
মুসোলিনি। পুরো নাম বেনিটো অ্যামিলকেয়ার আন্দ্রে মুসোলিনি। জন্ম ১৮৮৩ সালের ২৯ জুলাই। নিহত হন ১৯৪৫ সালের ২৮ এপ্রিল। নেতৃত্ব দেন ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টির। তাকে বিবেচনা করা হয় ফ্যাসিজম সূচনার মুখ্য ব্যক্তি হিসেবে।
১৯২২ সালে হন ইতালির ৪০তম প্রধানমন্ত্রী। ১৯২৫ সাল থেকে ‘ইল ডুসে’ বা ‘দ্য লিডার’ উপাধি ব্যবহার করতে শুরু করেন। ডুচে হচ্ছে ইতালীয় খেতাব, যার অর্থ ‘নেতা’। যেমন হিটলার গ্রহণ করেন তার ‘ফুয়েরার’ খেতাব। ফুয়েরার শব্দের অর্থও ‘নেতা’। ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টির নেতা মুসোলিনিকে ফ্যাসিস্টরা তাদের ফ্যাসিস্ট আন্দোলনের নেতা হিসেবে ধরে নেয়।
১৯৩৬ সালের পর মুসোলিনির সরকারি পদবি ছিল : ‘হিজ এক্সেলেন্সি বেনিটো মুসোলিনি, হেড অব গভর্নমেন্ট, ডুচে অব ফ্যাসিজম, অ্যান্ড ফাউন্ডার অব দ্য এম্পায়ার’। তিনি সৃষ্টি ও অধিকার করেছিলেন একটি বিশেষ সামরিক পদ : ‘ফার্স্ট মার্শাল অব দ্য এম্পায়ার’। রাজার পদমর্যাদার তার আরেক উপাধি ছিল : ‘ভিক্টর তৃতীয় ইমানুয়েল’। এ উপাধি সূত্রে তিনি ইতালির সামরিক বাহিনীর ওপর সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণাধিকার প্রয়োগ করতেন। ১৯৪৩ সালে ক্ষমতা থেকে অপসারিত হন। এরপর তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্বল্পকালের জন্য তিনি ছিলেন ‘ইতালিয়ান সোস্যালিস্ট রিপাবলিক’-এর নেতা।
১৯৪৫ সালের এপ্রিলের শেষ দিকে ইতালির যুদ্ধে চূড়ান্ত পরাজয়ের আগে মুসোলিনি সুইজারল্যান্ডে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। অগ্রসরমান মিত্র বাহিনী এড়িয়ে তিনি পিছু হটে চলা একটি জার্মান সামরিক বহরের সাথে আল্পস পর্বতমালার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। এই কনভয়ের বা বহরের সাথে পালিয়ে যাওয়ার পথে তিনি স্ত্রীসহ আরো অনেকেই ধরা পড়েন ইতালীয় পার্টিশান বা প্রতিরোধ বাহিনীর হাতে।
কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন পার্টিশান নেতারা গোপনে মুসোলিনি ও তার সাথের ১৫ জন শীর্ষস্থানীয় ফ্যাসিস্ট নেতাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। কোনো বিচার না করেই ১৯৪৫ সালের ২৯ জুলাই সেখানেই তাদের মেরে ফেলা হয়। ঘটনাস্থলটি ছিল লেইক কমো। মেরে ফেলার পর তাদের লাশ নিয়ে আসা হয় ইতালির মিলানে। সেখানে তার ও স্ত্রীর লাশসহ আরো অনেকের লাশ একটি ‘এসো গ্যাস’ স্টেশনে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয় জনসাধারণের প্রদর্শনের জন্য। সেই সাথে তাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের জন্য।
লিবারেশন কমিটির সিদ্ধান্ত সতর্কতার সাথে গোপন রাখা হয়। তার পরও এটি জানা ছিল, কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি ও ইতালির উপপ্রধানমন্ত্রীর টগলিয়াট্টি আদেশ দিয়েছেন ডুসেকে মেরে ফেলতে। ন্যাশনাল লিবারেশন কমিটির নামে এই গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত করা হয় কর্নেল ভেলেরিওর ওপর। তিনি রাত ২টায় পৌঁছান ডুঙ্গো গ্রামে। তখন কমিউনিস্ট লিডার ও পার্টিশান লিডারের মধ্যে এক ধরনের দ্বন্দ্ব চলছিল। কর্নেল ভেলেরিও তাদের কাছে বন্দী ফ্যাসিস্টদের তালিকা চান। এরপর তিনি তাদের জানান তাকে আদেশ দেয়া হয়েছে মুসোলিনিকে মেরে ফেলতে। তিনি এই তালিকা থেকে হত্যার জন্য ১৫ জনের নাম বাছাই করেন। লিবারেশন কমিটি মুসোলিনির সাথে ১৫ জন ফ্যাসিস্টকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়।
ঘটনার ব্যাপারে সরকারের দেয়া ভাষ্য মতে, এই শুটিং পরিচালনা করেন কর্র্নেল ভ্যালেরিও। তার আসল নাম ছিল ওয়াল্টার অদিসিও। তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট দলীয় কমান্ডার। মুসোলিনিকে হত্যা করার আদেশ তাকে দেয় ন্যাশনাল লিবারেশন কমিটি।
মুসোলিনির লাশ
২৯ এপ্রিল তাদের সবার লাশ নিয়ে যাওয়া হয় মিলানের ‘এসো গ্যাস’ স্টেশনে। সেখানে ৬টি লাশের পায়ে বেঁধে মাথা নিচের দিকে ও পা উপরের দিকে দিয়ে গ্যাস স্টেশনে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এই ছয়টি লাশ ছিল মুসোলিনি, ক্লারা পেটাচি, ফ্রান্সেসকো বারাকো, অ্যালেসান্দ্রো প্যাভোলিনি, ফার্নান্দো মেজাসোম্মা এবং পাওলো জারবিনোর। তাদের ঝুলানো লাশের নিচে ছিল আরো অনেকের লাশ। বেশির ভাগ ছবিতে ঝুলানো অবস্থায় ৬টি লাশ দেখা গেলেও মাত্র কয়েকটি ছবিতে ৭টি লাশ ঝুলে থাকতে দেখা যায়। বলা হয়, আর্চিলি স্টারাচিকে গ্রেফতার করার পরপরই ঘটনাস্থলেই হত্যা করে মুসোলিনির বাম পাশে তার লাশ ঝুলিয়ে দেয়া হয়। তার লাশসহ ঝুলানো লাশের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭টি।
১৯৪৫ সালের ২৯ এপ্রিলে যখন রেড আর্মি আশপাশে যুদ্ধরত তখন সংক্ষিপ্ত আয়োজনে হিটলার ইভাকে বিয়ে করেন। তখন তার বয়স ২৯। আর হিটলারের ৫৬। এর ৪০ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে সায়ানাইড ক্যাপসুল খেয়ে তিনিও আত্মহত্যা করেন হিটলারের সাথে।
হিটলারের আত্মহত্যা
অ্যাডলফ হিটলারের কাছে খবর পৌঁছে স্ত্রীসহ মুসোলিনি ও তার সঙ্গীদের হত্যা করে মিলানে তাদের লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। জনগণ তাদের লাশকে নানাভাবে অপমান করছে। তাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করছে। তখন হিটলার সিদ্ধান্ত নেন, তার বেলায় এমনটি ঘটতে দেয়া হবে না। মুসোলিনিকে হত্যার মাত্র দুই দিন পর স্ত্রীসহ হিটলার ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল ফুয়েরার বাঙ্কারে গানশুটে আত্মহত্যা করে মারা যান। মরার পর হিটলারের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাদের লাশ পুড়িয়ে এর ছাইভস্ম অজ্ঞাত স্থানে মাটিতে পুঁতে রাখা হয়।যদিও তার মৃত্যু , আত্মহত্যা নিয়ে আরো অনেক ধরণের কাহিনী ও চালু আছে।
ইতালিতে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুসোলিনি। এই ফ্যাসিবাদের উপাদানগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল : ন্যাশনালিজম, করপোরেটিজম, ন্যাশনাল সিন্ডিক্যালিজম, এক্সপানশন্যালিজম, সোস্যাল প্রগ্রেস, ‘অ্যান্টিসোস্যালিজম। আর এর সাথে সম্মিলন ঘটানো হয় সেন্সরশিপ অব সাববারসিভ’ এবং ‘স্টেট প্রপাগান্ডার’। মুসোলিনি তার ফ্যাসিবাদী আদর্শ প্রতিষ্ঠার পরের বছরগুলোতে অনেক রাজনীতিকের ওপর যেমনি প্রভাব সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন, তেমনি অনেকের আশীর্বাদপুষ্টও হয়েছিলেন। ১৯৪০ সালের ১০ জুন তার নেতৃত্বে ইতালি অক্ষশক্তির পক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়।