• ৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ২০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ২রা রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

নেলি গণহত্যা ও বর্তমান ভারত , বৃহৎ গণতান্ত্রিক নামের বাতির নিচে লুকায়িত অন্ধকার

usbnews
প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২৪
নেলি গণহত্যা ও বর্তমান ভারত , বৃহৎ গণতান্ত্রিক নামের বাতির নিচে লুকায়িত অন্ধকার
নিউজটি শেয়ার করুনঃ

১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি দুই ট্রাকভর্তি পুলিশ কন্টিনজেন্ট  আসে এবং সেখানকার অধিবাসীদের আশ্বস্ত করে যে, তারা আশেপাশে পাহারা দিচ্ছে এবং তাদেরকে পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে। নিরাপত্তাকর্মীর আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে নেলি ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাসিন্দারা পরের দিন, ১৮ ফেব্রুয়ারি যথারীতি কাজে যান। সকাল আনুমানিক সাড়ে ৮টার দিকে, হঠাৎ তিনদিক থেকে সশস্ত্র আততায়ীরা গ্রামগুলিকে ঘিরে ফেলে। গ্রামবাসীরা কপিলি নদীর দিকে পালাতে বাধ্য হয়। কিন্তু নদীতেও পরিকল্পিতভাবে নৌকা নিয়ে আক্রমণকারীরা অপেক্ষা করছিল। প্রায় ছয় ঘণ্টা ধরে ছুরি, কাটারি, কুঠার, শাবল, বর্শা, গোদা বন্দুক দিয়ে হত্যালীলা চালানো হয়। এছাড়া সমস্ত বাড়িঘর ও ধানের গোলায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। যারা প্রাণে বেঁচে গিয়ে শরণার্থী শিবিরে জায়গা পেয়েছিলেন তারা অবস্থা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসার পর অর্থাৎ ঘটনার ১৬ দিন পর স্বগৃহে ফিরে এসে দেখেন যে সেই ধানের গোলার আগুন তখনও জ্বলছে। তাদের অভিযোগ যে হামলার দু’দিন আগে কানাঘুষো খবর পেয়ে তারা নেলি থানায় গিয়ে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার আবেদন করেছিলেন কিন্তু পুলিশ কোন পদক্ষেপ নেয় নি।

নেলি হত্যাকাণ্ড বা নেলি হত্যাযজ্ঞ বা নেলি গণহত্যা ভারতের অসমে ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি ছয়-ঘণ্টাব্যাপী সংঘটিত এক হত্যাযজ্ঞ। এই গণহত্যা কেড়ে নেয় নগাঁও জেলার ১৪টি গ্রামের— আলিসিংহ, খুলাপাথর, বসুন্ধরি, বুগ্দুবা বিল, বুগ্দুবা হাবি, বর্জলা, বুতুনি, ইন্দুরমারি, মাটি পর্বত, মুলাধারী, মাটি পর্বত নং ৮, সিলভেতা, বর্বুরি এবং নেলির নিরীহ মানুষদের । আক্রান্তদের অধিকাংশ ছিলেন বাংলাভাষী, যারা ঐ অঞ্চলে বেআইনিভাবে প্রবেশ করেছিলেন এমন অভিযোগ ছিল। ঐ অঞ্চল পরিভ্রমণকারী একদল গণমাধ্যম কর্মী এই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন। পরবর্তীকালে শুভশ্রী কৃষ্ণান পিএসবিটি ইন্ডিয়া দ্বারা প্রযোজিত একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন। সেখানে এই ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞে যারা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন তারা দেখিয়েছেন যে তাদের কাছে নাগরিকত্ব প্রমাণের নথি ছিল।এই হত্যাযজ্ঞ ছিল ১৯৮৩ সালের অসম আন্দোলনের (Assam Agitation) মধ্যবর্তি কুখ্যাত নির্বাচন চলাকালীন অনেকগুলো লোমহর্ষক ঘটনার মধ্যে অন্যতম।

 

বিবিসি বাংলার সাংবাদিক অমিতাভ ভট্টশালীকে জোহরা খাতুন জানানঃ

“ বড় হয়ে শুনেছি বাবা-র কাছে যে ছয়মাসের আমাকে কোলে নিয়ে পালাতে গিয়ে মা গুলি খেয়ে মাঠে পড়ে গিয়েছিল। আমি নাকি পাঁচ-ছয় দিন মরা মায়ের গায়ের ওপরেই পড়ে ছিলাম। পরে পুলিশ আমাকে নিয়ে গিয়ে বাবাকে খুঁজে বার করে।”

বিবিসি বাংলার সাংবাদিক অমিতাভ ভট্টশালীকে মুহাম্মদ আব্দুল হক জানানঃ

“কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা রক্ষীরা গন্ডগোল আঁচ করতে পেরেছিল, গুলির শব্দও হয়তো শুনেছিল। কিন্তু স্থানীয় থানার অফিসারেরা বাহিনীকে গ্রামে নিয়ে না এসে অন্যান্য দিকে টহল দেওয়াচ্ছিল।“

হত্যাযজ্ঞে যারা প্রাণে বেঁচে গেছিলেন তারা দেখিয়েছেন যে তাদের কাছে নাগরিকত্ব প্রমাণের নথি ছিল। মৃত ব্যক্তিদের গণকবর দেওয়া হয়। তদন্তের পর প্রশাসন মৃতদের পরিবার পরিজনকে মাত্র ৫০০০ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়। পক্ষান্তরে পরের বছর দিল্লীর ১৯৮৪ শিখবিরোধী দাঙ্গার নিহতদের পরিবারকে ৭ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়।

এই গনহত্যার তদন্তে পুলিশ ৬৮৮ টি ফৌজদারি মামলা দায়ের করে। যার মধ্যে অধিকাংশই তথ্যপ্রমাণের অভাবে পুলিশ চার্জশিট গঠন করতে পারে নি। অসম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর অসম গণ পরিষদ পরবর্তী নির্বাচনে জিতে ক্ষমতা দখল করে এবং সবকটি মামলা বন্ধ করে দেয়।

নেলি গণহত্যা কাণ্ডের সময় জ্বলে যাওয়া একটি বাড়ি যা ১৯৮৮ সালেও মেরামত করা হয়নি

ছবি সত্ত্ব: দ্যা স্টেটসম্যান/পদ্ম পাতার

এই গণহত্যার ব্যাপারে সব থেকে বিস্ময়কর বিষয় ছিল এই গণহত্যায় সাহায্য করেছিল আসামের পুলিশ এবং তৎকালীন ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেস সরকার। তখন কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিলেন রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার। এই গণহত্যার পরবর্তী বছরে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে আবার কংগ্রেস সরকার মেতে ওঠে রক্তের হোলি খেলায়। তখন জায়গাটা ছিল অমৃতসর। আক্রমণের কেন্দ্রে ছিল শিখ সম্প্রদায়। তবে এই আক্রমণের ব্যাপারে পরবর্তী সমস্ত কেন্দ্র সরকার ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল। মৃতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ৭ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয় সরকার। নিরপেক্ষ তদন্ত করা হয় ভারতীয় সেনা পরিচালিত ওই মূল অভিযানের ও। কিন্তু নেলী হত্যাকান্ডের ব্যাপারে কোনো সরকার ক্ষমা প্রার্থনা তো দূরের কথা দুঃখ প্রকাশ পর্যন্ত করেননি যেমন করেননি গুজরাট দাঙ্গার ব্যাপারে।

নেলীতে কিছু  হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসের বলি পরিবারগুলোকে পরবর্তীতে আসাম সরকার মাত্র ৫ হাজার করে টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেও বেশীরভাগ পরিবার সেই অর্থ সাহায্য পাননি। হত্যাকান্ডের ব্যাপারে তদন্তের জন্য গঠন করা হয় ত্রিভুবন তিওয়ারির নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটি। কিন্তু সেই সময় ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে থাকায় হত্যাকান্ডের হোতা সন্ত্রাসী সংগঠন আসাম গণ পরিষদের আপত্তির কারণে ওই তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেনি আসামের কোনো সরকার। দোহাই দেওয়া হয় রিপোর্টটি অত্যন্ত স্পর্শ কাতর বিষয়ে পরিপূর্ণ তাই প্রকাশ করলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বিনষ্ট হতে পারে। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি, ওই রিপোর্টে সত্যি প্রকাশ পেলে হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদের প্রকৃত চেহারা উন্মুক্ত হয়ে যাবে বলেই আসাম গণ পরিষদ এটা প্রকাশ করতে চায়নি। আর কংগ্রেস নির্লজ্জ ক্ষমতার লোভে এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের জন্য কাউকে শাস্তি না দিয়ে রিপোর্টটি গোপন করে দেয়।

ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার অপরাধে ৬৮৮ টি ফৌজদারি মামলা দায়ের করেছিল পুলিশ কিন্ত কংগ্রেস সরকার এবং আসাম গণ পরিষদের যৌথ ষড়যন্ত্রের কারণে পুলিশ ঘটনাটির সমস্ত তথ্য প্রমাণ গোপন করে দেয় ফলে দোষীদের কাউকেই সাজা পেতে হয়নি। সেই সময় অভিযোগ করা হয়েছিল আসামের নওগাঁ জেলার আলিসিংহ, খুলাপাথর, বসুন্ধরি, বুগ্দুবা বিল, বুগ্দুবা হাবি, বর্জলা, বুতুনি, ইন্দুরমারি, মাটি পর্বত, মুলাধারী, মাটি পর্বত নং ৮, সিলভেতা, বর্বুরি এবং নেলি এই ১৪ টি গ্রামে বসবাসকারী বাঙালি মুসলিমদের কেউই বৈধ ভারতীয় নাগরিক ছিলেন না, তাদের কারোরই নাগরিকত্বের প্রমাণ নেই। কিন্তু পরবর্তীতে শুভশ্রী কৃষ্ণান পিএসবিটি ইন্ডিয়া দ্বারা প্রযোজিত একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন। সেখানে এই ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞে যারা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন তারা দেখিয়েছেন যে তাদের কাছে নাগরিকত্ব প্রমাণের নথি ছিল

নেলির সেই বদ্ধভূমি

 

নেলি গণহত্যা যেহেতু ১৯৮৪ সালের শিখ গণহত্যা, ১৯৯২ ও ২০০২ এর মুসলিম গণহত্যার আগে হয়েছিল তাই যেমন হিংস্রতার ক্ষেত্রে তেমনি রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার ক্ষেত্রেও এই ঘটনা একটি পথপ্রদর্শক ভূমিকা পালন করেছিল, যা ভবিষ্যতের গণহত্যায় অংশ নেওয়া হত্যাকারীদের বলিষ্ঠ হওয়ার মানসিক শক্তি জুটিয়েছিল। রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট হয়ে যদি কোনো শক্তি গণহত্যায় অংশ নেয় তাহলে তারা যে আইনের ভয় ছাড়াই বুক ফুলিয়ে দিনের আলোয় অপরাধ করতে পারে সেই প্রমাণ ভারতে নেলি গণহত্যা কাণ্ড প্রথম দেখায়।

সরকারি হিসাবে অসমের নেলি গণহত্যায় নগাওঁ জেলার জাগ্গি রোড থানার অন্তর্গত নেলির ১৪টি গ্রামের —আলীসিংহ, খুলাপাথর, বসুন্ধরী, বুগডুবা বিল, বাগডুবা হাবি, বড়জোলা, বুটুনি, ডোঙ্গাবাড়ি, ইঁদুর মারি, মাটি পর্বত, মূলাধারী, মাটি পর্বত আট নম্বর, সিলভেটা, বড়বুড়ি আর নেলি—অসংখ্য বাংলাভাষী বসবাসকারীকে হত্যা করা হয় ১৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩তে। যদিও সরকারি হিসাবে সংখ্যাটা ২,১৯১, কিন্তু বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যাটা প্রায় ১০,০০০, যা ১৯৮৪ সালের শিখ গণহত্যা আর ২০০২ সালের গুজরাটের মুসলিম গণহত্যার চেয়ে বহু বেশি। অথচ, আজ পর্যন্ত এই গণহত্যার ঘটনায় জড়িতরা কেউ শাস্তি তো পায়নি, বরং অসমের বাঙালি-বিদ্বেষী মূলস্রোতের রাজনীতিতে তাদের চরম উন্নতি হয়েছে।

১৯৭৯ এর প্রথম দিকে অসমের মঙ্গলদৈ লোকসভা সমষ্টির সাংসদ হীরালাল পাটোয়ারির আকস্মিক মৃত্যু হয়। সেই শূন্য সংসদ আসন পূরণ করার জন্য সে বছরের শেষের দিকে সেই আসনে উপনির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয় ভারতের নির্বাচন কমিশন। সংসদে তখন ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ী ১৯৭৯ এর আগেই অসম সহ সমগ্র উত্তর-পূর্বে বাংলাদেশীদের অবাধ অনুপ্রবেশ হচ্ছে বলে বক্তব্য রেখেছিলেন। সেই বক্তব্য অসমের একাংশ সচেতন ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা এবং ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বকে আন্দোলনমুখী করে তোলে। এই অসম আন্দোলন নামে পরিচিত এবং এই আন্দোলনেরই বর্বরতম হত্যাকাণ্ড নেলি গণহত্যা।

 

As Makiko Kimura’s seminal study of the massacre, The Nellie Massacre of 1983: Agency of Rioters,

নেলিতে আধা সেনা মোতায়েন থাকলেও তারা কীভাবে হাত গুটিয়ে ছিল তার নিঁখুত বর্ণনা আছে ঘটনার সময় এলাকায় থাকা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের অসমের সংবাদদাতা হেমেন্দ্র নারায়ণের লেখায়। ঘটনার ২৫ বছর পর প্রকাশিত হয় তাঁর বই ‘টুয়েন্টি ফাইভ ইয়ার্স অন….নেলি স্টিল হন্টস’। মর্মান্তিক বর্ণনা আছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রাক্তন সম্পাদক শেখর গুপ্তর বই ‘অসম—এ ভ্যালি ডিভাইডেড’-বইয়ে।

 

নেলি গণহত্যার পাঁচ বছর পরের দ্যা স্টেটসম্যান এর রিপোর্ট
এককালে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের হেমেন্দ্র নারায়ণ ও অসম ট্রিবিউন পত্রিকার বেদব্রত লহকার এই গণহত্যা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি করেছিলেন, নানা তথ্যচিত্রও তৈরি হয়েছিল এই বিষয়ে। কিন্তু যা অধরা থাকল তা হল এই গণহত্যার ঘটনায় নিপীড়িত মানুষ ৪০ বছরেও ন্যায়ের মুখ দেখলেন না, বরং যে শক্তির প্ররোচনায় এককালে বাঙালি-বিরোধী অসম আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেই শক্তি আজ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও বাঙালি জাতির মধ্যে ধর্মীয় মেরুকরণ করে অসম ও ভারতের কেন্দ্রে আজ ক্ষমতায় আসীন।

কলকাতার দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার অসম প্রতিবেদক হয়ে তৎকালীন সময়ে সাংবাদিক অরূপ চন্দ ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নেলিতে যান ও সেখানে এই গণহত্যার ঘটনায় যে সব প্রত্যক্ষদর্শী তখনও বেঁচে ছিলেন তাঁদের সাথে কথা বলেন। তাঁর গ্রাউন্ড রিপোর্টটি ১২ই মার্চ ১৯৮৮-র স্যাটারডে স্টেটসম্যানে প্রকাশিত হয়।

সেই প্রতিবেদনে প্রত্যক্ষদর্শীরা যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বয়ান করেছেন তৎকালীন ভারতে তা অভূতপূর্ব ও নৃশংস শোনালেও ১৯৮৪ সালের শিখ গণহত্যা, ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও তার পরে সারা দেশে মুসলিম নিধন যজ্ঞ, ২০০২ সালের গুজরাট মুসলিম গণহত্যা, ২০০৮ সালের উড়িষ্যার খ্রিস্টান গণহত্যা, ২০১৩ সালের মুজ্জাফরনগর গণহত্যা বা ২০২০ সালের দিল্লীর মুসলিম গণহত্যার পরে অনেক গা-সওয়া ব্যাপার হয়ে গেছে।

অসমের সাথে খুবই ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে পরার পরে চন্দ নেলি নিয়ে যে তদন্ত করেন সেই নিয়ে তিনি নানা কথোপকথনে পিপলস রিভিউ কে তাঁর অভিজ্ঞতা জানান। এই প্রবন্ধে আমরা চন্দের ১৯৮৮ সালের রিপোর্টটির ভিত্তিতেই সেই গণহত্যার ঘটনাটি কে ফিরে দেখার চেষ্টা করবো।

 

বড়পেটাতে ৫ জন শহিদ হয়ে (২১ জুলাই ২০১০) সমগ্র বাঙালির নাগরিকপঞ্জিতে নামভুক্তির আবেদনে সুরাহা করে দিলেও বাঙালি একযোগে এঁদের শহিদত্ব মানতে অরাজি। এমতাবস্তায় ২৮.২ শতাংশ বাঙালির ভাষাকে ডিঙিয়ে ৪.৫৪ শতাংশ লোকের ভাষাকে রাজ্যে দ্বিতীয় সহযোগী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি (১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১) দিলে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি নীরবতা পালন করে।

১৮৭৪ সালে গভর্নর জেনারের প্রতিনিধি, চেরাপুঞ্জিস্থিত গভর্নর জেনারেলের উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রতিনিধি-শাসিত ৫টি জেলা নিয়ে আদি অসম যখন চিফ কমিশনার-শাসিত রাজ্যের মর্যাদা লাভ করল তখনই অসম তার exclusive identity-র সঙ্গে সমঝোতা করল— সে হল ব্রিটিশ-ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীভূত, ভারতীয় উপমহাদেশের দরজা খুলে অসমে নবযুগের সূচনা হল, ভারতবর্ষের মূলভূমির কৃষিজীবী, শ্রমজীবী, মৎস্যজীবী, পেশাজীবী এবং অতঃপর শিক্ষিত চাকুরিজীবীর আত্মপ্রকাশ ঘটল অসমে। বৃহত্তর ভারতভূমির সন্তানদের আগমনে অসম মধ্যযুগের খোলস ছেড়ে আধুনিকতার দিকে এগিয়ে গেল, শিল্পপ্রযুক্তির বিকাশ হল, স্কুলকলেজ, আইন-আদালত, ছাপাখানার আত্মপ্রকাশ ঘটল। এমতাবস্থায় নিজেদের একমাত্র ভূমিপুত্র বা খিলঞ্জিয়া ঘোষণা করে অন্যদের বহিরাগত হিসেবে দেগে দেওয়া কতটা ইতিহাসসম্মত, কতটা সংবিধানসম্মত, কতটা মানবিক— এ চিন্তা বরাকের নয় ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার। বরাকের ইতিহাস ভিন্ন, এবং এ ইতিহাসের সুস্পষ্ট অবয়ব বরাকবাসীর অজানাও নয়। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিরা নিজেদের অবস্থান সম্বন্ধে সচেতনতার প্রমাণ দিতে পারেননি— তাই এরা ‘অসমিয়া-বাঙালি’ বা ‘বাংলাভাষী অসমিয়া’ ইত্যাদি অবাস্তব পরিচিতির আশ্রয় খোঁজেন, জাতীয়তাবাদী শিবিরে ঢুকে স্বভাষীয় অপর জনগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ ভাব পোষণ করেন, এবং এমনি করে নিজেদের এক মেরুদণ্ডহীন জাতি হিসেবে পরিণত করছেন।

নেলি অসমের তখনকার নগাঁও জেলার (বর্তমানে মরিগাঁও) একটি জনপদ। শনিবার ছিল স্বাধীন ভারতে সেই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের (Neli Murder) চার দশক পূর্তি। ১৯৮৩-র ১৮ ফেব্রুয়ারির সকালে শুরু হয়েছিল হত্যাকাণ্ড। জায়গাটি তিনটি নদী ঘেরা বদ্ধভূমি। ফলে পালিয়েও পালানোর উপায় ছিল না। রেহাই পাননি নদীতে ঝাঁপ দেওয়া মানুষও।

 

চন্দের রিপোর্টে বলা হয়েছে যে কোনো ক্রমে ১৪টি গ্রামের বাসিন্দারা পালিয়ে কপিলী আর কিলিং নদীর সঙ্গমস্থল বসুন্ধরী বিলে পৌঁছান। কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হয়। তাঁদের চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরে গুলি করে মারতে থাকে দাঙ্গাকারীরা। এর মধ্যে অনেকে প্রাণ বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ দিলেও অন্যদিকে উঠতেই তাদের বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে বা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয়। যাঁরা কোনো ভাবে জঙ্গলে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন, তাঁরা কোনো ভাবে তখন বেঁচে গেলেও, হিংসার ফলে পাওয়া আঘাতের কারণে তাঁদের জঙ্গলেই মৃত্যু হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা চন্দ কে জানিয়েছিলেন যে ১৮ই ফেব্রুয়ারি ভোর বেলার থেকে ১৪টি গ্রামে একযোগে আক্রমণ শুরু করে খুনে বাহিনী। তাদের মধ্যে সর্বাধিক ছিল ছোট নাগপুর থেকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের দ্বারা অসমে আনা আদিবাসীরা। ভোর বেলায় আগ্নেয়াস্ত্র, বল্লম, তীর ধনুক ও মশাল নিয়ে এই দাঙ্গাকারীরা আক্রমণ চালায় গ্রামে গ্রামে।

মধ্যাহ্নে ছয় ট্রাক ভর্তি পুলিশ বাহিনী বসুন্ধরী বিলে হাজির হলে আক্রান্ত গ্রামবাসীরা মনে ভরসা পেলেও সেই ভরসা ক্ষণস্থায়ী হয়। কারণ হত্যাকারীদের আক্রমণ না করে পুলিশ গ্রামবাসীদের তাক করে গুলি চালানো শুরু করে। মাটি পর্বতের আব্দুল সাত্তার চন্দ কে জানান, “আশ্চর্যজনক ভাবে আমাদের উপর আক্রমণকারীদের গুলি না করে তারা (পুলিশ) আমাদের তাক করে গুলি চালানো শুরু করে। কোনো অজ্ঞাত কারণে পুলিশগুলো আমাদের দিকে নির্দয় হয়ে গুলি চালাতে থাকলো।” বাবুলালের থেকে আগাম খবর পেয়ে সাত্তারও তাঁর পরিবার কে বাঁচাতে সক্ষম হন।

সূর্য অস্ত যাওয়ার কিছু আগে সিআরপিএফ আসে। এই সিআরপিএফ বাহিনী কে দেখে দাঙ্গাকারীরা পালিয়ে যায়। তবে সিআরপিএফ তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে আর তাতে বেশ কিছু দাঙ্গাকারীরা মৃত্যু হয়। কিন্তু যতক্ষণে সিআরপিএফ এসে গ্রামবাসীদের বাঁচায় ও জাতীয় সড়কে নিয়ে যায় ততক্ষণে বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে নেলির। হাজার হাজার মানুষ মারা গেছেন, অসংখ্য পরিবার শেষ হয়ে গেছে। তবে মৃত্যু মিছিল এখানেই শেষ হয় না। এর পরে বহু মাস আক্রান্তদের ত্রাণ শিবিরে থাকতে হয় খুবই শোচনীয় অবস্থায়।

 

তিন দিনের মাথায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নেলিতে যাওয়ার আগে প্রশাসন সমস্ত মৃতদেহ সরিয়ে দিয়েছিল। অভিযোগ ওঠে, শত শত নিথর দেহ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।

রাষ্ট্রপতি শাসনে থাকা অসমে তখন বিধানসভার ভোট চলছিল। বিদেশি খেদাও আন্দোলন তার পাঁচ বছর আগে থেকে শুরু হয়ে গিয়েছে। পরিস্থিতি ভোটের অনুকূল নয় জেনেও ইন্দিরা গান্ধী নির্বাচন চাপিয়ে দেন। নেলির বাঙালি মুসলিমদের অপরাধ তারা স্থানীয় ছাত্র সংগঠনের ডাকে সাড়া না দিয়ে ভোট দিয়েছিল।

তৎকালীন বিজেপি সভাপতি অটল বিহারী বাজপেয়ী, আজ যে প্রয়াত নেতার প্রধান পরিচয় ভারতরত্ন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে, অসমের সেই নির্বাচনে প্রচারে গিয়ে বিদেশি ইস্যুতে কী বলেছিলেন তিনি?

১৯৯৬-এ সংসদে বাজপেয়ি সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা অনাস্থা প্রস্তাবের উপর বিতর্কে সিপিআই সাংসদ প্রয়াত ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত দাবি করেন, প্রধানমন্ত্রী সেদিন বলেছিলেন, ‘বিদেশিরা এখানে ঢুকে পড়েছে এবং সরকার কিছুই করছে না। তারা যদি পাঞ্জাবে আসতো তাহলে কী হতো? মানুষ তাদের টুকরো টুকরো করে ফেলত।’

বাজপেয়ীর সেই বক্তব্যের সঙ্গে নেলির হত্যাকাণ্ডের আশ্চর্য মিল আছে। অনেকেই অভিযোগ করেন, ওই মন্তব্যই হত্যাকারীদের উস্কানি দিয়েছিল। যদিও সরকারের তরফে এমন অভিযোগ করা হয়নি।

১৯৮৪ সালের জুন মাসে শ্রীমতি গান্ধীর সরকার ভারতীয় সেনা বাহিনী কে অমৃতসরে অবস্থিত শিখ ধর্মের পবিত্র তীর্থস্থান স্বর্ণমন্দিরে খালিস্তানি জঙ্গী নিধনের জন্যে “অপারেশন ব্লু ষ্টার” নামক সামরিক অভিযান চালানোর অনুমতি দেয়। এর পরে সেনাবাহিনীর আক্রমণে সেখানে নিহত হন অসংখ্য সাধারণ শিখ ধর্মালম্বীরা ও বিশ্বজুড়ে এই ঘটনা একটি আলোড়ন সৃষ্টি করে। এর বদলা নিতে শ্রীমতি গান্ধীকে তাঁর বাসভবনেই সেই বছরের অক্টোবর মাসে গুলি করে হত্যা করে তাঁর শিক্ষা দেহরক্ষীরা। এই ঘটনার পরে দেশজুড়ে কংগ্রেস পার্টির প্ররোচনায় শিখ নিধন হয়।

এর পরেই নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গড়েন শ্রীমতি গান্ধীর পুত্র রাজীব গান্ধী। ক্ষমতায় এসে গান্ধী আমলাদের সাহায্যে আসু ও অসম আন্দোলনের নেতৃত্বের সাথে অসম চুক্তি সই করেন ১৯৮৫ সালের অক্টোবর মাসে। এই চুক্তির ফলে একদিকে যেমন সরকার অসম আন্দোলনের দাবি মেনে বাঙালিদের ভোটাধিকার ও নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার পথ রাষ্ট্রীয় ভাবে স্বীকৃতি পায়, তেমনি অন্যদিকে নেলি গণহত্যা কাণ্ডের যে সকল মামলায় পুলিশ চার্জশিট জমা দিয়েছিল সেই সকল মামলাও প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

অন্যদিকে অসম আন্দোলনের থেকে কয়েকটি ধারার রাজনীতির উৎপত্তি হয়। একদিকে আসুর থেকে প্রফুল্ল মহন্ত প্রতিষ্ঠা করেন অসম গণ পরিষদের (অগপ), যে দল নির্বাচনে জিতে অসমে সরকার গড়ে, অন্যদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ অসম (উলফা) সৃষ্টি হয় হিংসাত্মক আন্দোলন চালিয়ে যেতে। এছাড়াও আসু নিজের রাজনৈতিক কর্মকান্ড এই দুই সংগঠনের থেকে আলাদা ভাবে চালিয়ে যেতে থাকে।

কংগ্রেস যেহেতু তাঁদের বাঁচার অধিকার সুনিশ্চিত করতে পারেনি, তাই নেলি গণহত্যা কাণ্ডের পরে বেঁচে থাকা সেই অঞ্চলের মানুষ প্রাণ বাঁচাতে অগপ-র সাথে সমঝোতা করেন বলে চন্দ তাঁর রিপোর্টে উল্লেখ করেছিলেন। অগপ সরকার গঠন করার পরে অসম চুক্তি অনুসারে নেলি গণহত্যার বাকি মামলাও প্রত্যাহার করে নেয়, ফলে অপরাধীরা বুক ফুলিয়ে ঘুরতে থাকে অঞ্চলে।

ওয়াশিংটন ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক পিউ রিসার্চ সেন্টার সদ্য প্রকাশিত রিপোর্টে বলেছে, ২০২০ অর্থাৎ কোভিড কালে ধর্মকে জড়িয়ে সামাজিক শত্রুতার সূচকে ১৯৮টি দেশের মধ্যে ছিল ভারত শীর্ষে। আমেরিকা ভিত্তিক আর এক সংস্থা কাউন্সিল অন মাইনরিটি রাইটস ইন ইন্ডিয়া-র সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, ২০২২-এ ভারতে সংখ্যালঘুদের উপর সংঘঠিত ঘৃণামূলক অপরাধের ২৯৪টি মামলার ১৯২টি হয়েছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে। খ্রিস্টান ও শিখদের বিরুদ্ধে সংঘঠিত হয়েছে যথাক্রমে ৯৫ এবং সাতটি। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক অপরাধের ঘটনাগুলির বেশির ভাগই বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে ঘটেছে, যা একটি প্যাটার্নকেই ইঙ্গিত করে।

(সকল তথ্য , ছবি , বিভিন্ন লেখা , প্রকাশিত আর্টিকেল থেকে।
কৃতজ্ঞতা সেসব লেখকদের জন্য , যারা তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন)