• ২১শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ৮ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ২৩শে শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

হৃদয়ভাঙা মর্মান্তিক কাহিনী : মধুখালীতে উগ্রবাদীদের হাতে নিহত নিথর দুটি দেহ উপহার পেল বৃদ্ধ দাদী , আশরাফুল ও আরশাদুলের করুণ কাহিনী

usbnews
প্রকাশিত মে ১৬, ২০২৪
হৃদয়ভাঙা মর্মান্তিক কাহিনী : মধুখালীতে  উগ্রবাদীদের হাতে নিহত নিথর দুটি দেহ উপহার পেল বৃদ্ধ দাদী , আশরাফুল ও আরশাদুলের করুণ কাহিনী
নিউজটি শেয়ার করুনঃ

মধুখালী ডুমাইন পঞ্চপল্লীতে হিন্দু  উগ্রবাদীদের হাতে নিহত কোরআনের হাফেজ আশরাফুল ও আরশাদুলের বেড়ে ওঠা ও হাফেজ থেকে শ্রমিক হওয়ার ঘটনা তুলে আনতে গিয়ে বেরিয়ে আসছে পিতা-মাতার আদরবঞ্চিত দুই ভাইয়ের জীবনের করুণ কাহিনী। এই হৃদয়ভাঙা মর্মান্তিক কাহিনী ।

নিহত আশরাফুল ও আরশাদুলের বয়স যখন ৮/১০ বছর তখন তাদের পিতা মো. শাহজাহান খান থাকতেন প্রবাসে। ৫/৬ বছর প্রবাসী জীবন কাটিয়ে দেশে ফেরার পরই আশরাফুল ও আরশাদুলের শিশু জীবনের ওপর নেমে আসে ঘোর অন্ধকার।

পারিবারিক সমস্যাজনিত কারণে আশরাফুল ও আরশাদুলের আপন মা-আয়শা বেগম (৪০) এবং পিতা মো. শাহজাহান খানের মধ্যে দীর্ঘ ১০ বছরের সংসার জীবনের অবসান ঘটে ভুল বোঝাবুঝিতে। ভেঙে যায় সংসার। আলাদা হয়ে যায় তাদের শিশু বয়সেই দুই প্রান্তের ভাগ হয়ে যায় মা-বাবা। পিতৃহীন হয়ে পড়ে দুই ভাই। মা জননী ও বেঁচে থাকতে ঘর করে অন্যের সংসারে। পিতা জীবিত থাকতেও তারা হয়ে যায় এতিমের মতো। তথা পিতা মাতাহীন দুটি জীবন্ত বাঁধন হয়ে ওঠে হতাশার কাফন। জীবন্ত দুটি লাশ।

তাদের গর্ভধারিণী মা আয়শা বেগম (৪০)-এর স্বামী তথা তাদের পিতা শাহজাহান খান দীর্ঘদিন প্রবাসে সময় কাটানোর কারণে পারিবারিক কলহে অন্যত্র বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন আশরাফুল ও আরশাদুল মা আয়শা। পিতা বিদেশে মা অন্যের ঘরে। পুরো অসহায় হয়ে পড়ে তারা দু’জন। মা এবং বাবা দুইজন দুই মেরুতে বসবাস করলেও এই দুটি শিশুর শেষ ঠাঁই হয় বৃদ্ধ দাদী জরিনা বেগম (৬৮) এবং অবিবাহিত ছোট চাচা মো. শাজ্জাদ খানের (২৭) কাছে। দাদী এবং ছোট চাচা মিলে স্থানীয় মক্তবে ভর্তি করেন তাদের। সেই ২০১২/১৩ সালের আগের কথা।

মধুখালী বিশ্ব রোডের পাশে ছিল পুরাতন মহিলা মাদরাসা। এ মাদরাসার পাশেই গড়ে উঠেছিল ছোট একটি হেফজখানা। দুই সহোদরকে ওখানে ভর্তি করে দেন দাদী জরিনা বেগম। আপন ছোট চাচা মো. সাজ্জাদ খান তাদের দুই ভাইকে প্রতিদিন মাদরাসায় দিয়ে যেতেন এবং নিয়ে আসতেন। এ মাদরাসা থেকেই দুই সহোদর আম্মাপারা, নুরানি কায়দা শেষ করে। তাদের জ্ঞান অর্জনের উর্বর শক্তির কারণে অল্পদিনের মধ্যেই কোরআন হাতে দেন হেফজখানার ওস্তাদজী হাফেজ মো. মোবারক আলী। মধুখালী-যশোর সড়ক প্রশস্ত করার কারণে বিলুপ্ত হয়ে যায় ঐ ছোট্ট হেফজখানাটি।

এরপর ঐ হেফজ খানার ওস্তাদজী তাদের দুই ভাইকে ভাল একটি হেফজখানায় ভর্তি করার পরামর্শ দেন দাদী ও চাচাকে। তখন তাদের সৎ মায়ের সহযোগিতায় ৬৮ বছর বয়সী দাদী জরিনা বেগম মধুখালী থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে মাগুরা জেলার মোহম্মদপুর উপজেলার দীঘা ইউনিয়নের পাল্লা গ্রামের ‘পাল্লা দারুল উলুম কওমী হাফেজি ও এতিম খানা ’ মাদরাসা ভর্তি করান দুই ভাইকে।

ঐ এলাকার সামাজিক রীতি-রেওয়াজ হলো মাদরাসায় যারা দূর থেকে এসে হাফেজি পড়তে আসবে এলাকার প্রত্যেকের বাড়িতে তাদের লজিং মাস্টার রাখতে হবে। ঠিক সে নিয়মে পড়ে লজিং বাড়িতে খেয়ে মাদরাসায় পড়ে। দুই ভাই নাজেরা বিভাগ হেফজখানায় একসাথে ভর্তি হয় তারা। একসাথে দুটি বিভাগে পড়া খুবই কঠিন কাজ।

ঐ মাদরাসার শিক্ষক হাফেজ মো. আবজাল হুসাইন ইনকিলাবকে জানান, তারা দুইজন ১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয় এ হেফজখানায়। হাফেজ ছাত্র হিসেবে আশরাফুল ১৫ পারা এবং আরশাদুল-৫ পারা কোরআন মুখস্ত করেন এখান থেকেই। এরপর দেশে চলে আসে করোনা মহামারি। সারাদেশে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হলে তারা দুই ভাই আবারো চলে যায় বৃদ্ধ দাদী জরিনা ও ছোট চাচা সাজ্জাদ খানের কাছে।

এটাই তাদের শেষ আশ্রয়স্থল। পাল্লা থেকে ফিরে এসে মধুখালী এলাকার ‘শামচু আনজুয়ারা মাদরাসা’ হাফেজী মাদরাসায় ভর্তি হয়ে আশরাফুল ২২ পারা এবং আরশাদুল ১৫ পারা কোরআনের হাফেজ হয়ে বেরিয়ে পড়ে চরম অর্থকষ্টে। বাড়ি এসে তিন বেলা খাবার না পাওয়ার কষ্ট। সইতে পারেনি বৃদ্ধ দাদী। একদিকে দুই বেলা অনাহারী এক বেলা ভাত অথবা অর্থ ক্ষুদের জাউ খেয়ে বেঁচে থাকা। সাথে সংসারে ফিরে আসায় সৎ মায়ের অসৎ আচরণ এবং চরম দুর্ব্যবহার। পরে পারিবারিক অর্থ কষ্টের কারণে মাদরাসা ছেড়ে ফিরে আসতে হলো বাড়িতে। অভাবের সংসার। বাবা একদিকে, গর্ভধারিণী মা আরেক সংসারে। দাদীর সংসারে এসে বাসা বাধলো সৎ মা। আরাম আয়েশে বসে চারটা ডাল ভাত খাওয়ার ভাগ্য হয়নি তাদের কপালে।

বৃদ্ধ দাদীর মুখের দিক তাকিয়ে স্কুল মক্তব মাদরাসা ছেড়ে নেমে পড়লো কাজের সন্ধানে। কথা হলো নওপাড়া ইউনিয়নের চোপরঘাটের রাজের ঠিকাদার মো. জালাল উদ্দিন জালোনের সাথে। যে জালোন ডুমাইনে মন্দিরে কথিত আগুনের ঘটনায় ওদের হাত পা বেঁধে নিশ্চিত মৃত্যুতে উগ্রবাদীদের দাঁড়িয়ে থেকে সহযোগিতা করেছেন। প্রথমে রাজমিস্ত্রীর সহযোগী ৫/৬ বছর কাজ করার পর হলো ফুল মিস্ত্রি। বড় ভাই আশরাফুল হন রাজমিস্ত্রী এবং ছোট ভাই আরশাদুল হয় রড বান্ধা ও কাটার মিস্ত্রি। রোজ ১৫শ’ থেকে ১৭শ’ টাকা বেতনে কাজ করেন ওরা দুই ভাই।

পঞ্চপল্লীর স্কুলের কাজটি শেষ হলেই বিয়ের পিঁড়িতে বসবে বড় ভাই আশরাফুল। বৃদ্ধ দাদীর শেষ ইচ্ছে নাত-বউয়ের মুখ দেখেই মরবে। পারিবারিকভাবে সে প্রস্তুতি চলছিল। শেষ পর্যন্ত দুই ভাইকে একসাথে গত ১৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় উগ্রবাদী হিন্দুদের হাতে মিথ্যা অজুহাতে লাশ হয়ে রক্তে ভেজা দেহ নিয়ে ফিরতে হলো দাদীর সামনে। নিথর দুটি দেহ উপহার পেল বৃদ্ধ দাদী জরিনা। যেদিন কোরআনের হাফেজ সহোদর দুটি ভাইকে উগ্রবাদীরা পিটিয়ে খুঁচিয়ে থেঁতলে হত্যা করলো সেদিন ওদের বয়স তথা আশরাফুলের বয়স ১৯ বছর এবং আরশাদুলের বয়স ১৫ বছর।

এলাকাবাসী মুখের একটাই কথা, ওরা দুটি ভাই ছিলো যেমন মেধাবী তেমনি ভদ্র এবং বিনয়ী। সুখ বলতে কী জিনিস কখনও ওদের কাছে আসেনি। শিশুকাল কাটছে একবেলা খেয়ে। কৈশর কাটছে লজিং বাড়িতে খেয়ে। যৌবনে এসে দুই ভাই একসাথে চলে গেলো পরোপারে বিপদগামীদের হাতে মিথ্যা অজুহাতের বলি হয়ে।

উল্লেখ্য, হাফেজ আশরাফুল ও আরশাদুল গত ১৮ এপ্রিল মন্দির পোড়ানো কলঙ্ক নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেও মৃত্যুর ২০/২২ দিন পর ওদের কলঙ্কমুক্ত করেছে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসকের তদন্ত টিম।

 

মধুখালী মন্দিরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা

নিহত দুই সহোদরের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাননি ডিসির তদন্ত কমিটি

মধুখালী উপজেলার ডুমাইন পঞ্চপল্লীর মন্দিরে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনায় সংবাদ পরিবেশনের প্রথম থেকে টানা ১২-১৩টি সংবাদ পর্বে সর্বশ্রেণির মানুষ এবং নিহতদের পরিবারের বক্তব্য অনুযায়ী সরেজমিনে প্রতিবেদন করা হয়। দুই সহোদর হাফেজ শ্রমিক আশরাফুল ও আরশাদুলের মন্দিরে আগুন দেওয়ার ঘটনার কোনো প্রমাণ নেই। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কোনো স্বাক্ষীও ছিল না। এমনকি নিহত দুই সহোদরসহ আহত ৩ থেকে ৪ জন নির্মাণ শ্রমিকরাও যে আগুন দেওয়ার ঘটনায় সম্পৃক্ত আছে এমন কোনো প্রমাণ প্রশাসনের কোনো লোক বা সাধারণ জনগণ কেউ প্রমাণিত করতে পারেননি। তারা কেউ মন্দিরে আগুন দেয়নি। কে বা কাহারা ধরিয়েছে তারও কোনো প্রমাণ মেলেনি। শুধুমাত্র সন্দেহবশত দুই সহোদর পিটিয়ে খুঁচিয়ে থেঁতলে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকারী স্থানীয় উগ্রবাদীরা। নেপথ্যে দুইজন জনপ্রতিনিধি।

মন্দিরে কথিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার নাটক মঞ্চায়ীত হয় ১৮ এপ্রিল সন্ধ্যায়। এই ঘটনায় মধুখালী থানা মামলা হয় ১৯ এপ্রিল। যার বাদী নিহতদের পিতা মো. শাহজাহান খান। ঐ মামলায় ৪০ জন অজ্ঞাত নামা ব্যক্তির কথা উল্লেখ করা হয় বলে নিহতের বাবা  নিশ্চিত করেছেন।

এই ঘটনার পর জেলা প্রশাসকের দফতর থেকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিএম) কে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ঐ কমিটি সরেজমিনে সকল পর্যায়ের মানুষের সাথে কথা বলে তদন্ত কমিটি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন মন্দিরে আগুন দেয়ার ঘটনায় নিহত আশরাফুল ও আরশাদুলসহ কোনো শ্রমিককের সম্পৃক্ততা নেই। তবে কে বা কাহার আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন সে বিষয়ও কেউ স্বাক্ষ্য দেননি এবং চাঁদাবাজির ঘটনা প্রমাণে কেউ স্বাক্ষ্য দেননি বলে তদন্তে উঠে আসে। ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নের পঞ্চপল্লীতে দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করেছে। গতকাল সোমবার বিষয়টি ফরিদপুর জেলা প্রশাসকের দফতর হতে গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করা হয়েছে। ঘটনার ২৪ দিন পরে গত রোববার জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন।

তিনি জানান, তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী ৭ মে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার পিএএ বলেন, তদন্ত কমিটি তাদের কার্যক্রম পরিচালনাকালে শতাধিক ব্যক্তির বক্তব্য গ্রহণ করেছেন। তাদের বক্তব্যে, এ ঘটনার সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ শতাধিক ব্যক্তি জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জেলা প্রশাসক আরো বলেন, ‘এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিসহ অনেকের সম্পৃক্ততা ছিল। এটি বিভিন্ন ভিকটিমদের বক্তব্যে উঠে এসেছে। তবে মন্দিরে আগুন লাগানোর সঙ্গে নিহত দুই ভাই জড়িত কি-না, সেই বিষয়ে বক্তব্য পাওয়া যায়নি। মন্দিরে কে আগুন দিয়েছে, সেটি খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য পাওয়া যায়নি।’

জেলা প্রশাসক আরো বলেন, তদন্ত কমিটি অনেকগুলো পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। এ সবস্থানে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যাতে সিসি ক্যামেরা থাকে এবং অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা যেন থাকে।
এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ এ ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যাতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের জানিয়ে বাস্তবায়ন করা হয়। এ ঘটনায় চাঁদাবাজির অভিযোগের বিষয়ে কারও কাছ থেকে প্রমাণস্বরূপ বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, গত ১৮ এপ্রিল রাতে পঞ্চপল্লী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে আটকে দুই ভাই কোরআনে হাফেজ নির্মাণ শ্রমিক আরশাদুল খান (১৯) ও আশরাফুল খান (১৫) কে পিটিয়ে হত্যা থেঁতলে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে একটি মন্দিরের প্রতিমার কাপড়ে অগ্নিসংযোগের অভিযোগ তুলে গ্রামবাসীকে উত্তেজিত করে তোলে জড়িতরা। এ ঘটনায় কয়েকজন শ্রমিক ও পুলিশ আহত হয়।

এ ঘটনার পরে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীকে প্রধান করে প্রথমে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরে তদন্ত কমিটির সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে সাত সদস্যে উন্নীত করা হয়। একইসঙ্গে কমিটির মেয়াদও বাড়ানো হয়।

 

মধুখালীর ডুমাইন পঞ্চপল্লীর মন্দিরে আগুন দিলো কে? কী অপরাধে খুন করা হয় সহোদর দুই ভাইকে? এমন সব কথা পুরো মধুখালী উপজেলা ছাপিয়ে এখন  সবার মুখে মুখে। এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এখন দেশব্যাপী সবাই জেনেছেন।

একমাত্র জাতীয় দৈনিকে পরিবার নিহতদের পাশে এসে সঠিক ও বাস্তব চিত্রটি তুলে না ধরলে আমরা কেউ জানতেই পারতাম না। গতকাল এ প্রতিনিধি নিহতদের গ্রামের বাড়ি চোপোড়ঘাট এবং পঞ্চপল্লী এলাকায় সরেজমিনে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনকালে সাথে কথা বহুজনের সাথে। এ সময় নিহতদের গর্ভধারিণী মা আয়শা বেগম উল্লেখিত কথাগুলো বলেন। উপজেলার কামাল দিয়া ইউনিয়নের মির্জাকান্দি এলাকার খোরশেদ খানের বাড়িতে গেলে তিনি কিছু সময়ের জন্য কথা বলেন।

এদিন কথা হয় ফরিদপুর টিটিসির গেস্ট টিচার পলাশ কুমার দাসের সাথে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, হাফেজ শ্রমিক দু’ভাইকে যারা সন্দেহবসত রশি দিয়ে বেঁধে নির্মমভাবে মধ্যযুগীয় কায়দায় হত্যা করেছেন তারা মোটেও ঠিক করেনি। আমি কাজটি মনে-প্রাণে ঘৃণা করি। এর চেয়ে জঘন্যতম কাজ আর কী হতে পারে!

পঞ্চপল্লী এলাকায় সরেজমিনে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে গেলে বালিয়াকান্দি এলাকার গণমাধ্যমকর্মীকে কানাই লাল বাবু বলেন, ভাই আমার প্রথম কথা হলো মন্দিরে আগুন ধরালো কারা? দেখছে কারা? এমন দেখা বা শোনা কোনো সাক্ষী আছে কিনা? দেখা কোনো সাক্ষী আছে এমনটা শুনিনি। ২য় কথা হলো দুটি ছেলেকে সন্দেহবশত যারা নির্যাতন করে মারলেন তারা কারা? তাদের পরিচয় কী? দুটি ঘটনার কোনোটারই কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না, তাহলে এতো লুকোচুরি কেন?

 

মন্দিরে আগুন দিলো কে? কী অপরাধে খুন করা হলো দুই ভাইকে -প্রশ্ন দেশব্যাপী ,  ফরিদপুরবাসীর

পার্শ¦বর্তী উপজেলা মোহম্মদপুরেন স্বপন পাল বলেন, ভাই মন্দির আমাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সেখানে কে বা কার আগুন দিলো, তাকে কেন্দ্র করে দুটো ছেইলে মারা পড়লো এটা করা ঠিক হয়নি। যারা মন্দির আগুন দিয়েছে এটাও যেমন মন্দ কাজ, দুই ভাইকে যারা সন্দেহ করে পিটিয়ে মারছে এটাও জঘন্যতম কাজ। কোনো ধর্মের লোক খুন, মন্দিরে আগুন, এতে আমরা বিশ্বাসী না। ভগবান সকলকে শান্ত করুন।

ডুমাইন ইউনিয়নের মো. মামুন মোল্লা বলেন, মসজিদ-মন্দির দুটোই ধর্মীয় উপাসনালয়। এগুলো নিয়ে বির্তক নাই। আল্লাহকে যেভাবে যেখানে যে কেউ ডাকবে, সেখানেই তিনি সাড়া দিবেন।

মধুখালী আড়পারার সাগর মিয়া বাগহাট বাজার থেকে আশরাফুলদের বাড়ি আসেন তাদের পরিবারের কী অবস্থা জানতে এবং সমবেদনা জানাতে। তিনিও আগে মাদরাসায় পড়তেন। নিহত দুই সহোদরকে আগে থেকেই চিনতেন। তিনি বলেন, আমার সাফ কথা, মন্দিরে আগুন দিলো কারা? এবং দুই সহোদর কোরআনের পাখি দু’টিকে পিটিয়ে হত্যা নিশ্চিত করলো ক’জন? তারা এখন কোথায়? ৫ ঘণ্টা ধরে পুলিশের সামনে পিটিয়ে এদেরকে খুন করা হলো, থানার ওসি ছিল অবরুদ্ধ, এত সাহস তারা পেল কোথায়? এদের মদদদাতা কারা? সব খুঁজে বের করতে হবে।

হাফেজ আরশাদুলের একজন সাথী হাফেজ আকরাম আলী সম্প্রতি পুরো কোরআন শেষ করে হাফেজী পাগড়ী নিয়ে তাদের দুই ভাইয়ের কবর জিয়ারত করতে আসেন রোববার সকালে। তিনি বলেন, আমিও পাল্লা মাদরাসার ছাত্র ছিলাম। তিনি কান্নাকাটি করে বলেন, একটা ছেলে ২২ পারা এবং আরেকটি ছেলে ১৫ পারা কোরআনের হাফেজ। এটা যে কত বড় কঠিন কাজ এবং কত বড় নেয়ামত এটা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। তিনি আরো বলেন, আমার মনে হয় না এ হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে! খুনিরা ধরা পড়বে! তদন্তেই সব শেষ।

মধুখালী ডুমাইন পঞ্চপল্লী এবং চোপোড় ঘাট এলাকাবাসীর সবার মুখে একটাই কথা, আসলে মন্দিরে হামলা বা আগুন দিলো কারা? আর দুই সহোদর হাফেজ ভাইকে মারলো কারা? যেহেতু মন্দিরে আগুন দেয়া লোকগুলোকে চিহ্নিত করা যায়নি, তাহলে মামলার ভবিষ্যৎ কী? কী অপরাধে দুটি হাফেজ ছেলেকে মরতে হলো।

মাগুরা মহম্মদপুর পাল্লা মাদরাসায় আসা-যাওয়ার সময় হাফেজ আশরাফুল ও আরশাদুল নওয়াপাড়ার মধুমতী নদী পার হতো ইঞ্জিনচালিত নৌকায়। ঐ ঘাটের ইজারাদার মো. রবিউল ইসলাম বলেন, এ হত্যার বিচার যদি মধুখালিবাসী চায় তাহলে হবে। ফরিদপুরের ডিসি -এসপি চাইলে হবে না। কারণ হিসেবে তিনি বললেন, বড়োর ওপরেও বড় আছে। মধুখালী চোপড়ঘাট এবং পঞ্চপল্লীতে এখনও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা রয়েছে।

চোপড়ঘাট এলাকায় নিহত হাফেজ নির্মাণ শ্রমিক আশরাফুল ও আরশাদুলের জন্মস্থান। বাড়ির পাশে এলাকার কবরস্থান। ওখানেই চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে আছে কোরআনের পাখি দুই ভাই। এখনও নিরব নিথর পুরো এলাকা। কী হয়ে গেল? এলাকার বহু মুরব্বি, আপনজনরা বলাবলি করছেন। প্রিয় মুখ দুটির কথা মনে করে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন ওদের নিঃস্বার্থ ভালবাসার মানুষগুলো। ওদের হত্যাটা কেউ মেনে নিতে পারছেন না।

সকলের মুখে একটাই প্রশ্ন? মন্দিরে আগুন দিলো কারা? কী অপরাধে খুন করা হলো হাফেজ দুইটি ভাইকে।

 

 

নিহত দুই সহোদর আশরাফুল ও আরশাদুলের দাদী মা, মা-বাবা-চাচারা-চাচাতো ভাই-ভাবিসহ এলাকাবাসীর দাবি এবং জোড়ালো বক্তব্যে

ঘটনা গত রমজানের তথা ঈদের এক সপ্তাহ আগের। যারা তাদের পিটিয়ে হত্যা নিশ্চিত করছেন তারা তাদের কাছে এক বান্ডিল রড অথবা সমপরিমাণ টাকা চায়। এই বিষয় বহু রাগারাগি হয় তাদের সাথে। বিষয়টি নিহত আশরাফুল ও আরশাদুল ফোনে ওর বাবা দাদী ও চাচাদের জানিয়েছেন। স্থানীয়রা চাঁদা বা রড চায়। তাদের উপর খুব চাপ এ কথাও জানায় ফোনে।

পরে তাদের পরিবার ঐ স্কুলের কাজের ঠিকাদার নওপাড়া ইউনিয়নের চোপরঘাটের ঠিকাদার মো. জালাল উদ্দিন জালোনকে জানায় এবং আশরাফুল ও আরশাদুলকে বাড়িতে আশার কথা বললে তারা বাড়ী ফিরে আসে এবং ও কাজে আর যাবে না মর্মে পারিবারিক সিদ্ধান্ত হয়। বিষয়টি ঠিকাদার জালোন এবং নিহতদের পরিবার ছাড়া ডুমাইন ইউনিয়নের পঞ্চপল্লী এলাকার কোনো জানেন না। তাই চাঁদাবাজি বা রড চাওয়ার ঘটনাটি প্রমাণ হয়নি।
তবে ইনকিলাবের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন চাঁদাবাজির ঘটনাটি সত্যি বলে নিশ্চিত করছেন নিহতের বাবা মো. শাহজাহান খান, চাচা, মো. রাজ্জাক খান, চাচাতো ভাই মো. ইমরান খান এবং তার স্ত্রী মুক্তা খান।

তারা  বলেন, ঈদের পড়ে তাদের দায়বার ঠিকাদার জালোন বুঝে নিয়ে তাজা শরীরের নিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত বাড়ি ফিরে দুটি লাশ পাঠালো, তাদের হাত পা বাঁধা এবং পিটিয়ে খুঁচিয়ে থেঁতলে মারার সময় ঠিকাদার জালোনও নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। তারা বলতে চান নিরবতাই ছিলো পিটিয়ে খুঁচিয়ে থেঁতলে মারা মৌন সমর্থন। নিজেই জানতো তারা কেউ মন্দিরে আগুন দেয়নি। কিন্তু তাদের কে হাত পা বেঁধে হত্যার সময় মুখ না খোলার কারণ কি ছিল। এই বিষয়টি ও তদন্তের আওতায় আনার জন্য তারা সকলে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করছেন। তবে নিহতের পরিবার বলছেন, জেলা প্রশাসকের তদন্ত আমরা খুশি তারা দুই ভাই মন্দিরে আগুন দেয়নি সেটা প্রমাণ করছেন।

এই বিষয়ে আশরাফুল ও আরশাদুলের মা মরিয়ম বেগম, বাবা শাহজান খান, চাচা রাজ্জাক খান ও চাচাতো ভাই ইমরান খান  বলেন, আমরা দেশব্যাপী লোক জানতে পারছেন ১২ জন লোক তাদের হত্যার ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত তাদের ভিডিও ও ছবি হাজার হাজার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং টিভি ও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এখন এদের সকলকে ৪০ জনের অজ্ঞাত নাম বাদ দিয়ে ছবি প্রকাশিত ১২ জনের নাম দিয়ে পিতা বয়স ও গ্রামের ঠিকানা দিয়ে মামলার চার্জসিট দেয়া হোক এবং এই আসামিদের এক এক করে আটক করে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞেস করা হোক। তা হলে সবকিছু বের হয়ে যাবে।

অন্যথায় এই আলোচিত মামলাটি জেলার সিআইডি পুলিশ অথবা পিবিআইকে সম্পৃক্ত করা হোক। এতে করে তাদের মামলার আসামি আটক হবে এবং মামলার তদন্তে গতি পাবে বলে তারা মনে করেন।