জাতীয় সংসদের চলতি বাজেট অধিবেশনে ২০ জুন বক্তৃতায় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এমপি বলেছেন, ‘আমলাদের একটি অংশ দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠেছে, এতে জনগণের হয়রানি বাড়ছে। অল্পসংখ্যক দুর্নীতিপরায়ণ আমলার জন্য সারা আমলাতন্ত্র বদনামের ভাগীদার হচ্ছে। সরকারি কর্মচারীদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বার্ষিক হিসাব বাধ্যতামূলক করা এখন সময়ের দাবি। কিছুসংখ্যক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কারণে দেশের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। এসব ব্যাপারে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করলে দুর্নীতি কমবে।’ এর আগে ড. আব্দুল মোমেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘বিদেশে বেশি অর্থ পাচার করেন সরকারি চাকরিজীবীরা। কানাডার টরন্টোয় বাড়ি করা বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে সরকারি কর্মচারীর বাড়িঘর সেখানে বেশি আছে। কানাডায় টাকা পাচারের যে ২৮টি ঘটনার তথ্য জানা যায় তার মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীই বেশি।’ ড. মোমেনের ২০২০ সালে ‘আমলাদের কানাডায় বেশি টাকা পাচার’ এবং গত বৃহস্পতিবার সংসদে দেয়া বক্তব্য কোথাও তেমন গুরুত্ব পায়নি। তবে তার বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে খুবই গুরুত্বসহকারে আলোচনা, মন্তব্য, শেয়ার, লাইক দেয়া হচ্ছে। গত কয়েক বছর ‘গণমাধ্যমগুলো’ স্বকীয়তা হারিয়ে ক্ষমতাসীনদের তল্পীবাহকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও দেশের নানান নিবর্তনমূলক আইনের মধ্যে থেকে গত কয়েক মাসে গণমাধ্যমগুলো সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, সাবেক সেনাপ্রধান আবদুল আজিজ, ঢাকা মহানগরের সাবেক পুলিশ কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, ডিআইজি জামিল হাসান, এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের প্রশাসনের উচ্চপদকে অপব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের যে চিত্র তুলে ধরেছে তা দু:সাহসী ভুমিকা পালনের নামান্তর। রাষ্ট্রের চতুর্থস্তম্ভ গণমাধ্যম ঝুঁকি নিয়েই দেখিয়ে দিয়েছে প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কিভাবে দেখকে দুর্নীতির শ্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছেন। দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে এ নিয়ে চলছে আলোচনা, সমালোচনা ও তীব্র বিতর্ক। এর সঙ্গে পুলিশ সার্ভিস এসোসিয়েশনের বিবৃতি দিয়েছে। পুলিশ এসোসিয়েশনের সেই বিবৃতির পক্ষে অবস্থান নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তথ্য ও সম্প্রদার মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে যেন গণমাধ্যমে পুলিশের খবর প্রচারে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। এই প্রেক্ষাপটে সম্পাদক পরিষদ বিবৃতি দিয়ে পুলিশ সার্ভিস এসোসিয়েশনের বিবৃতিকেক স্বাধীন গণমাধ্যমের জন্য হুমকিসরুপ বলে উল্লেখ করেছে। সাংবাদিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয় (বিএফইউজে), ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে), ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটি (ডিআরইউ) পাল্টা বিবৃতি পরিস্থিতি আরো গরম হয়ে গেছে। বিবৃতিতে সাংবাদিক নেতারা বলেছেন, পুলিশের সাবেক কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার লুটপাট নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বিজ্ঞপ্তির ভাষা দেখলে মনে হয়, স্বাধীন গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করতে হুমকি দিয়েছে পুলিশ। এ ধরনের হুমকি কেবল পুলিশি রাষ্ট্রেই দেখা যায়। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের এ ধরনের ঔদ্ধত্য রাষ্ট্রীয় শৃংখলাভঙ্গের শামিল।
এ প্রসঙ্গে গতকাল টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড.ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম নিয়ে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বিবৃতিকে স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতি সংবিধান পরিপন্থি হুমকি। এটা ফাঁস হওয়া সাবেক শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ অর্জনের তথ্য প্রকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির পাশাপাশি পুলিশ বাহিনী একাংশের দুর্নীতির সুরক্ষা প্রদানের অপচেষ্টার নামান্তর।
এ অবস্থায় গত ৪ জুন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বেনজির আহমেদ ও আবদুল আজিজ আওয়ামী লীগের লোক নয়। সিনিয়রিটি ও মেধার ভিত্তিতে বেনজীর আইজিপি হয়েছিলেন। তেমনি আজিজ আহমেদও তার যোগ্যতায় ও সিনিয়রিটিতে সেনাপ্রধান হয়েছেন। এখন ভেতরে তারা যদি কোনো অপকর্ম করে এটা যখন সরকারের কাছে আসে, তখন এদের বিচার করার সৎ সাহস সরকারের আছে। দুর্নীতিবাজ যত বড় প্রভাবশালী হোক তার বিচার হবে।’

১৯৮৮ সালে নিবন্ধন নেওয়া বেসিক ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করে ১৯৮৯ সালে। এক যুগ আগে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেশ ভালো অবস্থানেই ছিল ব্যাংকটি। শিল্প গ্রুপগুলো এই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করত। তখন ব্যাংকটি ভালো মুনাফা অর্জন করত। উচ্চ বেতনে কর্মী নিয়োগ দিত। সেই সময় পদাধিকারবলে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব।
২০০৯ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সাবেক সংসদ সদস্য শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে চেয়ারম্যান বানিয়ে বেসিক ব্যাংকের নতুন পর্ষদ গঠন করে সরকার। এরপরই ব্যাংকটির ছন্দপতন শুরু হয়। নিয়ম ভেঙে এবং তথ্য গোপন করে একের পর ঋণ দেয় বেসিক ব্যাংক। যার অধিকাংশই আদায় করা যায়নি। সংকট দূর করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের পক্ষ থেকে নানা সহযোগিতা করা হয়। কিন্তু আর্থিক সূচকে উন্নতি করতে পারেনি শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর হাতে ডুবে যাওয়া ব্যাংকটি।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের বিভিন্ন প্রতিবেদনে ব্যাংকটির টাকা লোপাটে শেখ আবদুল হাইয়ের সংশ্লিষ্টতা উঠে এলেও তাকে সম্মানের সঙ্গে পদত্যাগ করার সুযোগ করে দেয় সরকার। পরের আট বছর আত্মসাৎ করা অর্থে বাড়ি ও জাহাজ কিনে আরাম-আয়েশে জীবন কাটান তিনি। শেষপর্যন্ত তাকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাদের বিভিন্ন মামলায় আসামি করে। আবদুল হাইসহ ১৪৫ জনের বিরুদ্ধে দুদক মোট ৫৯টি অভিযোগপত্র দিয়েছে। এর মধ্যে ৫৮টিতেই শেখ আবদুল হাই আসামি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন তদন্তে উঠে এসেছে আবদুল হাই বাচ্চুর নানা অনিয়মের তথ্য। পাঁচ বছর (২০০৯-১৪) দায়িত্বে ছিলেন বাচ্চু। এসময় ব্যাংকটিতে ঘটে যায় নজিরবিহীন ঘটনা। অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এ কেলেঙ্কারির বোঝা এখনো বইছে ব্যাংকটি। ২০১৩-২০২২ সাল- ১০ বছরে লোকসান দিয়েছে ৪ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। কিন্তু বেসিকের অর্থ আত্মসাৎকারীদের এখনো দৃশ্যমান কোনো শাস্তি হয়নি।
বেসিক ব্যাংক থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাটের প্রকৃত রহস্য উন্মোচন ও মূল হোতাদের পাকড়াও করতে মাঠে নামার পরও এক যুগ পেরিয়ে গেছে। সেই ২০১০ সাল থেকে শুরু হওয়া অনুসন্ধান ও তদন্তের মারপ্যাঁচে চাপা পড়ে আছে বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ফাইল। অগ্রগতি বলতে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে আড়াই হাজার কোটি টাকা আত্মসাতে ৫৬ মামলা দায়ের। এছাড়া তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তনের গ্যাঁড়াকলেও কেটে গেছে প্রায় ৯ বছর।মাঝে কেলেঙ্কারির পেছনের কারিগরদের এড়িয়ে দুই মামলার চার্জশিট জমা হলেও অসম্পূর্ণ তদন্ত প্রতিবেদন হওয়ায় তা গ্রহণ করেননি আদালত। ফলে বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির ওই কাঁটা দুদকের গলায় আজ অবধি বিঁধেই রয়েছে।এ বিষয়ে ২০১৮ সালের ৩০ মে দেশের সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্ট বিভাগ দুদকের ১০ তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব করে ক্ষোভ, উষ্মা ও হতাশা প্রকাশ করেন। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিম সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ওই সময় প্রকৃত হোতাসহ দোষীদের আসামি করে তদন্ত শেষে করার নির্দেশনা দেন। কিন্তু এরপরও কেটে গেছে ( ???) বছর।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে অত্যান্ত প্রভাবশালী এবং দলদাস আমলাদের অবৈধভাবে গড়ে তোলা সম্পদের চিত্র জনসন্মুখে উঠে আসা, দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়ায় বর্তমান প্রশাসনে কর্মরত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। প্রশাসনের কেন্দ্রীয় সদর দফতর সচিবালয় থেকে শুরু করে বিভন্ন অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, কর্পোরেশন, শাখা এমনকি জেলা উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে এই ভীতি ছড়িয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশ সচিবালয়ে প্রতি কর্মদিবসে যান এমন একাধিক সাংবাদিক জানান, কর্মকর্তা কর্মচারীরা ঈদের ছুটির পর থেকে অফিসে এসে প্রথমেই নিজেদের মধ্যে আজিজ, বেনজির, আসাদুজ্জামান মিয়ার মতো আর কার কার অবৈধ সম্পদ প্রকাশ পেতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করেন। এমনকি কাজের ফাঁদে নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করেন দুর্নীতি দমন কমিশন কার কার সম্পদের খোঁজখবর করছেন; দুদক কর্মকর্তারা কাদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করছেন। এমনকি যে সব মন্ত্রণালয়ে ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়ে না হিসেবে সবার কাছে চিহ্নিত ও পরিচিত সে সব কর্মকর্তাদের মধ্যে ভীতি আতঙ্ক বেশি। যারা এরোই মধ্যে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন তারা নিজেরা নিজেরাই অস্বস্থিতর মধ্যে সহকর্মীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। এতোদিন যারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়ে ক্ষমতাসীন দলের দলদাস ও চাটুকার হিসেবে নিজেদের জাহির করে প্রমোশন নিয়েছেন, অবৈধ পথে অর্থ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তাদের মধ্যে আতঙ্ক সবচেয়ে বেশি। কারণ সরকার যুক্তরাষ্ট্রকে প্রশাসনে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি’ দেখাতে কঠোর অবস্থায় গেছে। সে জন্য এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানকে একটি ছাগলকা-ে এনবিআর থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া ওই সরকারি কর্মকর্তাকে একই সঙ্গে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
সুত্রের দাবি মতিউর রহমানকে সরিয়ে দেয়ার পর সিভিল প্রশাসনে যারা গত কয়েক বছরে বিরোধী দল বিএনপির ওপর জুলুম নির্যাতনের পুরস্কার হিসেবে প্রমোশন এবং বিশেষ সুবিধা ভোগ করে দুর্নীতির সাগরে নিজেদের ভাসিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, ‘রাতেই ভোট করে আমরাই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছি’ বলে দম্ভোক্তি করেছেন এবং বিভিন্ন উন্নয়নমূলক মেগা প্রকল্পের পরিচালনায় সময় ক্ষেপন করে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি এবং লুটপাট করেছেন সেই চিহ্নিত কর্মকর্তাদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। অন্যদিকে সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনে যারা নিবেদিতপ্রাণ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত, দুর্নীতির সুযোগ পাননি এবং দুর্নীতির শ্রোতে নিজেদের ভাসিয়ে দেননি তাদের মধ্যে খুশির আমেজ। এতোদিন তারা নিজেদের অবহেলিত মনে করলেও নিজেদের সততার জন্য নিজেরাই একে অপরকে বাহবাব দিচ্ছেন। মূলত যারা ক্ষমতাসীন দলের দলদাস না হওয়ায় প্রমোশন পাননি এবং সম্পদের পাহাড় গড়াতে পারেননি তারা দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে খুশি।
সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদ, সাবেক সেনা প্রধান আব্দুল আজিজ, সাবেক ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, এনবিআরের সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমান, পুলিশের বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি জামিল হাসান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উত্তম কুমার বিশ্বাস, অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম শিমুলের যে সম্পদের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর বাদশাদের পরিবারের সম্পদকে হার মানায়। দায়িত্বশীল সুত্র জানায়, পুলিশ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিভাগ, জেলা এমনকি থানা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অনেকের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে যারা অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়-স্বজনের নামে তাদের মধ্যে ভীতি বেশি। এ ছাড়া প্রশাসনের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, জেলা, উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তা, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর এবং মেগা প্রকল্পের দায়িত্বপালন করা কর্মকর্তাদের মধ্যে ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করছে। একাধিক কর্মকর্তার মতে ‘চোরের মন পুলিশ পুলিশ’ প্রবাদের মতোই তারা দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ গড়ে তোলায় এখন ‘এই বুঝি গণমাধ্যমে আমার সম্পদের বিবরণ প্রক্শা হলো’ ভীত সন্ত্রস্ত। তবে যারা দুর্নীতির শ্রোতে নিজেদের ভাসিয়ে দেননি তারা বেশ ফুরফুরে মেজাজে রয়েছেন।
এদিকে দীর্ঘদিন ঘুমিয়ে থাকার পর দুর্নীতি দমন কমিশন এখন জেগে উঠেছে। পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদকে সংস্থাটি আইনের জালে আটকে ফেলেছে। দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তার বিপুল পরিমাণ সম্পদের বিবরণ গণমাধ্যমে আসার পর তদন্তের চিন্তা করা হচ্ছে। বাহিনীর প্রধান হিসেবে ‘অতি বিশ্বস্ত’ এবং ২০১৪ সাল থেকে নির্বাচনের সময় ‘সেবাগ্রহিতা’ এই দুই কর্মকর্তার কোনো দায়িত্বই এখন সরকার গ্রহণ করছে না। ওয়ান টাইম ব্যবহৃত টিস্যুর মতোই বেনজির, আজিজ, মতিউরদের ছুড়ে ফেলা হচ্ছে। এনবিআরের মতিউর রহমানকে গতকাল এনবিআর ও সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য পদ থেকে ‘তালাক’ দেয়া হয়েছে। পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম শিমুলের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে গত ১৩ মে মাঠে নেমেছে দুদক। এতে মধ্যে তার ও স্ত্রী ফারজানা রহমানের নামে বিপুল পরিমাণ সম্পদের সন্ধান পেয়েছে। গত ৭ মে বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাকাডেমি সারদায় কর্মরত পুলিশ সুপার সুব্রত কুমার হালদারসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে দুদক চার্জশিট দিয়েছে। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের হয়। দুদকে প্রভাব খাটিয়ে দীর্ঘদিন সুব্রত ঝুলিয়ে রেখেছিলেন অনুসন্ধান। শেষ পর্যন্ত কাজ হয়নি কোনো তদবিরে। চলতি বছর ১৭ জানুয়ারি বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার এবং বিচারপতি কাজী ইবাদত হোসেনের ডিভিশন বেঞ্চ জয়পুরহাটের তৎকালীন পুলিশ সুপার মো. নূরে আলম এবং তার সহোদর ডিএমপির সাব-ইন্সপেক্টর সারে আলমের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের নির্দেশ দেয়। আদেশে ৩ মাসের মধ্যে দুই সহোদরের অবৈধ সম্পদের অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে বলেন। গত ৩০ মে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উত্তম কুমার বিশ্বাসের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। ঢাকা মহানগরের সিনিয়র বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন এই আদেশ দেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উত্তম কুমার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। দুদক কার্যালয়ে তাঁকে তলব করা হলেও তিনি দুদকে আসেননি। তাঁকে সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তার বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত।
দুদক সূত্র জানায়, চাকরিরত বেশ কয়েকজন ডিআইজি, পুলিশ সুপার, ওসি, ট্রাফিক ইন্সপেক্টর, সাব-ইন্সপেক্টর, পুলিশ প্রশাসনে কর্মরত কর্মকর্তা, আনসার-ভিডিপি কর্মকর্তাসহ আইনশ্ংখলা বাহিনীর অন্তত দুই শতাধিক কর্মকর্তার একটি ‘শর্টলিস্ট’ ধরে এগোচ্ছে সংস্থাটি। বিভিন্ন জনের দায়েরকৃত অভিযোগ, বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রণয়ন করা হয়েছে এ তালিকা। আনসার-ভিডিপির পরিচালক (অপারেশন্স) সৈয়দ ইফতেহার আলীর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধান চলছে। এছাড়া ইতঃপূর্বে দুদক থেকে দায়মুক্তি প্রাপ্ত ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম, অতিরিক্ত ডিআইজি মো: গাজী মোজাম্মেল হকসহ ১৭ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পুন: অনুসন্ধানেরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে নামে- বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে অর্থপাচারের অভিযোগ ছিল।
অন্যদিকে সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন সচিবের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। পৃথক পৃথক দুর্নীতির অভিযোগে এদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করা হচ্ছে। সুত্রের দাবি, গত ২০১৪ সালে দায়িতত্বে থাকা সাবেক প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব ড. খন্দকার শওকত হোসেন (সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব), স্বাস্থ্য সচিব নিয়াজ উদ্দিন মিঞা (এমএম নিয়াজ উদ্দিন), মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সচিব কে. এইচ. মাসুদ সিদ্দিকী, যুগ্ম-সচিব আবুল কাসেম তালুকদার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (ভারপ্রাপ্ত) সচিব এ. কে. এম. আমির হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব (বর্তমানে বেসরকারিকরণ কমিশনের চেয়ারম্যান) মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান, বিদ্যুৎ সচিব মনোয়ার ইসলাম, অতিরিক্ত সচিব তাপস কুমার রায় ও যুগ্ম-সচিব আনোয়ার হোসেন। এছাড়া বর্তমান স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চু, সাবেক বিদ্যুৎ সচিব মনোয়ার ইসলাম, সাবেক অতিরিক্ত সচিব তাপস কুমার রায় ও সাবেক যুগ্ম-সচিব আনোয়ার হোসেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ড. মো. আবুল কালাম আজাদ,, সাবেক ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমানের একান্ত সচিব (পিএস) আবুল কালাম আজাদ, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও কর্মসংস্থান ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. সায়েদুল ইসলাম সরকার, সাবেক জ্বালানি সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুদক তদন্ত করছে।
বেনজীর দুদকে হাজির হননি, সময়ও চাননি
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হলেও তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) হাজির হননি। তবে তিনি একটি লিখিত বক্তব্য পাঠিয়েছেন। দুদক সূত্র জানিয়েছে, তিনি লিখিত বক্তব্যে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের সম্পদের অনুসন্ধান থেকে অব্যাহতি চেয়েছেন।
দুদক সূত্র আরও জানায়, বেনজীর নিজের নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা সম্পদকে বৈধ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, সম্পদের বৈধতার নথিপত্র তাঁর কাছে রয়েছে।
বেনজীর ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত ২৮ মে তলব করে দুদক। তাঁকে ৬ জুন এবং তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের ৯ জুন দুদকে হাজির হয়ে বক্তব্য দিতে বলা হয়েছিল। অবশ্য ৫ জুন বেনজীর আইনজীবীর মাধ্যমে ১৫ দিন বাড়তি সময় চেয়ে আবেদন করেন। ৪ জুন দুদকের কমিশনার জহুরুল হক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, না এলে ধরে নিতে হবে তাঁর কোনো বক্তব্য নেই।
দুদকের অনুসন্ধানে এখন পর্যন্ত বেনজীর আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের নামে ঢাকায় মোট ১২টি ফ্ল্যাট, বিভিন্ন জেলায় ৬৯৭ বিঘা জমি, ১৯টি কোম্পানির শেয়ার এবং ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, ৩৩টি ব্যাংক হিসাব ও ৩টি বিও হিসাব (শেয়ার ব্যবসার বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) পাওয়া গেছে। এসব সম্পদ জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। আদালতের ওই আদেশ আসার আগেই গত ৪ মে বেনজীর আহমেদ দেশ ছাড়েন।
বেনজীর আহমেদ ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপি ছিলেন। এর আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার ও র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র, যার মধ্যে বেনজীরের নামও ছিল।
আজিজ-বেনজীরকে এমন পিএইচডি কীভাবে দিল বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতি শিক্ষাবর্ষে পিএইচডি ভর্তির যে কেন্দ্রীয় বিজ্ঞপ্তি দেয়, সেখানে স্পষ্ট ভর্তির যোগ্যতায় উল্লেখ আছে, তিন–চার বছর মেয়াদি স্নাতক ও এক বছর মেয়াদি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকতে হবে। চার বছর মেয়াদি পিএইচডির নিয়মিত কোর্সে চাকরিরতদের জন্য কমপক্ষে এক বছরের শিক্ষাছুটি নিয়ে পিএইচডি প্রোগ্রামে যোগদান করতে হবে। আর খণ্ডকালীন কোর্সে ভর্তি হতে গেলে, ছুটি থাকা বাধ্যতামূলক নয়, তবে ‘নিয়োগকর্তার’ অনুমতি নিতে হবে।
কেন্দ্রীয় এই পিএইচডি বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্টে উল্লেখ আছে, ‘পিএইচডি/ডিবিএ গবেষকদের ন্যূনতম দুটি উন্মুক্ত সেমিনারের আয়োজন করতে হবে যেখানে গবেষকদের প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে হবে শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের সামনে।’
এখন প্রশ্ন হলো, বেনজীর আহমেদ ডক্টরেট ডিগ্রি নেওয়ার আগে এসব থিসিস সেমিনারে ঠিক কারা উপস্থিত ছিলেন? ঠিক কতজন শিক্ষক বা শিক্ষার্থী বেনজীর আহমেদের সেমিনার থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন?
ঠিক একই পথে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ। সেনাপ্রধান থাকাকালে ২০২০ শেষের দিকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ‘সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ: আন্তর্দেশীয় ঝুঁকির বিষয়’ গবেষণার জন্য (প্রথম আলো, ২৯ নভেম্বর ২০২০)।
২০১৮ সালের ১৯ জুন দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত খবর বলছে, তিনি ১৯৭৫ সালে ঢাকার মোহাম্মদপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৭৭ সালে এইচএসসি পাস করেন নটর ডেম কলেজ থেকে।
এর আগে ২০২১ সালে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও এর কর্মরত ও সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ মানবাধিকার লঙ্ঘনের। তবে সাবেক সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেন, এই কর্মকর্তা উল্লেখযোগ্য দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁর কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবমূল্যায়ন এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের আস্থা কমেছে। তাঁর বিরুদ্ধে প্রধান দুটি অভিযোগের একটি হলো তিনি তাঁর ভাইকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি এড়াতে সহায়তা করেছেন। তা করতে গিয়ে তিনি নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ রয়েছে।
আজিজ আহমেদ নিজের দায় অস্বীকার করতে গিয়ে বলেছেন, এই নিষেধাজ্ঞা উদ্দেশ্যমূলক এবং সরকারকে হেয় করার জন্য করা করা হয়েছে। তিনি যে ঘটনাকে উদ্দেশ্যমূলক বলেছেন, সেই ঘটনার জন্য কি আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছেন? জানালে সেটা জানার অধিকার জনগণেরও আছে।
বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে যেসব দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ এসেছে, সেটা দুর্নীতি দমন সংস্থা তদন্ত করেছে এবং তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তাঁর ও পরিবারের সদস্যদের সম্পদ জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। বিচার বিভাগ স্বাধীন, দুদক স্বাধীন। সেখানে যদি অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হয় কেউ, আমরা তাকে প্রোটেকশন দিতে যাব কেন? তিনি সাবেক আইজিপি হোন আর সাবেক সেনাপ্রধান হোন। আমাদের দেশের প্রচলিত আইন তাঁদের শাস্তির কাছে সমর্পণ করবে। এ কারণে কোনো প্রকার সরকারের কাউকে প্রোটেকশন দেওয়ার বিষয় নেই।’
আলোচনায় আছাদুজ্জামান মিয়ার বিপুল সম্পদ
নিজের ও পরিবারের নামে জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অস্বাভাবিক পরিমাণ সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে কিছুদিন ধরে ব্যাপক আলোচনায় আছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ। এখন বিপুল সম্পদ অর্জন নিয়ে আলোচনায় এসেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিমএপি) সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। ২০১৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তিনি অবসরে যান।
আছাদুজ্জামান মিয়ার সম্পদ নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয় ঈদুল আজহার আগের দিন রোববার ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকার খবরকে কেন্দ্র করে। ওই খবরে বলা হয়, পুলিশের সাবেক এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার স্ত্রীর নামে ঢাকায় একটি বাড়ি ও দুটি ফ্ল্যাট, ছেলের নামে একটি বাড়ি এবং মেয়ের নামে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের নামে ৬৭ শতক জমি রয়েছে। এই তিন জেলায় তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে রয়েছে আরও ১৬৬ শতক জমি।
মানবজমিন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এল ব্লকের লেন-১-এ ১৬৬ এবং ১৬৭ নম্বরে ১০ কাঠা জমির ওপর সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা আছাদুজ্জামান মিয়ার স্ত্রী আফরোজা জামানের মালিকানায় ছয়তলা একটি বাড়ি রয়েছে। রাজধানীর ইস্কাটনেও আছাদুজ্জামান মিয়ার স্ত্রীর নামে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। আরও একটি ফ্ল্যাট রয়েছে ধানমন্ডিতে। এর বাইরে সিদ্ধেশ্বরীতে আছাদুজ্জামানের মেয়ের নামে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে।
প্রতিবদেন আরও বলা হয়, গাজীপুরের কালীগঞ্জের চাঁদখোলা মৌজায় ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সর্বমোট ১০৬ শতক জমি কেনা হয় আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা জামানের নামে। এ ছাড়া ২০১৮ সালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কৈয়ামসাইল-কায়েতপাড়া মৌজায় আফরোজার নামে ২৮ শতক জমি কেনা হয়। একই বছর একই মৌজায় আরও ৩২ শতক জমি কেনা হয় তাঁর নামে। পূর্বাচলে ১০ কাঠা জমি রয়েছে আছাদুজ্জামান মিয়ার নামে। এ ছাড়া আছাদুজ্জামানের পরিবারের সদস্যদের নামে রাজধানীর আফতাবনগরে ২১ কাঠা জমি রয়েছে। নিকুঞ্জ-১-এ আছাদুজ্জামানের ছোট ছেলের নামেও একটি বাড়ি রয়েছে।
বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, বেনজীর আহমেদ ও আছাদুজ্জামান মিয়ার অস্বাভাবিক সম্পদের মালিকানার বিষয়গুলো সামনে আসায় সবচেয়ে আতঙ্কে আছেন দুর্নীতিতে জড়ানো কর্মকর্তারা।
এনবিআর ও সোনালী ব্যাংক থেকে পদ হারিয়েছেন, নতুন করে অনুসন্ধানে দুদক , নামে-বেনামে এবং স্ত্রী ও সন্তানদের সম্পদের উৎস

সরকারি এক কর্মকর্তার ছেলে কোরবানির জন্য ১২ লাখ টাকায় ছাগল কিনবেন-এই খবরে শোরগোল পড়ে গেছে চারদিকে। বুকসমান উঁচু সেই ছাগলের সঙ্গে নিজের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করেন ইফাত। ৬২ ইঞ্চি উচ্চতার ছাগলটির ওজন ১৭৫ কেজি। এত বড় ছাগল সচরাচর দেখা যায় না। সাদিক অ্যাগ্রো ছাগলটির দাম হেঁকেছিল ১৫ লাখ টাকা। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয় ১২ লাখ টাকায়। এত দামের পেছনে তাদের ব্যাখ্যা ছিল, উন্নত জাত ও বংশমর্যাদা। তবে এক লাখ বুকিং দিলেও ছাগলটি কেনেননি ইফাত। কিন্তু কোরবানির জন্য ১২ লাখ টাকার ছাগল কেনা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের শোরগোলের কারণে দুটি নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে বহুল আলোচিত মুশফিকুর রহমান ইফাত ও ড. মো. মতিউর রহমান। ইফাত ও তার মাতৃকূল ড. মতিউর রহমানকে তার বাবা হিসেবে দাবি করলেও ইফাতকে নিজের ছেলে বলে স্বীকার করেননি ড. মতিউর। অবশ্য ছাগল ছাড়াও এর আগে ইফাতের ৫২ লাখ টাকা দামের গরু কেনা এবং দামি গাড়ি ব্যবহার নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা চলছে। এই ঘটনায় বাবা-ছেলে হিসেবে ইফাত ও মতিউরের যৌথ একাধিক ছবি ভাইরাল হয়েছে। নেটিজেনরা মতিউর রহমানের সম্পদের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। আর ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে বাবা-ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করেছেন মতিউর রহমান। দুর্নীতির অভিযোগ থেকে বাঁচতেই ড. মতিউর সম্পর্ক অস্বীকার করছেন বলে মানুষ মনে করছে। তার বিরুদ্ধে সেই প্রশ্ন তোলার সুযোগও আছে। কারণ, এর আগে দুর্নীতির অভিযোগ পেয়ে চারবার মতিউরের সম্পদের উৎসের অনুসন্ধানে নেমেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কোনোবারই কোনো প্রমাণ পায়নি দুদক। কিন্তু ছাগল-কা-ের পর এবার পঞ্চমবারের মতো অনুসন্ধানে নামছে দুদক।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট ড. মো. মতিউর রহমানের এনবিআর’র সদস্য পদ এবং সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদ হারিয়েছেন। এছাড়া নতুন করে আবার অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। অবশ্য ছাগল কা-ের পর শুধু মতিউরই ফাঁসছেন তা নয়; তার নামে-বেনামে এবং স্ত্রী ও সন্তানদের সম্পদের উৎসও খোঁজা হচ্ছে। একের পর এক বেরিয়ে আসছে মতিউর রহমানের অঢেল সম্পদের তথ্য। মতিউর রহমানের ছেলের দামি ঘড়ি, গাড়ি, আলিশান জীবনযাপন; মতিউর রহমান ও পরিবারের সদস্যদের নামে রিসোর্ট, শুটিং স্পট, বাংলো বাড়ি, জমিসহ নামে-বেনামে সম্পত্তি থাকার বিষয়ে উঠে আসছে। এমনকি উঠে এসেছে মতিউরের প্রথম স্ত্রী একটি সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক লায়লা কানিজ লাকীর অঢেল সম্পদের তথ্য। তিনি কীভাবে এত সম্পদের মালিক হয়েছেন, তা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
সূত্র মতে, কোরবানি উপলক্ষে ১২ লাখ টাকায় ছাগল কিনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত হয়েছেন মুশফিকুর রহমান ইফাত নামের এক তরুণ। তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট ড. মো. মতিউর রহমানের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর ছেলে। তার বাবা মতিউর রহমানের পরিচয় প্রকাশ্যে আসতেই তোলপাড় শুরু, যা এখনো থামছে না। অবশ্য আলোচিত ড. মতিউর শুধুমাত্র এনবিআর’র উর্ধ্বতন কর্মকর্তাই নন; তিনি দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংক সোনালী ব্যাংক পিএলসিরও একজন পরিচালকও। ২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তিন বছরের জন্য তাঁকে সোনালী ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। তখন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ছিলেন শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ। অভিযোগ আছে বড় অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে ওই সময়ে শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ মতিউরকে পরিচালক পদে বসান। আর পরিচালক পদে বসাতে অপর দিক থেকে কলকাঠি নাড়েন বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর এবং তৎকালীন অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদার। নানাবিধ অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ পুনর্নিয়োগ না পেয়ে গত মাসে অবসরে গেছেন। যদিও মতিউরকে পরিচালক পদে বসানো আবদুর রউফ তালুকদার এখনও স্বপদে বহাল আছেন। সূত্র মতে, মতিউর রহমানের সঙ্গে আবদুর রউফ তালুকদারের পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। এছাড়া বিতর্কিত দেশের বেসরকারি একটি শিল্পগোষ্ঠীর সঙ্গেও দীর্ঘদিনর ঘনিষ্ঠতা রয়েছে মতিউরের। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে ওই শিল্পগোষ্ঠীকে অনানুষ্ঠানিকভাবে কর ও ব্যাংকিং বিষয়ে নানা পরামর্শ দিয়ে আসছেন। একই সঙ্গে দুই পরিবার একসঙ্গে বিদেশ সফরও করেছে বলে দুই পরিবারের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে। অপরদিকে গভর্নর এবং সাবেক ব্যাংকিং সচিবের ক্ষমতায় ক্ষমতায়িত হয়ে মতিউর সোনালী ব্যাংকে ঋণ, বদলী ও পদোন্নতীতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। এদিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সুপারিশ ও গভর্নরের তদবির পর সোনালী ব্যাংকের বোর্ড আর ড. মতিউরকে আটকায়নি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকও সহজেই অনুমোদন দিয়ে দেয়। যদিও সূত্র জানিয়েছে, সাম্প্রতিক ছাগল কা-ের পর মতিউর রহমানের সবকিছু উন্মোচিত হতে থাকলে ব্যাংকটির অন্য পরিচালকেরা বেঁকে বসেন। তারা আর মতিউর রহমানকে বোর্ডে চাইছেন না। এই ধারাবাহিকতায় গতকাল রাষ্ট্রায়ত্ত এই ব্যাংকটির বোর্ড সভায় দেখা যায়নি মতিউরকে। সরেজমিনে সোনালী ব্যাংকে গিয়ে দেখা যায়, সকাল সাড়ে ১১টায় বোর্ড সভা শুরু হলেও তিনি এই সভায় আসেননি। এছাড়া সরেজমিনে এনবিআর’র এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আগারগাঁওয়ে অবস্থিত রাজস্ব ভবনের ১১ তলার অফিস কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, তিনি অফিসে আসেননি। তার দপ্তরের কর্মচারীরা জানান, ঈদের পর মতিউর রহমান আর অফিসে আসেননি।
পঞ্চম দফায় অনুসন্ধানে দুদক
আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা মো. মতিউর রহমানের দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য অনুসন্ধানে তিন সদস্যের টিম গঠন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন সংস্থাটির সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন। দুদকের উপপরিচালক আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্ব তিন সদস্যের টিম গঠন করা হয়েছে। গত ৪ জুন দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মইনউদ্দীন আবদুল্লাহর সভাপতিত্বে কমিশন সভায় এনবিআর সদস্য (শুল্ক ও আবগারি) ড. মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়। সূত্র জানায়, দুদকের মহাপরিচালক (মানি লন্ডারিং) মো. মোকাম্মেল হক অভিযোগ তুললে অনুসন্ধানে একটি দল গঠন করতে বলা হয়। এর আগে ২০০৪, ২০০৮, ২০১৩ ও ২০২১ সালে মোট চারবার মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করে দুদক। কিন্তু নথিভুক্তির মাধ্যমে এসব অনুসন্ধানের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করে দুদক। এর অর্থ হলো-অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। পরে মতিউর রহমানকে নিয়ে কমিশন থেমে যায়।
এনবিআর থেকে সরানো হলো
প্রেসিডেন্টের আদেশক্রমে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের উপসচিব মকিমা বেগম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে, বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি) ক্যাডারের কর্মকর্তা কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট মো. মতিউর রহমানকে তার পদ থেকে সরিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে জনস্বার্থে এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে বলেও প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সোনালী ব্যাংক বোর্ড থেকেও বাদ
ছাগলকা-ে আলোচিত এনবিআর সদস্য মো. মতিউর রহমানকে সোনালী ব্যাংকের বোর্ড থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী এ তথ্য জানিয়েছেন। গতকাল বোর্ড সভা শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেন তিনি। জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে আমাদেরকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে- মতিউর রহমান আর সোনালী ব্যাংকের বোর্ড সভায় আসবেন না। সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডের সবাইকে বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী বলেন, সোনালী ব্যাংকের বোর্ড কোনও পরিচালককে নিয়োগ দিতে পারে না, আবার কাউকে বোর্ড থেকে বাদ দিতেও পারে না। ব্যাংকের মালিক হিসেবে সোনালী ব্যাংকের বোর্ডের পরিচালক নিয়োগ দেয় সরকার। আবার কাউকে বাদ দিতে চাইলে সেটাও করে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে আমাদেরকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর কখনও মতিউর রহমান আমাদের বোর্ড সভায় আসবেন না।
মতিউরের প্রথম স্ত্রীর সম্পদের পাহাড়
মুশফিকুর রহমান ইফাতের ছাগল কান্ডে বাবা মতিউর রহমানের পরিচয় প্রকাশ্যে আসতেই তোলপাড় শুরু, যা এখনো থামছে না। একের পর এক বেরিয়ে আসছে মতিউর রহমানের অঢেল সম্পদের তথ্য। এবার প্রকাশ্যে এসেছে তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকীর সম্পদের পাহাড়ের তথ্য। নামে-বেনামে অঢেল সম্পদ গড়েছেন লায়লা কানিজ। একজন সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক হয়ে লায়লা কানিজ লাকী কীভাবে এত সম্পদের মালিক হয়েছেন, তা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
লাকী ছিলেন রাজধানীর তিতুমীর সরকারি কলেজের বাংলা বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক। ২০২৩ সালে কলেজ থেকে অবসরে যান। ২০২৩ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান সাদেকুর রহমান মারা গেলে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে উপনির্বাচনে প্রার্থী হন এবং অবৈধ টাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হন লায়লা কানিজ। জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির তিনি দুর্যোগ, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক। অবৈধ টাকায় তিনি রায়পুরা উপজেলার মরজালে নিজ এলাকায় প্রায় দেড় একর জমিতে ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্ট নামের একটি বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তুলেছেন। তার নির্বাচনী হলফনামা থেকে জানা গেছে, বাৎসরিক আয় বাড়ি-অ্যাপার্টমেন্ট-দোকান ও অন্যান্য ভাড়া থেকে ৯ লাখ ৯০ হাজার, কৃষি খাত থেকে ১৮ লাখ, শেয়ার-সঞ্চয়পত্র-ব্যাংক আমানতের লভ্যাংশ থেকে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৫০০, উপজেলা চেয়ারম্যানের সম্মানি বাবদ ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৭৫, ব্যাংক সুদ থেকে ১ লাখ ১৮ হাজার ৯৩৯ টাকা। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার জমা রয়েছে ৩ কোটি ৫৫লাখ টাকা। তার কৃষিজমির পরিমাণ ১৫৪ শতাংশ, তার অকৃষিজমির মধ্যে রয়েছে রাজউকে পাঁচ কাঠা, সাভারে সাড়ে ৮ কাঠা, গাজীপুরে ৫ কাঠা, গাজীপুরের পুবাইলে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ ও ২ দশমিক ৯০ শতাংশ, গাজীপুরের খিলগাঁওয়ে ৫ শতাংশ ও ৩৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ, গাজীপুরের বাহাদুরপুরে ২৭ শতাংশ, গাজীপুরের মেঘদুবীতে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ, গাজীপুরের ধোপাপাড়ায় ১৭ শতাংশ, রায়পুরায় ৩৫ শতাংশ, ৩৫ শতাংশ ও ৩৩ শতাংশ, রায়পুরার মরজালে ১৩৩ শতাংশ, সোয়া ৫ শতাংশ, ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ ও ৪৫ শতাংশ, শিবপুরে ২৭ শতাংশ ও ১৬ দশমিক ১৮ শতাংশ, শিবপুরের যোশরে সাড়ে ৪৪ শতাংশ, নাটোরের সিংড়ায় ১ একর ৬৬ শতাংশ। এদিকে, মরজাল বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মতিউর রহমান ও লায়লা কানিজ দম্পতির কয়েক কোটি টাকায় নির্মিত আধুনিক স্থাপত্যের ডুপ্লেক্স বাড়ি। বাড়িটির ভেতরে রাজকীয় সব আসবাবপত্র ও দামি জিনিসপত্র রয়েছে।
ইফাতকে নিয়ে দেশ ছেড়েছেন মতিউরের দ্বিতীয় স্ত্রী
ছাগল-কা-ে আলোচিত-সমালোচিত মতিউর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিভলী দুই সন্তান নিয়ে দেশ ছেড়েছেন। মতিউরের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত ও ইরফানকে নিয়ে গত বুধবার মধ্যরাতে মালয়েশিয়া গেছেন শিভলী। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে কুয়ালালামপুর রওনা হন তিনি। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, মতিউরের প্রথম স্ত্রীর পরিবারের সঙ্গে দ্বিতীয় স্ত্রীর পরিবারের দ্বন্দ্ব বহুদিনের। ছাগল-কা-ের সুযোগ কাজে লাগান প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ। তিনি স্বামীকে বোঝাতে সক্ষম হন, ইফাতের পরিচয় অস্বীকার করলেই আপাতত ঝামেলা থেকে রক্ষা পাবেন মতিউর। কানিজের কথাতেই ইফাতকে গণমাধ্যমের কাছে নিজের সন্তান হিসেবে অস্বীকার করেন তিনি।
মতিউরের বিরুদ্ধে দুদকে যত অভিযোগ
দুদক সূত্র বলছে, এনবিআরের সদস্য ড. মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ অনুযায়ী, দেশে একটি গ্রুপ অব কোম্পানিতে দুই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ এবং কানাডায় বাড়ি, দুবাই, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ রয়েছে।
দুদক বলছে, অভিযোগ অনুসন্ধান করে এ পর্যন্ত মতিউর রহমান, তার দুই স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের নামে রাজধানীতে অন্তত ১৫টি ফ্ল্যাট ও তিনটি বাড়ির সন্ধান পেয়েছে। এগুলোর মধ্যে ধানমন্ডিতে একটি, সেগুনবাগিচায় দুটি, শান্তিনগর টুইন টাওয়ারে একটি, লালমাটিয়ায় একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ডি-ব্লকে একটি সাততলা বাড়ি, আই-ব্লকে তার যৌথ মালিকানাধীন ডেভেলপার কোম্পানি জেসিক্সের তত্ত্বাবধানে একটি বহুতল ভবনে অংশ আছে। দুদকের অনুসন্ধানে মতিউর রহমানের মালিকানায় ময়মনসিংহের ভালুকার সিডস্টোর এলাকার পাশে প্রায় ৩০০ বিঘা জমিতে গ্লোবাল ম্যাক্স নামের জুতার কারখানা, রাজধানীর নিকেতনের ৮ নম্বর সড়কে গ্লোবাল ম্যাক্সের প্রধান কার্যালয় এবং চাঁদপুরে একটি গরুর খামার পাওয়া গেছে।
নরসিংদীর রায়পুরার মরজালে ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্টের পরিচালক মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রীর ঘরের দুই সন্তান ফারজানা রহমান ঈপ্সিতা ও আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণব। ফারজানা ও আহমেদ তৌফিকুরের নামে গাজীপুরের পুবাইলের খিলগাঁওয়ে রয়েছে আপন ভুবন পিকনিক ও শুটিং স্পট। সোনাগাজীর সোনাপুরে শ্বশুরবাড়িতে রয়েছে বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি। দুদকের সূত্র বলছে, এনবিআরের এই কর্মকর্তার স্ত্রী-সন্তান ছাড়াও শ্যালক, শ্যালিকা, ভাই ও আত্মীয়স্বজনের নামে- বেনামে সম্পদের তথ্য রয়েছে দুদকের কাছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মতিউর রহমানের দুই পরিবার সাতটি গাড়ি ব্যবহার করে। গাড়িগুলো মতিউর রহমানের স্ত্রী, সন্তান ও গ্লোবাল ম্যাক্স প্যাকেজিংয়ের নামে। গ্লোবাল ম্যাক্স প্যাকেজিংয়ের নামে নিবন্ধিত গাড়িটি ব্যবহার করেন শাম্মী আখতার।
ডাক বিভাগের প্রায় ৫৪১ কোটি টাকার ‘পোস্ট ই-সেন্টার ফর রুরাল কমিউনিটি’ নামের প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির মহোৎসব হয়েছে। সরকারের অগ্রাধিকারের ৫৪১ কোটি টাকার এ প্রকল্প থেকেই ডাক বিভাগের মহাপরিচালক সুধাংশু শেখর ভদ্র অন্তত একশ কোটি টাকা লোপাট করেছেন ।

দেশের বিভিন্ন উপজেলায় ই-পোস্ট অফিস স্থাপনের নামে তিনি এই অর্থ আত্মসাতের পর বিদেশে পাচার করেন। ডিজি সুধাংশু শেখরকে আজ থেকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হচ্ছে।
জালজালিয়াতি বন্ধে ডাকঘরকে ডিজিটাল করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এর অংশ হিসেবে ‘পোস্ট-ই-সেন্টার ফর রুরাল কমিউনিটি’ নামে প্রকল্প নেয়া হয়। এর ব্যয় ধরা হয় ৫৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৬০ কোটি টাকার কোনো হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। জালিয়াতি বন্ধের প্রকল্পেই বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে প্রাথমিক প্রমাণও পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, কাগজপত্রে যেসব জায়গায় ই-পোস্ট অফিস দেখানো হয়েছে, বাস্তবে সেখানে কোথাও জঙ্গল, কোথাও খেলার মাঠ। কোথাও পুরনো ভাঙাচোরা পোস্ট অফিস ঘর।
অথচ অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার ল্যাবসহ ডিজিটাল পোস্ট অফিস স্থাপনের নামে ভদ্র এই দুর্নীতি করেন। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে এসব দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আসছে। এরই মধ্যে ভদ্রসহ তার সিন্ডিকেটের বেশ কয়েকজনকে অভিযোগের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। তবে তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এক সুধাংশু ডাক বিভাগকে পঙ্গু করে দিয়েছে। এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে তিনি হাত দেননি। এমন কোনো খাত নেই, যে খাত থেকে তিনি অর্থ পকেটে ভরেননি। তিনি একা নন। ডাক দফতরে তার অনুগত কয়েকজন কর্মকর্তা নিয়ে সিন্ডিকেট করে তিনি লোপট করেছেন। তারা সবাই এখন দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্তের জালে।
একই ডাকঘরের নাম একাধিকবার লিখে সাড়ে আট হাজার ডাকঘরের তালিকা পূর্ণ করা হয়। নামে-বেনামে খরচ দেখিয়ে প্রকল্পের অর্থ লোপাট করেছেন প্রকল্প পরিচালক সুধাংশু শেখর ভদ্র।

মঙ্গলবার ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় ডাক অধিদফতরের ডিজিকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠায়। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব এসএম তারিকের স্বাক্ষর করা এক প্রজ্ঞাপনে এ আদেশ জারি করা হয়। এতে বলা হয়, ‘সুধাংশু শেখর ভদ্র, মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব), ডাক অধিদফতর, ঢাকাকে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের প্রাথমিক তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর বিধি ৩ মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের স্বার্থে বিধি-১২-এর বিধান অনুসারে আগামী ১১/১১/২০২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ছুটিতে যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হল।’
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তদন্তেও তার দুর্নীতি ধরা পড়েছে। ওই কমিটি ভদ্রকে ডেকে চার ঘণ্টা জেরা করেছে বলে জানা যায়। তিনি কোনো উত্তর দিতে না পারায় তাকে অফিসে যোগদান না করে বাসায় থাকতে বলা হয়। সেই থেকে প্রায় দুই মাস তিনি অফিসও করেননি। মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ তদন্তে ভদ্রের দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। এর আগে করোনা পজিটিভ হওয়া সত্ত্বেও তিনি তা গোপন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সমালোচনার মুখে পড়েন।
ভদ্রের বিরুদ্ধে দুর্নীতির খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, ‘পোস্ট ই-সেন্টার’ প্রকল্পের জন্য কম্পিউটার ও যন্ত্রপাতি কেনায় টেশিসের সঙ্গে পারস্পরিক যোগসাজশ ও সমঝোতা করে তিনি কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের সুযোগ নেন। দুদকের টেবিলে থাকা অভিযোগ থেকে জানা যায়, তার দুর্নীতির প্রক্রিয়াও অভিনব। প্রথমে তিনি তার পছন্দে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান থেকে অত্যন্ত নিুমানের কম্পিউটার ও যন্ত্রপাতি বাজারমূল্য থেকে বেশি দামে ক্রয় করেন। এরপর টেশিস তার লাভ যোগ করে ডাক বিভাগের কাছে বিক্রি করে।
টেশিস যে বিল পরিশোধ করে তা কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই ভদ্র তাদের বিল পরিশোধ করে কমিশন নেন। যেসব যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়েছে তার বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। ভদ্রকে এসব কাজে কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সহায়তা করেন। তাদের মধ্যে কয়েকজনের সম্পৃক্ততা দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।
জানা গেছে, ই-পোস্টাল প্রকল্পের মতো একই প্রক্রিয়ায় প্রকল্পের জন্য বন শিল্প থেকে অত্যন্ত নিুমানের আসবাবপত্র কেনা হয়। তিনজন কর্মকর্তা এসব আসবাবপত্র গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে তাদের ওপর চড়াও হন ভদ্র। তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে নিুমানের আসবাবপত্রগ্রহণ ও প্রত্যয়নপত্র দিতে বাধ্য করেন তিনি।
অনুসন্ধান সূত্র থেকে জানা যায়, এই প্রকল্পের আওতায় পোস্ট অফিসের জন্য সোলার প্যানেল ধরা ছিল। কিন্তু এই খাতেও পুকুরচুরি হয়। সোলার প্যানেল বাজারমূল্যের চেয়ে চার গুণ বেশি দামে কেনা হয়। এই খাতের জন্য সার্ভার, সিপিইউ, ইউপিএস’সহ কিছু টেকনিক্যাল সামগ্রী আলাদা করে বরাদ্দ থাকলেও পুরো টাকাই মেরে দেয় ভদ্র ও তার সিন্ডিকেট। বিষয়টি জানাজানি হলে পরিকল্পনা কমিশন ও অডিট বিভাগ থেকে তদন্ত করা হয়। তখন তিনি তড়িঘড়ি করে পেছনের তারিখ দিয়ে বরাদ্দের কিছু মালামাল সরবরাহ দেখান, যা কিছুদিন পরই নষ্ট হয়ে যায়।
এই প্রকল্পের আওতায় আরেকটি বড় দুর্নীতি হয়েছে ভবন নির্মাণ ও মেরামতে। ভদ্র এই কাজে তার অনুগত একাধিক কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেন। এ পর্যায়ে পরস্পর বোঝাপড়ার মাধ্যমে কারসাজির টেন্ডারে সিন্ডিকেটকে কাজ দেয়া হয়।
এই কাজ থেকে ভদ্র এবং তার পছন্দের কর্মকর্তারা মোটা অঙ্কের কমিশন নিয়ে নেন ঠিকাদারের কাছ থেকে। চট্টগ্রাম ও খুলনা সার্কেলে এখনও ভবন নির্মাণ না হলেও টাকা তুলে নিয়ে গেছেন তারা। ডাক বিভাগের সদর দফতর নির্মাণ ও সংস্কারে ৯৯ কোটি টাকার কাজ এবং কর্মচারীদের জন্য ৪০০ কোটি টাকার ৮টি বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ বর্তমানে চলমান।
ভদ্রের কারসাজিতে একটি প্রতিষ্ঠানই দুটি কাজ পেয়েছে। ২০ ভাগ কমিশন নিয়ে কার্যাদেশ দিয়েছেন বলে প্রকল্পের একজন কর্মকর্তা জানান। দুদকের অনুসন্ধানেও এমনই তথ্য বেরিয়ে আসছে।
চক্রটি নোট কাউন্টিং মেশিন ও ফ্রাংকিং মেশিন টেশিসের কাছ থেকে ক্রয় দেখায়। অথচ টেশিস এসব মেশিন তৈরিই করে না। অথচ এক লাখ টাকার মেশিনের বিল ধরা হয় ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
পোস্টাল ক্যাশ কার্ড প্রকল্প থেকেও চক্রটি কয়েক কোটি টাকা মেরে দেয়। এই প্রকল্পের আওতায় প্রথমে সব ডাকঘরসহ উপজেলা ও সাব পোস্ট অফিসে ‘পিওএস’ মেশিন সাপ্লাই দেয়া হয়। বাস্তবে এই ক্যাশ কার্ড দিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো লেনদেন কোথাও হয়নি। জনগণও জানে না এমন একটি প্রকল্পের সেবার কথা। অর্থ পকেটে তোলার জন্যই ৯ হাজার ৫০০ ‘পিওএস’ মেশিন কেনা হয়। এসব মেশিন ২/৩ বছর পোস্টাল ডিভিশনে বাক্সবন্দি অবস্থায় পড়ে আছে।
এই সার্ভিসটির সঙ্গে ডাক বিভাগের পার্টনার আইটিসিএল নামক একটি প্রতিষ্ঠান। যোগসাজশ করে ভদ্র প্রথমে ক্যাশ কার্ডে ভুয়া জমা দেখান। এই খাতে জিপিও থেকে ঠিকাদারের নিয়োজিত প্রতিনিধির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা উঠিয়ে নেয়া হয়। বিষয়টি জানাজানি হলে অস্বাভাবিক লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। পরে পরীক্ষা করে দেখা যায়, যে পরিমাণ অর্থ কার্ডে জমা হয়েছে, তার চেয়ে ২০ কোটি টাকারও বেশি অঙ্কের অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে।
দুদকের উপপরিচালক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি টিম সুধাংশুর বিরুদ্ধে যত অভিযোগ আছে অনুসন্ধান করছে। অনুসন্ধানে অভিযোগের বিষয়ে সত্যতাও মিলেছে বলে জানা যায়। সুধাংশু ছাড়াও প্রকল্প ও ডাক বিভাগের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। টিমের একজন কর্মকর্তা জানান, পোস্ট ই-সেন্টার প্রকল্পে অনিয়ম সবচেয়ে বেশি হয়েছে। কোটি কোটি টাকা তছরুপ করেছেন ভদ্র ও তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা।
এছাড়া ডাক অধিদফতরের সদর দফতর নির্মাণে দুর্নীতি, টেশিসের সঙ্গে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি, সোলার প্যানেল ক্রয়প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং পোস্টাল ক্যাশ কার্ড বাস্তবায়নে আইটিসিএল ও থার্ড ওয়েভ টেকনোলজি নামক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশ করে চুক্তি ও ক্রয়প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। এর বাইরে ডাক বিভাগে অন্তত ৩০০ লোক নিয়োগে ভদ্রের বিরুদ্ধে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগও অনুসন্ধানে রয়েছে।
সূত্র জানায়, ডাক বিভাগের কর্মীদের একটি অংশ নামে-বেনামে হিসাব খুলে একটি পাস বই নেন। এতে তারা টাকা জমা না করেই বিভিন্ন অঙ্কের অর্থ এন্ট্রি করেন। পরে তারাই সেগুলো লেজারে যুক্ত করেন।
এই প্রক্রিয়ায় মেয়াদ শেষে বা মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই টাকা তুলে নেন। এভাবে অর্থ আত্মসাৎ করা হচ্ছে। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, ডাক বিভাগের যে কোনো অফিসে কোনো জালিয়াতি বা অর্থ আত্মসাতের ঘটনা উদ্ঘাটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে জানানোর বিধান রয়েছে। কিন্তু এসব ঘটনা তারা তাৎক্ষণিকভাবে মন্ত্রণালয়কে জানাচ্ছে না। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক এসকে মণ্ডল যুগান্তরকে বলেন, সুধাংশু ভদ্র এই বিভাগকে ডুবিয়েছে। এমন কোনো দুর্নীতি নেই, যা তাকে দিয়ে হয়নি। আমি নিজে তার এসব ঘটনা জানিয়ে দুদকে ডিও লেটার দিয়েছি। ওখানে কী হয়েছে জানি না।
সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাটের কে এই পি কে হালদার, কী তাঁর ‘কীর্তি’
সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাটের জন্য দেশের আর্থিক খাতে আলোচিত নাম প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার। তিনি একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও একটি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তা ছিলেন। আবার দেশের আর্থিক খাতের শীর্ষ দখলদার ও খেলাপিদের একজন। এমন চরিত্রের আর একজনকেও এ দেশে পাওয়া যায়নি।
পি কে হালদারের জন্ম পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার দিঘিরজান গ্রামে। বাবা প্রয়াত প্রণনেন্দু হালদার ও মা লীলাবতী হালদার। তাঁর মা ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক।

হাজার কোটির বেশি টাকা আত্মসাৎ করে দেশ থেকে চলে যাওয়া প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার
প্রতিষ্ঠানগুলো দখলের সময় পি কে হালদার প্রথমে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স এবং পরে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন। আর এসব কাজে তাঁকে সব ধরনের সমর্থন ও সহায়তা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন—এই দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখের সামনেই সবকিছু ঘটেছে। প্রতিষ্ঠান দখল করার জন্য নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলেছেন, শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনেছেন, দখল করা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের নামে টাকাও সরিয়েছেন। এমনকি দেশের বাইরেও কোম্পানি খোলেন।
২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে যখন তাঁর দখল করা আর্থিক প্রতিষ্ঠঅনগুলো গ্রাহকের টাকা ফেরত দিয়ে ব্যর্থ হতে শুরু করে, তখন পি কে হালদার ভারতে পালিয়ে যান। পরে বসবাস শুরু করেন কানাডা ও সিঙ্গাপুরে। এরপর আবার চলে আসেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সব শেয়ার অন্যদের নামে হলেও ঘুরেফিরে আসল মালিক পি কে হালদারই। নিজেকে আড়ালে রাখতে এমন কৌশল নেন তিনি। নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে পি কে হালদার গড়ে তুলেছেন একাধিক প্রতিষ্ঠান, যার বেশির ভাগই কাগুজে।
এর মধ্যে রয়েছে পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল, পিঅ্যান্ডএল অ্যাগ্রো, পিঅ্যান্ডএল ভেঞ্চার, পিঅ্যান্ডএল বিজনেস এন্টারপ্রাইজ, হাল ইন্টারন্যাশনাল, হাল ট্রাভেল, হাল ট্রিপ, হাল ক্যাপিটাল, হাল টেকনোলজি অন্যতম। এর বাইরে আনন কেমিক্যাল, নর্দান জুট, সুখাদা লিমিটেড, রেপটাইল ফার্মসহ অনেক প্রতিষ্ঠান।
কাগজে-কলমে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় আছেন পি কে হালদারের মা লীলাবতী হালদার, ভাই প্রীতিশ কুমার হালদার ও তাঁর স্ত্রী সুস্মিতা সাহা, খালাতো ভাই অমিতাভ অধিকারী, অভিজিৎ অধিকারীসহ বিভিন্ন আত্মীয়। আবার ব্যাংক এশিয়ার সাবেক এমডি ইরফানউদ্দিন আহমেদ ও সাবেক সহকর্মী উজ্জ্বল কুমার নন্দীও আছেন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানায়।