায় খরচ বেড়ে গিয়ে বাড়তি ব্যয়ের বোঝা টানতে হবে দেশ-জাতিকে। তার উপর ট্রানজিট-করিডোরের ফি-চার্জ-মাশুল ধার্য্য করা হয়েছে বলতে গেলে মুফ্ত কিংবা নামেমাত্র। তাও ডলারের বদলে টাকার অংকে। ডলারের অব্যাহত সঙ্কট ও টাকার মান অবচয়নের সুফল ভোগ করবে ভারত।