জাতিসংঘের সাধারণ সভায় যোগ দিতে শনিবারই নিউইয়র্কের মাটিতে পা রাখেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আর সেখানে তার পা রাখার আগেই দিল্লির অস্বস্তি বাড়ালেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কার্যালয় হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা।
মোদির পা রাখার ঠিক কয়েক ঘন্টা আগে খলিস্তানপন্থী শিখ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তারা। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, ওই বৈঠক দিল্লির জন্য যথেষ্টই অস্বস্তিদায়ক। প্রবাসী ভারতীয়রা মনে করছেন, বাংলাদেশের পদচ্যূত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেয়ার কারণেই মোদি সরকারের বিরুদ্ধে বদলা নিচ্ছে বাইডেন প্রশাসন।
ইতিমধ্যেই আমেরিকায় পৌঁছেছেন মোদী। ফিলাডেলফিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবাসী ভারতীয়দের সঙ্গে দেখাও করেন। দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ রবিবার চতুর্দেশীয় অক্ষের (কোয়াড) বৈঠকে অংশগ্রহণ করবেন তিনি। পাশাপাশি মার্কিন বহুজাতিক সংস্থার সিইও’দের সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি। আর সোমবার জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ভাষণ দেবেন।
তবে চলতি সফরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে আলাদা করে বৈঠক করছেন না ভারতের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী আসার আগেই বাইডেন প্রশাসন যেভাবে খলিস্তানপন্থীদের সঙ্গে বৈঠকে বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা রাজনৈতিকভাবে যথেষ্টই তাৎপর্যপূর্ণ।
সূত্রের খবর, ওই বৈঠকে হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী খলিস্তানপন্থীদের ‘সুরক্ষা’ দেয়ার পূর্ণ আশ্বাস দিয়েছেন। স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, মার্কিন মাটিতে বিদেশি কোনও শক্তি (পড়ুন মোদি সরকার) যাতে খলিস্তানিপন্থীদের উপরে কোনও হামলা শানাতে না পারে তা সুনিশ্চিত করা হবে।
উল্লেখ্য, খলিস্তানি নেতা তথা শিখ ফর জাস্টিসের প্রধান গুরপতবন্ত সিং পান্নুনের উপরে ভারতের নিযুক্ত পেশাদার খুনি হামলা চালানোর চেষ্টা চালিয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। পান্নুনকে হত্যা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে নিখিল গুপ্তা নামে এক ভারতীয়কে চেক প্রজাতন্ত্রে আটক করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অভিযুক্ত নিখিল ওরফে নিক গুপ্তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হয়েছে।
কিছু শিখ আলাদা রাষ্ট্র চাইছেন কেন সেই ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায় ,
ভারতের শিখদের আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের নাম – খালিস্তান মুভমেন্ট বা খালিস্তান আন্দোলন।
ভারত থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র ‘খালিস্তানের’ দাবিতে আন্দোলন করে আসছে ভারতের পাঞ্জাবের অন্যতম নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী শিখ সম্প্রদায়। ৮০ দশকের দিকে সেই আন্দোলন দমনে ভারত সরকার হাজার হাজার শিখ বিদ্রোহীকে হত্যা করেছিল। তাদের সেই আন্দোলন সেখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। এরপর পেরিয়ে গেছে দীর্ঘ সময়। শিখদের পৃথক মাতৃভূমির স্বপ্নকে পুনরায় পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছেন খালিস্তানপন্থী নেতা অমৃতপাল সিং।
অমৃতপাল সিং বারবার প্রকাশ্যেই বলেছেন তিনি খালিস্তানপন্থী নেতা ‘জার্নেল সিংহ ভিন্দ্রানওয়াল’ কাছে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। ভারতীয় গোয়েন্দা সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে, নিহত ‘গুরুর’ মতোই পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পাঞ্জাবজুড়ে অশান্তি বাধানোর ছক কষেছিলেন ‘ওয়ারিশ পাঞ্জাব দে’ সংগঠনের এই নেতা।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এমন প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে বহুবার।
ভারতের পাঞ্জাবে ১৯৮০-র দশকে এ আন্দোলন উত্তাল হয়ে উঠেছিলো। এর জের ধরে অনেক সহিংসতা হয়েছিলো এবং মৃত্যু হয়েছিলো হাজারো মানুষের।
কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিশেষ অভিযানের পর এ আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গিয়েছিলো। ওই আন্দোলনের পর আধুনিক পাঞ্জাবের রাজনীতির গতি প্রকৃতিতে পরিবর্তন আসে। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর শ্রুতি কাপিলা বলছেন যে এখন আর স্বাধীনতা আন্দোলন সংখ্যাগরিষ্ঠ শিখদের অবস্থান নয়। তবে বিদেশে অভিবাসী শিখদের একটি অংশ আলাদা রাষ্ট্রের দাবিতে তাদের প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলো এটি কিছুটা জোরদার হয়েছে।
উল্লেখ্য, ‘খালিস্তান’ দক্ষিণ এশিয়ার পাঞ্জাব অঞ্চলে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রস্তাবিত একটি স্বতন্ত্র ও সার্বভৌম দেশ। প্রস্তাবিত রাষ্ট্রকে ভূখণ্ডগতভাবে ভারতীয় পাঞ্জাব রাজ্য থেকে শুরু করে বৃহত্তর পাঞ্জাব অঞ্চল পর্যন্ত অথবা প্রতিবেশী ভারতীয় রাজ্যসমূহকেও অন্তর্ভুক্ত করে সংজ্ঞায়িত করা হয়। পাঞ্জাব অঞ্চল শিখদের ঐতিহ্যগত মাতৃভূমি। ইংরেজ দ্বারা অধিকৃত হবার আগে পাঞ্জাব শিখদের দ্বারা ৮২ বছর শাসিত হয়; ১৭৬৭ থেকে ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত সমগ্র পাঞ্জাব শিখ মিসল (সার্বভৌম শিখ রাষ্ট্র) সমূহের অধীন ছিল, তারপর মহারাজা রণজিৎ সিং শিখ মৈত্রী সঙ্ঘকে শিখ সাম্রাজ্যের মাঝে একীভূত করেন।
সেখানে শিখদের পাশাপাশি অনেক হিন্দু ও মুসলিমও বসবাস করত। ১৯৪৭ সালের আগে শিখরা ব্রিটিশ অখণ্ড পাঞ্জাব রাজ্যের শুধুমাত্র লুধিয়ানা জেলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে মুসলিম লীগ যখন মুসলিমদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবি জানায়, তখন কিছু শিখ নেতা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন যে হিন্দু ও মুসলিমের ভিত্তিতে ভারত বিভাজিত করলে শিখ সম্প্রদায়ের কোনো স্বাধীন মাতৃভূমি থাকবে না। তারা তখন বৃহত্তর পাঞ্জাব অঞ্চলে বিস্তৃত খালিস্তান নামক একটি ধর্মরাষ্ট্র সৃষ্টির ধারণা পেশ করেন। তখন থেকে এই আন্দোলনের সূত্রপাত।
স্বর্ণ মন্দিরে অভিযান এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী হত্যা –
১৯৮৪ সালের জুনে শিখদের পবিত্রস্থান স্বর্ণ মন্দিরে অভিযান চালায় ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং সেখানে আশ্রয় নেয়া বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উচ্ছেদ করে।
এর জের ধরে অনেক রক্তপাত ও হত্যাকাণ্ড হয়। বড় ধরণের ক্ষতি হয় স্বর্ণ মন্দিরের। এই অভিযানের নির্দেশ দিয়েছিলেন তখনকার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।
ওই অভিযানের কয়েকমাস পর নিজের দুই শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন ইন্দিরা গান্ধী। এ ঘটনার জের ধরে চার দিন ধরে দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয় ভারতে।
কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়, যার বেশিরভাগই শিখ। এ সংখ্যা তিন হাজার থেকে সতের হাজার পর্যন্ত বলা হয়ে থাকে। ভারতের সব রাজনৈতিক দলই শিখ স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে।
২০ মার্চ ২০২৩ লন্ডনের পর সান-ফ্রান্সিসকোয় ভারতীয় দূতাবাস খালিস্তানি হামলা এবং আন্তর্জাতিক সমালোচনা
যুক্তরাজ্যের লন্ডনে বিক্ষোভ প্রদর্শনের একদিন পরেই খলিস্তানি সমর্থকরা এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোতে অবস্থিত ভারতীয় কনস্যুলেটে হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পঞ্জাবের খলিস্তানি নেতা অমৃতপাল সিংহের মুক্তির দাবিতে এ হামলা চালানো হয়েছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস নাও ও আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোমবার (২০ মার্চ) সান ফ্রান্সিসকোতে অবস্থিত ভারতীয় কনস্যুলেটে খলিস্তানের হলুদ পতাকা ও দেয়ালে ‘ফ্রি অমৃতপাল’ লেখা গ্রাফিতি দেখতে পাওয়া গিয়েছে।
এদিকে অমৃতপালের মুক্তির দাবি তুললেও তাকে এখনও আটক বা গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। পুলিশের চোখে ধুলা দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ‘ওয়ারিশ পঞ্জাব দে’ বা ‘পাঞ্জাবের উত্তরাধিকারী’ আন্দোললনের এ নেতা।
সান ফ্রান্সিসকোয় দূতাবাসে হামলার একাধিক ভিডিও সোমবার সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও এসব ভিডিওর সত্যতা যাচাই করেনি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো। তবে ভিডিওতে দেখা গেছে, খলিস্তানিদের হলুদ পতাকা আটকানো লাঠির অংশ দিয়ে দূতাবাসের মূল দরজার কাচ ভাঙছেন অনেকে। দূতাবাসের ভিতরেও ঢুকে পড়েন তারা। এরপর ভেতরেই ভাঙচুর চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ।
সংবাদমাধ্যমগুলোর দাবি, সান ফ্রান্সিসকোর আগে রোববার লন্ডনের ভারতীয় দূতাবাসে প্রায় একই ধরনের হামলা চালিয়েছেন খলিস্তানপন্থীরা। লন্ডনের দূতাবাসে ভারতের জাতীয় পতাকাও নামিয়ে ফেলা হয়। সমাজমাধ্যমে সেই ভিডিয়োও ভাইরাল হয়েছে।
এদিকে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি জারি করে বলেছে, লন্ডনে “ব্রিটিশ নিরাপত্তার সম্পূর্ণ অনুপস্থিত” থাকা ও লন্ডনের ভারতীয় দূতাবাসে হামলার বিষয়ে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।
২০২৩ সালে হরদীপ সিং নিজ্জর কে হত্যার পর আন্তর্জাতিক খবরে আবারো ‘খালিস্তান টাইগার ফোর্স’
হরদীপ সিং নিজ্জর
ভারতকে ঘিরে কূটনৈতিক উত্তেজনার কারণ হলো দেশটি তিনটি সরকারের ওপর ক্রমশ চাপ বাড়াচ্ছিল। এই তিনটি দেশ হল কানাডা, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া। কানাডার নাগরিক ৪৫ বছর বয়সী হরদীপ সিং নিজ্জরকে গত ২০২৩ সালের ১৯ জুন কানাডার সারে-তে একটি গুরদোয়ারার পার্কিং লটে কেউ বা কারা গুলি করে হত্যা করে।
তার জন্ম হয়েছিলো পাঞ্জাবের জলন্ধরের ভারসিংপুর গ্রামে। তবে বহু বছর তিনি ভারতে আসেননি। কয়েক বছর আগে তার জলন্ধরের সম্পত্তিও ভারত সরকার বাজেয়াপ্ত করে নেয়।
হরদীপ সিং নিজ্জর ভারত সরকারের কাছে একজন ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন – তিনি ‘খালিস্তান টাইগার ফোর্স’ বা কানাডাতে ‘শিখস ফর জাস্টিসে’র (এসএফজে) মতো একাধিক সংগঠনেরও প্রধান ছিলেন।
তবে তার সমর্থকরা এসব অভিযোগকে ভিত্তিহীন দাবি করে আসছেন এবং বলছেন তিনি অ্যাক্টিভিজমের জন্য অতীতে বহুবার হুমকির শিকার হয়েছেন।
ভারতীয় গণমাধ্যম অবশ্য বলছে তিনি স্বাধীন শিখ রাষ্ট্রের দাবিতে একটি গণভোট আয়োজনের জন্য কাজ করছিলেন।
সেপ্টেম্বর ২০২৩ কানাডা ও ভারতের দুই দেশের পাল্টাপাল্টি বিষোদগার ও কূটনীতিককে বহিষ্কার
সেপ্টেম্বর মাসেই কানাডার হাউজ অব কমন্সে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, “কানাডার নাগরিক হরদীপ সিং নিজ্জারের হত্যার ঘটনায় ভারত সরকারের গুপ্তচরদের জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ নিয়ে কানাডার নিরাপত্তা এজেন্সিগুলি বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে কাজ করছে।
পার্লামেন্টের ভাষণে তিনি বলেন, “কানাডার গভীর উদ্বেগের কথা ভারত সরকারের শীর্ষ নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে। গত সপ্তাহে জি টুয়েন্টি সম্মেলনের মধ্যে বিষয়টি আমি ব্যক্তিগতভাবে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী মোদীর কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছি।”
মূলত ট্রুডোর ওই বক্তব্যের পরই দুই দেশের পাল্টাপাল্টি বিষোদগার আর ব্যবস্থা গ্রহণের পালা শুরু হয়।
দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের এতটাই অবনতি হয় যে একে অপরের একজন করে শীর্ষ কূটনীতিককে বহিষ্কার করে একেবারে শুরুর দিনই।
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ কানাডার নাগরিকদের জন্য ভিসা বন্ধ করলো ভারত
কানাডার নাগরিকদের জন্য ভিসা সেবা বন্ধ করেছে ভারত। কানাডায় একজন শিখ নেতাকে হত্যার ঘটনা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চলমান উত্তেজনার মধ্যে এমন পদক্ষেপ আসলো।
ভিসা সেবা দাতা প্রতিষ্ঠান বিএলএস ভারতীয় মিশন থেকে একটি বার্তা পোস্ট করে জানিয়েছে, ‘পরিচালনা সংক্রান্ত কারণে’ এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
চলতি সপ্তাহে শিখ নেতা হারদিপ সিং নিজ্জার হত্যার পেছনে ভারতের সম্পৃক্ততার ‘বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ’ তদন্ত করে দেখছে কানাডা – এমন মন্তব্যের পর দুই দেশের সম্পর্কে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বলা হয় , কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে একজন শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতার হত্যাকান্ডের সঙ্গে সে দেশের সরকার ভারতের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তোলার পর ভারতে শিখদের জন্য ‘খালিস্তান’ নামে আলাদা রাষ্ট্রের দাবিটি নতুন করে আবার আলোচনায় এসেছে।
গত জুন মাসে খালিস্তানি নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় ভারত জড়িত থাকতে পারে বলে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ তুলেছিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো।
তার এই অভিযোগের পর ভারত ও কানাডার কূটনৈতিক সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটেছে।
ভারত অবশ্য এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে একে ‘অবিশ্বাস্য’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
২০২৩ সালের ভারতীয় বংশোদ্ভূত জরিপ
কানাডায় প্রায় ১৪ লাখ ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষ রয়েছেন।
দুই হাজার ২১ সালের এক জরিপ অনুযায়ী কানাডার মোট জনসংখ্যার তিন দশমিক সাত শতাংশ মানুষ ভারতীয় বংশোদ্ভূত।
এরপর ২০২২ সালে কানাডায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী পাঠিয়েছে ভারত, সংখ্যায় সেটি প্রায় তিন লাখ ২০ হাজার। এই সংখ্যা কানাডার মোট বিদেশি শিক্ষার্থীদের প্রায় ৪০ শতাংশ।
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ সালে ভারতের দৈনিক আনন্দবাজার বিশাল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
সেই প্রতিবেদনে বলা হয় , শুধু ‘বৃহত্তর পঞ্জাব’ নিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র খলিস্তান গড়াই নয়, ভারতে নিষিদ্ধ বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘শিখস ফর জাস্টিস’ (এসএফজে)-এর প্রধান গুরপতবন্ত সিংহ পান্নুনের এমনই পরিকল্পনা ছিল। জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ)-র সাম্প্রতিক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, কানাডায় আশ্রয় নেওয়া একাধিক নাশকতা মামলায় অভিযুক্ত পান্নুন পাকিস্তানের মদতে কট্টরপন্থী মুসলিম জঙ্গিগোষ্ঠীগুলির সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভারত ভেঙে খলিস্তান এবং উর্দুস্তান রাষ্ট্র গড়ার ছক কষেছিল।
খলিস্তানি জঙ্গি হরদীপ সিংহ নিজ্জরের খুনের ঘটনায় কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর বিতর্কিত বিবৃতির পরে পর ভারত এবং কানাডার মধ্যে কূটনৈতিক টানাপড়েন চলছে। এর মধ্যেই গত সপ্তাহে পান্নুন কানাডার হিন্দুদের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। একটি ভিডিয়ো-বার্তায় তিনি বলেন, ‘‘ইন্দো-কানাডিয়ান হিন্দুরা, আপনারা কানাডা এবং এ দেশের সংবিধানের প্রতি নিজেদের আনুগত্য অস্বীকার করেছেন। আপনাদের গন্তব্য এখন ভারত। কানাডা ছেড়ে ভারতে যান।’’ এর পর ভারতে ১৬টি গুরুতর ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত পান্নুনের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে এনআইএ। চলতি মাসেই স্বাধীন ও সার্বভৌম খলিস্তান রাষ্ট্রের দাবিতে কানাডার কট্টরপন্থী শিখ গোষ্ঠী এসএফজে অন্টারিও-সহ কয়েকটি এলাকায় জমায়েত এবং গণভোটের ডাক দিয়েছে। ভারতে নিষিদ্ধ এবং খলিস্তানপন্থী সংগঠন সাম্প্রতিক কালে কানাডার কয়েকটি ভারতীয় দূতাবাসে বিক্ষোভও দেখিয়েছে। কোনও ক্ষেত্রেই ট্রুডোর সরকার পদক্ষেপ করেনি। এই আবহে বুধবার ‘উত্তেজনাপূর্ণ’ এলাকাগুলি এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ভারতীয় নাগরিকদের। ভারতীয় পড়ুয়াদের অবিলম্বে অটোয়ার ভারতীয় হাই কমিশন, টরন্টো এবং ভ্যাঙ্কুভারের কনস্যুলেট জেনারেলের দফতরে নাম নথিভুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বিদেশ মন্ত্রকের সতর্কবার্তায়।
আনন্দ বাজার প্রতিবেদনের সর্বশেষে লিখে , প্রসঙ্গত, আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেন-সহ কয়েকটি দেশে সক্রিয় রয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন এসএফজে। পঞ্জাবের মধ্যে ‘স্বাধীন এবং সার্বভৌম’ রাষ্ট্র গড়ার দাবি তুলেছে তারা। ২০১৯ সালের ১০ জুলাই এসএফজেকে পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কেন্দ্র। জানায়, ভারতের সার্বভৌমত্ব এবং ভৌগোলিক অখণ্ডতার জন্য বড়সড় হুঁশিয়ারি এই সংগঠন। ২০২০ সালে সংগঠনের নেতা পান্নুনকে জঙ্গি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। ইন্টারপোলকে ‘রেড নোটিস’ জারি করার অনুরোধও জানিয়েছে। যদিও এ বিষয়ে আরও তথ্য চেয়ে সেই আবেদন ফেরত পাঠায় ইন্টারপোল। তার পরেও কানাডায় বসে পান্নুনের সংগঠন ভারত বিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রচার করে চলেছে বলে জানিয়েছে এনআইএ। ভারত সরকার পান্নুনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কানাডা সরকারকে অনুরোধও জানালেও তাতে ফল মেলেনি।
খালিস্তানের পক্ষে বিক্ষোভ ও সমাবেশ
পশ্চিমা দেশগুলোতে থাকা শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের খালিস্তান বা শিখদের জন্য আলাদা দেশের দাবির বিরুদ্ধে বরাবরই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ভারত সরকার।
ভারতে খালিস্তান আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছিল ১৯৮০ এর দশকে। সেসময় শিখ-সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাব রাজ্যে একটি সহিংস বিদ্রোহ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
শক্তি প্রয়োগ করে এই বিদ্রোহ দমন করা হয়েছিল এবং ভারতের এর এখন আর খুব বেশি দাপট নেই। তবে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্যের কিছু শিখ ডায়াসপোরা সম্প্রদায়ের মধ্যে এটির এখনো জনপ্রিয়তা আছে। পাঞ্জাবের বাইরে কানাডায় সর্বোচ্চ সংখ্যক শিখ বসবাস করেন।তবে হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন মানুষ ভারতের পতাকা নিয়ে ‘খালিস্তানি সন্ত্রাসীদের’ আশ্রয় দেওয়ার ইস্যু বিরোধীয় বিক্ষোভ করে
স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র ‘খালিস্তান’ চক্রান্তে অমৃতপাল বলছে আনন্দবাজার
আনন্দবাজার বলছে, ঘটনাচক্রে এখানেও ভিন্দ্রানওয়ালের সঙ্গে তার মিল রয়েছে। ভারতীয় সেনার অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সাবেগ সিংহের সহায়তায় আশির দশকে স্বর্ণমন্দিরকে কার্যত অস্ত্রাগারে পরিণত করেছিলেন পাঞ্জাবের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের জনক। ভারতীয় সেনার অপারেশন ‘ব্লু স্টার’-এ ভিন্দ্রানওয়াল নিহত হয়েছিলেন।
ভিন্দ্রানওয়ালের কায়দাতেই স্বাধীন এবং সার্বভৌম খলিস্তান রাষ্ট্র গড়ার আহ্বান জানিয়ে বিপুল অর্থ সংগ্রহ করতেন অমৃতপাল। ‘ওয়ারিশ পাঞ্জাব দে’র কোনো কমিটিতেই সংগঠনের আয়-ব্যয়ের হিসাব দেওয়া হতো না। খলিস্তানপন্থী আন্দোলনে হাওয়া দিতে সীমান্তের ওপার থেকে জোগানো হচ্ছিল প্রচুর অস্ত্র, রসদ, মাদক। গত এক বছরে সীমান্তে ড্রোনের মাধ্যমে মাদকের চোরাচালান বেড়ে যাওয়ায় অমৃতপালের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে বলে সন্দেহ গোয়েন্দাদের।
অমৃতপালের বাহিনী আজনালা হামলা ছাড়া বড় ধরনের অশান্তি ছড়াতে না পারলেও ধারাবাহিক বিদ্বেষমূলক প্রচার চালিয়ে পাঞ্জাবে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটাতে বেশ কিছুটা সফল হয়েছে বলে গোয়েন্দা রিপোর্টে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। কৃষক আন্দোলনেও প্রত্যক্ষভাবে যোগ দিয়েছিলেন অমৃতপাল।
দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রের বক্তব্য, দুবাই আইএসআইয়ের অন্যতম বড় ঘাঁটি। কৃষি আন্দোলনে অমৃতপালের ভূমিকা দেখে তাকে বেছে নেয় পাক গুপ্তচর সংস্থা। অতীতের খলিস্তানি আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ কোনো সম্পর্ক ছিল না অমৃতপালের। কিন্তু আইএসআইয়ের সংস্পর্শে এসেই তিনি খলিস্তানি আন্দোলন নিয়ে দুবাইয়ে প্রচার শুরু করেন।
গোয়েন্দাদের দাবি, অমৃতপালকে জর্জিয়াতে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতেও পাঠায় আইএসআই। শেষে দুবাই হয়ে পাঠানো হয় ভারতে। পাঞ্জাবে ফিরে এসে মাদকবিরোধী মঞ্চ গড়ে তোলার আড়ালে খলিস্তানপন্থী আন্দোলনের সমর্থনে জনমত গড়ে তুলতে সক্রিয় হয়েছিলেন অমৃতপাল। তার মাদক-মুক্তি কেন্দ্রে মাদকাসক্তদের এত নিম্নমানের ওষুধ দেওয়া হতো যে তারা উল্টে মাদকে আরও নির্ভরশীল হয়ে পড়তেন। এরপর তাদের ‘ওয়ারিশ পাঞ্জাব দে’-র কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য করা হতো। যে কর্মসূচির একমাত্র লক্ষ্য ছিল হিংসা ছড়িয়ে খলিস্তান গড়ার ‘মগজধোলাই’।
এর আগে গত শনিবার অমৃতপালের পালিয়ে যাওয়া এবং পরবর্তী সময়ে গ্রেপ্তার নিয়ে বেশ কিছু বিভ্রান্তির তৈরি হয়েছিল দেশটিতে। বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে তাকে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরে অবশ্য জানা যায়, পুলিশ অমৃতপালকে গ্রেপ্তার করতে অভিযান চালাচ্ছে।
দেশটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা সে সময় জানিয়েছিলেন, ‘ওয়ারিশ পাঞ্জাব দে’ গোষ্ঠীর নেতা অমৃতপাল সিং একজন ‘আইএসআই এজেন্ট’। পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা তাকে ভারতে নিয়ে এসেছে খালিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন গড়ে তুলতে। সহিংসতা ছড়িয়ে দেওয়াই তার মূল উদ্দেশ্য।
আর তাই তো ‘দ্বিতীয় ভিন্দ্রানওয়ালে’ অমৃতপালকে ঘিরে ক্রমেই বাড়ছে রহস্য।
শিখদের একাংশ কেন আলাদা রাষ্ট্র চায়
খালিস্তান আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল, ভারতে শিখদের জন্য স্বাধীন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। গত শতকের আশির দশকে দেশটির পাঞ্জাব রাজ্যে এই আন্দোলন চরমে পৌঁছায়। সে সময় রাজ্যটিতে এ আন্দোলনের জেরে ব্যাপক সংঘাত ও হতাহতের ঘটনা ঘটে।
এ আন্দোলন থামাতে মাঠে নামে ভারতের সামরিক বাহিনী। বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে আন্দোলনের গতি থমকে দেওয়া হয়। এ নিয়ে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজের অধ্যাপক শ্রুতি কাপিলা বলেন, আধুনিক পাঞ্জাবের রাজনীতি খালিস্তান আন্দোলন থেকে দূরে সরে গেছে। আর স্বাধীন রাষ্ট্র বর্তমানে বেশির ভাগ শিখের চাওয়া–পাওয়া নয় বলেও রাজনীতিবিদেরা দাবি করছেন। যদিও এসব রাজনীতিবিদদের দাবির কোন সন্তোষজনক তথ্য তারা দিতে অপরে নাই।
লেখক – এমজেড ফয়সাল , সম্পাদক , ইউএসবি নিউজ , যুক্তরাষ্ট্র।
(প্রতিবেদন লেখার জন্য অনেক সংবাদ মাধ্যমের সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে ,সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা )