• ৫ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ২০শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ৩রা জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

বিচার বিভাগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা প্রধান বিচারপতির , ফ্যাসিবাদের দোসর বিচারক এখনো গুরুত্বপূর্ণ পদে: অ্যাটর্নি জেনারেল

usbnews
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৪
বিচার বিভাগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা প্রধান বিচারপতির , ফ্যাসিবাদের দোসর বিচারক এখনো গুরুত্বপূর্ণ পদে: অ্যাটর্নি জেনারেল
নিউজটি শেয়ার করুনঃ

বিচার বিভাগে যে কোনো প্রকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ।সারাদেশের বিচারকদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের দেয়া অভিভাষণে তিনি আজ এ কথা বলেন।

অভিভাষণ অনুষ্ঠানে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের বিচারপতিগণ, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান আপিল বিভাগের প্রাক্তন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মোঃ গোলাম রব্বানী, সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রির কর্মকর্তাবৃন্দ ও সারাদেশ থেকে আসা দুই হাজার বিচারক উপস্থিত ছিলেন।

প্রধান বিচারপতি অভিভাষণে বিচার বিভাগের জন্য একটি রোডম্যাপ তুলে ধরেন। ১৭ পৃষ্ঠায় দেয়া অভিভাষণে প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতসহ বিভিন্ন বিষয় ও পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহিদদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালনের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমদ ভূঞা। বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা আধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল ও এটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।
প্রধান বিচারপতি শ্রদ্ধার সাথে ২০২৪ সালের গণবিপ্লবে আত্মদানকারী শহিদদের স্মরণ করেন, যাঁরা জাতিকে এক নতুন বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন।

তিনি বলেন, যতদিন বাংলাদেশের অস্তিত্ব থাকবে ততদিন শহিদ আবু সাঈদ, মীর মাহবুবুর রহমান মুগ্ধ, বাবার কোলে নিহত ছয় বছরের শিশু রিয়া গোপ, ওয়াসিম আকরামসহ ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সকল শহিদকে এদেশের মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী অসংখ্য অকুতোভয় শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন তিনি।

প্রধান বিচারপতি বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসের পথ পরিক্রমা পর্যবেক্ষণ করলে দেখতে পাব বাংলার ইতিহাস মূলত অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ইতিহাস। বাংলার মানুষের লালিত শাশ^ত ন্যায়বোধের চেতনা বিভিন্ন সময়ে শাসন, শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিরতিহীন নানা সংগ্রামে অনুরণিত হয়েছে; যার চূড়ান্ত পরিণতিতে লাখো প্রাণের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আসে কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা।

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘রাষ্ট্রব্যবস্থার এক যুগ-সন্ধিক্ষণে আমাকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে। আমি বিশ^াস করি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের জন্য যে কঠিন বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব ছাত্র-জনতার এই বিপ্লবের কারণে আমার উপর অর্পিত হয়েছে, সেই দায়িত্ব সততা, দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ আপনারা।’

তিনি বলেন,‘বিগত বছরগুলোতে বিচার বিভাগের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। ন্যায় বিচারের মূল্যবোধকে বিনষ্ট ও বিকৃত করা হয়েছে। শঠতা, বঞ্চনা, নিপীড়ন ও নির্যাতনের হাতিয়ার হিসাবে বিচার বিভাগকে ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়েছে। এতে বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। অথচ বিচার বিভাগের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা হচ্ছে মানুষের আস্থা ও বিশ^াস। তাই নতুন এই বাংলাদেশে আমরা এমন একটি বিচার বিভাগ গড়তে চাই যেটি বিচার এবং সততা ও অধিকারবোধ এর নিশ্চয়তার একটি নিরাপদ দূর্গে পরিণত হবে।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, কেন বিচার বিভাগের ছন্দপতন হয়েছিল, কী কী বিষয় এর জন্য দায়ী। এই পথে কী কী প্রতিবন্ধকতা আছে, সেগুলো আমাদের চিহ্নিত করতে হবে। তারপর আমাদের কাছে কী কী জনসম্পদ ও অবকাঠামোগত সুবিধা-অসুবিধা রয়েছে তা নতুন করে মূল্যায়ন করতে হবে এবং এই জাতীয় দুর্বিপাক থেকে উত্তরণপূর্বক একটি জনমুখী আইন ব্যবস্থা ও বিচার কাঠামো বির্নিমাণে করণীয় সম্পর্কে একটি পরিষ্কার রোডম্যাপ প্রস্তুত করতে হবে।

 

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই যে, বিদ্যমান সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রধান সমস্যা হচ্ছে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ কার্যকররূপে পৃথক না হওয়া। এর কুফল আমরা সবাই ভোগ করেছিলাম গত দেড় দশক ধরে। এছাড়াও আছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, মামলা অনুপাতে বিচারকের নিদারুণ স্বল্পতা, বার ও বেঞ্চের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাবের ঘাটতি, আদালতগুলোর অবকাঠামোগত সংকট, অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোন যৌক্তিক
ও গ্রহণযোগ্য নীতিমালা না থাকা, উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ, স্থায়ীকরণ ও উন্নীতকরণের ক্ষেত্রে কোন আইন না থাকা ও প্রথাগত জ্যেষ্ঠতার নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন ইত্যাদি বিষয়গুলো ; যা আমাদের বার বার পিছিয়ে দিয়েছে।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, একটি ন্যায়ভিত্তিক বিচারব্যবস্থার কাজ হলো নিরপেক্ষভাবে, স্বল্প সময় ও খরচে বিরোধের মীমাংসা নিশ্চিত করে জনগণ, সমাজ ও রাষ্ট্রকে সুরক্ষা দেয়া। এ জন্য বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা থেকে পৃথক ও স্বাধীন করা সবচেয়ে জরুরি। কেননা শাসকের আইন নয়,বরং আইনের শাসন নিশ্চিত করাই বিচার বিভাগের মূল দায়িত্ব।

প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচার বিভাগ যেন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে তার জন্য জরুরি ভিত্তিতে বিচার বিভাগে কিছু সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতা কামনা করছি। এই সংস্কারের উদ্দেশ্য হবে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে তা দ্রুত দূর করে একটি স্বাধীন, শক্তিশালী, আধুনিক, দক্ষ ও প্রগতিশীল বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা।

প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের স্বার্থে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন একান্ত আবশ্যক। বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৬ক অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতের বিচারকগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন মর্মে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বিচারকদের প্রকৃত স্বাধীনতা ততদিন পর্যন্ত নিশ্চিত হবে না; যতদিন না বিচার বিভাগে দীর্ঘ দিন ধরে বিরাজমান দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা, অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ এখতিয়ার সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। এটি হবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকল্পে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রথম ধাপ।

তিনি বলেন, সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট বিভাগের অধস্তন সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালের উপর হাইকোর্ট বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা থাকবে মর্মে উল্লেখ রয়েছে। এই অনুচ্ছেদেও বুনিয়াদে সংবিধানের কোনো সংশোধন না করেই শুধুমাত্র রুলস অফ বিজনেস এবং বিচারকদের নিয়োগ, কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, বরখাস্তকরণ, শৃঙ্খলা বিধান ইত্যাদি সংক্রান্ত রাষ্ট্রপতি প্রণীত যে সকল বিধিমালা প্রচলিত রয়েছে সেগুলোতে প্রদত্ত ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ’ এর সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনে সেখানে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় এর সচিবকে অন্তর্ভুক্ত করলেই সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় তথা বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পথে আইনগত কোনো বাধা থাকবে না।

প্রধান বিচারপতি বলেন, জেলা আদালতসমূহের বাজেট বরাদ্দের বিষয়টিও তখন বিচার বিভাগীয় সচিবালয় হতেই নিশ্চিত করা হবে। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন সচিবালয় এবং জাতীয় সংসদ সচিবালয় এর ন্যায় বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তাব প্রস্তুত করা হয়েছে, শীঘ্রই তা আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করবো। এই প্রস্তাব বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রধান উপদেষ্টা এবং আইন উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন প্রধান বিচারপতি। বর্তমান সময়ই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের শ্রেষ্ঠ সময় বলে গুরুত্বারোপ করেন প্রধান বিচারপতি।

প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পর বিচার বিভাগে গুণগত পরিবর্তন আনয়নে অন্যতম কাজ হবে বিচারকগণের যোগ্যতার ভিত্তিতে পদায়ন নিশ্চিত করা। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ঊর্ধ্বে উঠে কর্মরত বিচারকদের মধ্য থেকে সৎ, দক্ষ, স্বাধীন মনোভাব ও নেতৃত্বদানের গুণাবলী সম্পন্ন উপযুক্ত বিচারকদের নিয়ে প্যানেল বা ফিট লিস্ট তৈরি করে সে প্যানেল থেকে প্রতিষ্ঠান প্রধান, যেমন-জেলা জজ, দায়রা জজ, সিজেএম, সিএমএম পদে নিয়োগ প্রদানের ব্যবস্থা করা। বর্তমানে বিচারকগণের পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো ঘোষিত নীতিমালা নেই। ফলে পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনেক সময়ই বিচারকগণ বৈষম্যের শিকার হন। এ বিষয়ে একটি যথোপযুক্ত নীতিমালা দ্রুত প্রণয়ন করা হবে।

প্রধান বিচারপতি বলেন, সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হিসেবে পালন করেছে। এটি ন্যায় বিচারের ধারণার সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।

প্রধান বিচারপতি বলেন, স্বাধীন বিচার বিভাগের অন্যতম শর্ত হচ্ছে বিচার বিভাগের আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ। এ উদ্দেশ্যে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে জেলা আদালতসমূহের জন্য সরকারকে স্বতন্ত্র বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট বিচার বিভাগের উন্নয়ন ও পরিচালন বাবদ যে বাজেট চাইবে সরকারকে তা প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে মাসদার হোসেন মামলায় প্রদত্ত ১২ দফা নির্দেশনা মানা হয়নি।

প্রধান বিচারপতি বলেন, মাঠ পর্যায়ে বিচার বিভাগের কার্যকর পৃথকীকরণ নিশ্চিতকল্পে বিচারকগণের পৃথক আবাসন, পরিবহন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। এই বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত সমাধান করার জন্য আইন উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।

প্রধান বিচারপতি বলেন, মামলাজট বিচার বিভাগের একটি বড় সমস্যা হিসেবে সব আমলেই চিহ্নিত হয়ে এসেছে।বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ৪২ লাখ মামলা বিচার নিষ্পত্তির জন্য অপেক্ষমান আছে। মামলাজট নিয়ে সুধীমহলে অনেক ক্ষোভ রয়েছে। কিন্তু এটি মুদ্রার একটি পিঠ। মুদ্রার অন্য পিঠটা কখনো খুব বেশি আলোচনায় আসে না। মুদ্রার অন্য পিঠে আছে স্বল্প সংখ্যক লোকবল, এজলাস সংকট তথা অবকাঠামোগত অসুবিধাসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতা। কিন্তু এর মধ্যেও মাত্র দুই হাজার বিচারক এক বছরে গড়ে ১০ লাখের বেশি মামলা নিষ্পত্তি করছেন। এই সংখ্যা প্রমাণ করে মামলাজটের কারণ বিচার বিভাগ বা বিচারকগণ নন। বরং মামলা জটের অন্যতম কারণ হচ্ছে মামলার তুলনায় বিচারকের সংখ্যার অপ্রতুলতা। বর্তমান বাস্তবতায় বিচার বিভাগকে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হলে সমগ্র বিচার বিভাগের সাংগঠনিক কাঠামো বা অর্গানোগ্রাম সংস্কার করে দেশের জনসংখ্যা ও মামলার সংখ্যা অনুপাতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন।

প্রধান বিচারপতি বলেন, ফৌজদারি মামলার তদন্ত কাজ যেন দীর্ঘ দিন ঝুলে না থাকে, পুলিশকে সে ব্যাপারে আন্তরিক হতে হবে। আমরা দেখেছি চাঞ্চল্যকর সাগর-রুনী হত্যাকান্ডের তদন্ত রিপোর্ট প্রদানের জন্য ইতোমধ্যে ১১১ বার সময় নেয়া হয়েছে। এটা কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। তদন্ত কাজেই যদি একাধিক বছর সময় লেগে যায়, সে মামলার বিচারকাজ পরিচালনা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। কেননা সময়ের আবর্তে মামলার অনেক সাক্ষী ও সাক্ষ্য হারিয়ে যায়।

তিনি বলেন, বিচার কাজে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বিচারের গতি ও মানকে অনেক উন্নত করতে পারে। সরকারের অন্যান্য অনেক বিভাগে ইতোমধ্যে দাপ্তরিক কাজকর্ম ডিজিটাল পদ্ধতিতে করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের পিছিয়ে থাকা সমীচীন নয়। বিচার বিভাগকে ডিজিটাইজড করার জন্য দ্রুত ই-জুডিসিয়ারি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। আমরা সেই ২০১৫ সাল হতে ই-জুডিসিয়ারি প্রকল্পের কথা শুনে আসছি। কিন্তু এ বিষয়ে নিয়মিত বিরতিতে কিছু আমলাতান্ত্রিক আশ^াস প্রদান ব্যতিরেকে ই-জুডিসিয়ারি বাস্তবায়নে কোনো আন্তরিক প্রচেষ্টা বা কার্যকর উদ্যোগ কখনোই দৃশ্যমান হয়নি। প্রধান বিচারপতি বিচারকদের উদ্ধেশ্য করে বলেন, আমি বিশ^াস করি আপনারা আপনাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি উজ্ঝল করবেন, মানুষের হারিয়ে যাওয়া আস্থা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবেন।
সুপ্রিম কোর্টের ইনার গার্ডেনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিচারকদের পক্ষ থেকে বক্তৃতা রাখেন নওগাঁর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বিশ্বনাথ মন্ডল ও খুলনার জেলা ও দায়রা জজ মাহমুদা খাতুন। তারা দেশব্যাপী নিম্ন আদালতে বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেন। পাশাপাশি সংস্কারের পরামর্শও তুলে ধরেন।

 

বিগত সময়ে যেসব বিচারক ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে মানুষের অধিকার হরণে ভূমিকা পালন করেছেন, তারা এখনো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। এ বিষয় চলমান থাকলে জাতির কাছে ভুল মেসেজ যাবে। শনিবার বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে প্রধান বিচারপতির দেয়া অভিভাষণ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান এ কথা বলেন।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বিচার বিভাগের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দুর্নীতি। যা অর্থনৈতিক কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি হতে পারে। জাতি প্রত্যাশা করে, বিচার বিভাগ যেকোনো ধরনের দুর্নীতি কিংবা সিন্ডিকেটমুক্ত থাক। দুর্নীতির প্রচলিত ধারণা অর্থনৈতিক লেনদেন বুঝালেও, বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি ডিনামাইটের চেয়েও ধ্বংসাত্মক। অ্যাটম বোমার চেয়েও ভয়াবহ। ক্যান্সারের চেয়েও মরণঘাতী। সুতরাং শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে বিচার বিভাগের সব স্তর থেকে দুর্নীতি দূরীকরণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নৈতিক দায়িত্ব ও বড় চ্যালেঞ্জ বলে আমি বিশ্বাস করি। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, বিগত সময়ে যেসব বিচারক ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে মানুষের অধিকার হরণে ভূমিকা পালন করেছেন, তারা এখনো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ পদে (পোস্টিং) রয়েছেন। এ বিষয় চলমান থাকলে জাতির কাছে ভুল মেসেজ যাবে। আইন উপদেষ্টা ও প্রধান বিচারপতির অফিসকে এ বিষয়ে যথাযথ সতর্ক থাকার জন্য বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বিচারকদের প্রয়োজনীয় সমস্যা দূরীকরণেও আইন উপদেষ্টা ও প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা।

অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, মামলা দায়েরে ভিকটিম ফ্যামিলি কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইনের গণ্ডি অতিক্রম করেছে বলে আমরা লক্ষ্য করেছি। এ বিষয়ে আমি উদ্যোগ নিয়ে জনমনে ভীতি দূর করতে আমার শিক্ষকদের কাছে আহ্বান রাখার ফলে সরকারের কাছে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করেছিলাম আমার অফিস থেকে। তার একটি ছিল মামলা হওয়া মানেই গ্রেপ্তার নয়। এর ফলে জনমনে অনেক স্বস্তি ফিরে এসেছে ইতিমধ্যেই।

অ্যাটর্নি জেনারেল একটি গণমাধ্যমের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, বিগত দেড় দশক সময়ে খুন, গুম, হামলা, মামলা, দমন, পীড়ন ও লুটপাটের মাধ্যমে নাগরিকদের ন্যূনতম মানবাধিকার কিংবা ভোটের অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। দেশি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্যানুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৩৬ জুলাই পর্যন্ত চার হাজারের বেশি মানুষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। ৭শ’র বেশি মানুষ গুমের শিকার হয়েছে। ৬০ লক্ষাধিক মানুষ গায়েবি মামলার আসামি হয়েছিল। কথা বলার স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশের স্বাধীন ও মৌলিক অধিকারগুলো হরণের মাধ্যমে বিরোধী মত দমনের নিকৃষ্টতম ইতিহাস রচিত হয়েছিল। সেই দুঃসময়ে আমাদের বিচার বিভাগ ন্যায়বিচারের ধারা তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন। হয় দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন, নয় তো নতজানু অবস্থান নিয়েছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে। যা আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি।